টার্মিনাল হস্তান্তর এবং বাংলাদেশের লাভক্ষতি

ড. নারায়ন বৈদ্য

| বৃহস্পতিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গোপসাগরের তীরে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়াতে এ দেশে বেশ কিছু নৌ বন্দর ও সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠেছে। এসব নদী বন্দর ও সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি যেমন হয় তেমনি দেশের অভ্যন্তরে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্বল্প ব্যয়ে পণ্য আনা নেয়া করা সহজ হয়। কিছু কিছু নৌ বন্দর দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য যেমন আমদানি হয় তেমনি রপ্তানিও হয়ে থাকে। পাট যখন সোনালী আঁশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে কদর ছিল তখন অধিকাংশ পাট রপ্তানি হতো নারায়ণগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর উন্নত হওয়াতে আস্তে আস্তে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পণ্য আমদানি রপ্তানি হতে থাকে এ দুই সমুদ্র বন্দর দিয়ে। আবার আমদানি ও রপ্তানির ধরন যেমন পাল্টে গেছে তেমনি প্যাকেজের আকারও পাল্টে গেছে। চাউল, গম ও অন্যান্য দুই একটি পণ্য ছাড়া এখন সব ধরনের পণ্যকে বিশাল কন্টেনারের মধ্যে ঢুকিয়ে আমদানি ও রপ্তানি করা হয়। এতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। কারণ বিশাল বিশাল জাহাজগুলো যখন বড় বড় সাগর পাড়ি দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশের দিকে এগিয়ে যায় তখন মাঝ সমুদ্রে কোনো কোনো সময় ঝড়ের কবলে পড়ে। এতে সাগরের প্রচন্ড ঢেউ এর পানি জাহাজের মধ্যে ঢুকে যায়। এখন আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যগুলো যদি উন্মুক্ত থাকে তবে সাগরের পানিতে ভিজে মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। যদিও প্রত্যেক আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের বীমা থাকে তবুও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরূপ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আধুনিক যুগে অধিকাংশ পণ্য বিশাল বিশাল কন্টেইনারের মধ্যে ঢুকিয়ে আমদানি ও রপ্তানি করা হয়। এতে মালামাল যেমন নষ্ট হয় না তেমনি ব্যবসায়ীদের ক্ষতিও হয় না। এভাবে ১৯৮০ দশকের শেষ ভাগ থেকে অধিকাংশ পণ্য কন্টেইনারের মধ্যে ঢুকিয়ে আমদানি ও রপ্তানি করা হয়। কিন্তু কন্টেইনার ভর্তি বিশাল বিশাল জাহাজগুলো অগভীর সমুদ্র বন্দরে আসতে পারে না। ফলে গভীর সমুদ্রে নোঙর করে। তা থেকে লাইটার জাহাজ বা তুলনামূলক ছোট জাহাজে করে সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত সমুদ্র বন্দর বা নৌ বন্দরে কন্টেইনারগুলো খালাস করে। এখন কন্টেইনারগুলো খালাস করার জন্য আধুনিক মেশিনের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, মোংলা সমুদ্র বন্দর এবং পায়রা বন্দর দিয়ে মালামাল খালাস করার সুব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে প্রায় সময় বন্দরে মালামাল খালাসের এবং মালামাল শিপমেন্ট করার কাজে দীর্ঘ জট লেগে থাকে। আবার যত দ্রুত মালামাল শিপমেন্ট বা খালাস করা যায় ততই বন্দরের মুনাফা বৃদ্ধি পায়। কারণ প্রতিটি কন্টেইনারের জন্য আমদানি ও রপ্তানিকারককে নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করতে হয়। বিশ্বের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় বাংলাদেশের বন্দরগুলো দ্রুত সময়ে মালামাল খালাস যেমন করতে পারে না তেমনি শিপমেন্ট ও করতে পারে না। বলা যায়, বহুগুণ পিছিয়ে আছে আমাদের বন্দরগুলো। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার দুই একটি পুরাতন বন্দর ও দুই একটা নতুন বন্দর, বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে, যেখান থেকে পর্যাপ্ত আয় হবে। ১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ঢাকার একটি হোটেলে দুইটি দেশের দুইটি কোম্পানীর সাথে বাংলাদেশ সরকারের দুই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুসারে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং ৩০ বছরের জন্য এটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে ডেনমার্কের এপি মোলার মায়ের্সক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। এ টার্মিনাল নির্মাণের জন্য কোম্পানীটি ৫৫ কোটি ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। তাছাড়া সাইনিং মানি হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নিয়ে করা চুক্তি সই করেন ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম, টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। এই টার্মিনালে বছরে আট থেকে দশ লাখ একক কন্টেইনার উঠানো ও নামানোর সক্ষমতা থাকবে। এরমধ্যে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি একক কন্টেইনারের জন্য ২১ ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৫০০ টাকা করে পাবে সরকার। আর আট লাখের বেশি কন্টেইনার উঠানোনামানো হলে প্রতি একক কন্টেইনারের জন্য বাংলাদেশ পাবে ২৩ ডলার করে। অন্যদিকে ২২ বছরের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌটার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এস প্রতিষ্ঠানটি। এই টার্মিনালে মোট ৪ কোটি ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে মেডলগ। এ কোম্পানি থেকে সাইনিং মানি হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৮ কোটি টাকা, পানগাঁও নৌ টার্মিনাল বছরে ১লাখ ৬০ হাজার একক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হবে। প্রতি একক কন্টেইনার থেকে বাংলাদেশ পাবে ২৫০ টাকা।

একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা এবং অপর একটি টার্মিনাল পরিচালনার ভার বড় বড় দুইটি কোম্পানীকে দেয়া হয়েছে। কেহ কেহ প্রশ্ন তুলেছেন যে, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে এই চুক্তি করেছে সরকার। এর উত্তরে সরকার বলেছে, বন্দরের মালিকানা বাংলাদেশের কাছেই থাকছে। লালদিয়া চরে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস একটি নতুন টার্মিনাল নকশা ও নির্মাণ করবে। এই টার্মিনালের মালিক হবে বাংলাদেশ। এপিএম শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে। বিশ্বের শীর্ষ ২০টি বন্দরের মধ্যে ১০টি পরিচালনা করে এপিএম টার্মিনালস। লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প। এর সম্পূর্ণ বিনিয়োগ হবে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তার। সাইনিং মানি হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা এবং নির্মাণকালে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এপিএম। চুক্তির মেয়াদকালে তারা যত কন্টেইনার হ্যান্ডেল করবে, প্রতিটির জন্য বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট মাশুল পাবে। যত বেশি সংখ্যায় কন্টেইনার হ্যান্ডেল করবে, ৩৩ বেশি আয় হবে। কোনো কন্টেইনার হ্যান্ডেল করতে না পারলেও ন্যূনতম সংখ্যা ধরে বাংলাদেশকে তারা মাশুল দেবে।

এই দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের দুইটি টার্মিনাল পরিচালনায় ভার বিদেশি কোম্পানীদের হাতে গেলেও বাংলাদেশ লাভজনক হবে। কিন্তুু সরকার ঘোষণা করেছে যে, পিপিপি চুক্তির মূল দলিল জনসমক্ষে প্রকাশ করবে না। কারণ এতে আইনগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারি ক্রয়নীতি ও পিপিপি গাইডলাইন অনুসারে চুক্তির পূর্ণ প্রকাশ নিরাপদ নয়। কারণ এটি ভবিষ্যৎ দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে, এছাড়া চুক্তির দলিলে ব্যবসায়িক তত্ত্ব ও পরিচালনা কৌশল থাকে। কিন্তুু অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ভিন্ন কথা। তারা মনে করেন, এ রকম চুক্তির আগে সরকার যুক্তি দেন যে, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে, আমরা পারব না, আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। কিন্তুু বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে? আন্তর্জাতিকভাবে কী দুর্নীতি হয় না?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, নিজ দেশের সম্পদ পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দিয়ে প্রচুর লাভবান হয়েছেএমন নজির আছে। মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ তেল উত্তোলনের প্রযুক্তি নিজদের কাছে না থাকার কারণে তেল উত্তোলনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিদেশি কোম্পানিদেরকে। এ নীতির ওপর ভর করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজদের আয়ের পরিমাণ বাড়িয়েছে। অবশ্য প্রযুক্তি সহায়তা দিতে এসে দেশ দখল করেছেএমন উদাহরণও কম নয়। তবে তা নির্ভর করবে চুক্তির শর্ত এবং বিদেশি কোম্পানির মনমানসিকতার ওপর।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশে মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন প্রণীত হচ্ছে
পরবর্তী নিবন্ধতাজউদ্দিন আহমদ : সময়ের সাহসী, বিচক্ষণ কিন্তু নিঃসঙ্গ শেরপা