নতুন করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে দীর্ঘ প্রত্যাশার অবসান হচ্ছে। দেশে আগামী বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে টিকাদান কর্মসূচি। প্রথম দফায় ২৫ জন সম্মুখযোদ্ধাকে টিকা দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী টিকার সংরক্ষণ, বিতরণ হবে। তবে প্রয়োজনে এতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, নতুন পরিকল্পনায় প্রথম মাসে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। পরের মাসে ৫০ লাখ ডোজ। পরের মাসে আবার ৬০ লাখ ডোজ। দ্বিতীয় ডোজ মেলানোর জন্য এভাবে দেওয়া হবে। পরের মাস থেকে আবার ৫০ লাখ করে দেওয়া হবে। খবর বিডিনিউজের।
যেভাবে সংরক্ষণ : ভারত সরকারের উপহার হিসেবে আসা অঙফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ চার হাজার ডোজ টিকা রাখা হয়েছে তেজগাঁওয়ের ইপিআই স্টোরে। এছাড়া বেঙ্মিকো ফার্মার মাধ্যমে কয়েক ধাপে আসবে মোট তিন কোটি ডোজ টিকা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বেঙ্মিকোর মাধ্যমে যে টিকা আসবে তা তাদের ওয়্যারহাউজে রাখা হবে। এসব টিকা ছয়টি ধাপে জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেবে বেঙ্মিকো।
বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সারা দেশে টিকা পাঠানোর জন্য সাতটি বিশেষায়িত ট্রাক কেনা হয়েছে। আরও ট্রাক কেনা হবে। জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে টিকা যাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়।
সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি জানিয়েছে, ঢাকা থেকে ৬৪টি জেলার ইপিআই স্টোরে টিকা পাঠানো হবে। সেখান থেকে টিকা যাবে ৪৮৩টি উপজেলা ইপিআই স্টোরে। ইপিআই স্টোরের আইএলআরে (হিমায়িত বাঙে টিকা রাখার ব্যবস্থা) এসব টিকা রাখা হবে। সেখান থেকে কোল্ড বঙে করে নেওয়া হবে টিকাদান কেন্দ্রে।
প্রথমে পাবেন যারা : সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনা টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ভাগে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেওয়া হবে। তবে এতে প্রাধান্য পাবে সম্মুখযোদ্ধারা।
প্রথম ফেইজের প্রথম ধাপে দেশের মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ, অর্থাৎ ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবেন। দ্বিতীয় ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ, এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকা পাবেন। দ্বিতীয় ফেইজে পাবেন জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ; অর্থাৎ এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন।
তৃতীয় ফেইজের প্রথম ধাপে জনসংখ্যার ২১ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জন এবং শেষ ধাপে জনসংখ্যার ৪১ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। মূল পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে টিকার প্রাপ্যতা অনুযায়ী মাসভিত্তিক বিতরণ তালিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিপ্তদর।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম ফেইজের প্রথম স্টেইজে মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। প্রথম মাসে টিকা পাবেন ৫০ লাখ মানুষ। তবে বুধবার ভারত সরকারের উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা আসার পর পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম মাসে ৭০ লাখ টিকা আসবে। তা থেকে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। পরের মাসে দেওয়া হবে ৫০ লাখ ডোজ।
প্রথম মাসে ৫০ লাখ টিকা বিতরণ তালিকা অনুযায়ী, টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে আছে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরাসরি নিয়োজিত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রথম মাসে সবার আগে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী টিকা পাবেন। এছাড়া কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য সেবায় সরাসরি নিয়োজিত সব ধরনের অনুমোদিত বেসরকারি ও প্রাইভেট মিলিয়ে ছয় লাখ স্বাস্থ্যকর্মী প্রথম ধাপেই টিকা পাবেন।
অগ্রাধিকার তালিকায় আছেন আরো ২ লাখ ১০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৭ জন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন, সম্মুখসারির ২৫ হাজার জন গণমাধ্যমকর্মী, ৮৯ হাজার ১৪৯ জন জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার ৭৫ হাজার জন কর্মচারী, মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৫০০ জন প্রথম মাসে টিকা পাবেন।
এছাড়া জরুরি পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন, ফায়ার সার্ভিস এবং বিমানবন্দরের দুই লাখ কর্মী, স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের ৭৫ হাজার জন, ৬০ হাজার প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক, জেলা-উপজেলায় জরুরি জনসেবায় নিয়োজিত দুই লাখ সরকারি কর্মচারী এবং ফুটবল, হকি, ক্রিকেট মিলিয়ে জাতীয় দলের ১০ হাজার ৯৩২ জন প্রথম মাসেই টিকা পাবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম মাসে ৭০ হাজার ডোজ রাখা হয়েছে বাফার, ইমার্জেন্সি, আউটব্রেক মোকাবেলায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসিএএইচ-এর লাইন ডিরেক্টর ডা. শামছুল হক বলেন, আমরা প্রতিটি শ্রেণি অনুযায়ী টিকার পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দেব। আগে ধরেছিলাম ৭৭ বছরের উর্ধ্বে, এখন বাড়তি টিকা পাওয়ায় হয়তো ৭৫ বছর থেকে ধরব।
টিকা পেতে যা করতে হবে : করোনা ভাইরাসের টিকার নিবন্ধনের জন্য গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোর থেকে সুরক্ষা অ্যাপস ডাউনলোড করতে হবে। অথবা সুরক্ষাডটজিওভিডটবিডি এই ঠিকানায় গিয়ে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল থেকে নিবন্ধন করা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সুরক্ষা পোর্টাল বা অ্যাপসে গেলে একটি নিবন্ধন বাটন পাওয়া যাবে। নিবন্ধন বাটন চেপে টিকা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি কোন শ্রেণিতে পড়েন তা নির্বাচন করবেন। সেখানে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, সঠিক জন্ম তারিখ দিতে হবে। নিবন্ধনের সময় আবেদনকারীকে একটি মোবাইল নম্বর দিতে হবে যেখানে টিকা সম্পর্কিত সব তথ্য পাঠানো হবে।
অ্যাপসে একটি ঘর থাকবে যেখানে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি রোগের মতো দীর্ঘমেয়াদী কোনো রোগ আছে কিনা তা জানাতে হবে। কখনও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন কিনা সেটাও উল্লেখ করতে হবে। আগ্রহী কোভিড-১৯ কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন কিনা তাও নির্বাচন করতে হবে একটি ঘরে। ঠিকানার ঘরে টিকা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তির বর্তমান ঠিকানা দিতে হবে। আবেদনকারী যে ঠিকানা নির্বাচন করবেন সেই অনুযায়ী তার টিকাদান কেন্দ্রের নাম আসবে। সব তথ্য দেওয়ার পর একটি অঙ্গীকারনামায় টিকা নিয়ে ‘তথ্যগুলো সংরক্ষণ করুন’-এই বাটন চাপতে হবে।
তথ্য সংরক্ষণ করলেই মোবাইলে একটি এসএমএসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা হবে। এ সময় আবেদনকারীর মোবাইলে একটি ওয়ানটাইম পাসওয়ার্ড যাবে। ওই পাসওয়ার্ড দিয়ে নিজের কার্ড নিজে ডাউনলোড করতে পারবেন। টিকা নেওয়ার সময় ওই কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে।
অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম জানান, যারা অ্যাপসে নিবন্ধন করতে পারবেন না, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, যাদের অ্যাপস থাকবে না তারা যদি টিকা নিতে হাসপাতালে যান, সেখানে আমাদের লোকজন আছেন সাহায্য করার জন্য।
সাড়ে ৬ হাজার কেন্দ্র : জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, সারাদেশের ছয় হাজার ৫০০টি কেন্দ্রে নভেল করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৪৬০০টি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, ৬০০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ এবং ২০ ও ১০ শয্যার হাসপাতালে কেন্দ্র হবে। এছাড়া জেলা সদর হাসপাতাল/জেনারেল হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ (সরকারি/বেসরকারি) সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কেন্দ্র হবে ৪০০টি।
সিটি করপোরেশন এলাকার বিশেষায়িত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, সংক্রমক ব্যাধি হাসপাতাল, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়, নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ৮০০টি টিকাদান কেন্দ্র থাকবে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, সচিবালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং সংসদ সচিবালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র মিলিয়ে টিকাদান কেন্দ্র হবে ১০০টি।
শুরুতে শুধু বিভিন্ন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের টিকাদান কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। টিকা দেওয়ার কাজটি করবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্য কর্মীরা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০ হাজার ৮০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী টিকা প্রয়োগে সরাসরি যুক্ত থাকবেন। তাদের সঙ্গে দু’জন করে ৪১ হাজার ৬০০ জন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। সারাদেশের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এলাকায় টিকা বহনে পাঁচ হাজার ৪৬৯ জন পোর্টার এবং আট হাজার ৮৬৯ জন সুপারভাইজার থাকবেন।