টানেল যুগে বাংলাদেশ

আরেক স্বপ্নপূরণ, আজ সকাল থেকে চলবে যানবাহন

হাসান আকবর | রবিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

পূরণ হলো আরেকটি স্বপ্ন। সুড়ঙ্গপথে সংযোগ স্থপিত হয়েছে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের। চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে ইতিহাসের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মধ্যদিয়ে বহুল কাঙ্ক্ষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে টানেল যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। গতকাল বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন হলেও প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর ছাড়া আর কোনো গাড়ি চলেনি। আজ রোববার সকাল থেকে যান চলাচলের উন্মুক্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল।

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পরপরই আতশবাজি ফোটানো হয়। মুহূর্তের মধ্যে আতশবাজিতে রঙিন হয়ে ওঠে কর্ণফুলীর জলরাশির উপরের আকাশ। এ সময় উপস্থিত অতিথিরা করতালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। টানেল উদ্বোধনের দৃশ্য আনোয়ারার জনসভাস্থলে বসানো ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শন করা হয়। এ সময় জনসভার লাখো জনতা মুহুর্মুহু করতালিতে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। মাইকে বাজানো হয় দেশাত্মবোধক গানের সুর। প্রদর্শিত হয় থিম সং। এরপর টানেল উদ্বোধনের দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যান। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়িবহর টানেল এলাকায় প্রবেশ করে। টানেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারা টোল প্লাজায় যান। সেখানে টোল প্লাজা কমপ্লেঙ ও টানেলের স্মার্ট মনিটরিং কক্ষ পরিদর্শন করেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী পৌনে ১২টায় পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে টোল প্লাজায় টোল দিয়ে টানেল হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে যাত্রা করেন। সেখানে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে টোল নেন ঝুমুর আক্তার। টোল কালেক্টর ঝুমুর আক্তার প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে টাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রশিদ দিলে প্রধানমন্ত্রী তা হাত তুলে দেখান। প্রথম যাত্রী হিসেবে টানেলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। এরপর তার গাড়িবহরে থাকা অন্য গাড়িগুলো টোল পরিশোধ করে।

এ টানেলের মাধ্যমে শিল্প ঘেরা কর্ণফুলীর দুই পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয়ে উঠেছে, সংযোগ স্থাপিত হলো। ঢাকাচট্টগ্রামকঙবাজার মহাসড়কে যোগাযোগ ক্ষেত্রে স্থাপিত হলো নব দিগন্ত। গতি পাবে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য।

কর্ণফুলী নদীর এক পাড়ে বন্দর নগরী, অন্য পাড়ে আনোয়ারা উপজেলার শিল্প এলাকা। ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে নির্মিত এ টানেল গতকাল উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে দুই পাড় যুক্ত হলো। পথ খুলেছে বিশ্বমানের যোগাযোগের। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক নগরীকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে গড়ে তোলার যে লক্ষ্য সরকারের ছিল, তার একটি বড় পদক্ষেপের বাস্তবায়ন হলো নদী তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।

আজ সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলবে : পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য টানেলটি খুলে দেওয়া হবে। টানেলের নিরাপত্তায় লাগানো হয়েছে অত্যাধুনিক ১১০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। আনোয়ারা প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে মনিটরিং সেন্টার। যেখান থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে পুরো টানেলে নজরদারি চালানো হবে। টানেলের প্রতিটি টিউবে রয়েছে লম্বা একটি হিট সেন্সর। যেখানে অগ্নিকাণ্ড বা কোনো কারণে তাপ লাগা মাত্র অটোমেটিক সিসিটিভি ক্যামেরা ঘটনাস্থলের দিকে ঘুরে যাবে। এছাড়া কোনো দুর্ঘটনা হলে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি চালানো হবে।

নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) আগামী পাঁচ বছর টানেলের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করবে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাদের কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। টানেলের ভেতরে যেকোনো সমস্যায় দ্রুত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় সেই টিম ছুটে যাবে। তাদের সঙ্গে নৌবাহিনী, পুলিশ নিরাপত্তার কাজ করবে। অগ্নি দুর্ঘটনা ঠেকাতে টানেলের দুই প্রান্তে স্থাপন করা হচ্ছে প্রথম শ্রেণির দুটি ফায়ার স্টেশন।

কিপয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই) স্থাপনা বিবেচনায় নিরাপত্তায় থাকবে টানেল। প্রবেশমুখে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হচ্ছে চারটি অত্যাধুনিক স্ক্যানার। বর্তমানে দুই প্রান্তে দুটি স্ক্যানার বসানোর হয়েছে। স্ক্যানার দিয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলোতে চালক ও পণ্য রাখার অংশ আলাদা রঙের রশ্মি দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এছাড়া টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী বাস, কার, মাইক্রোবাস অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রে স্ক্যানারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে ইউভিএসএস (আন্ডারভেহিকেল স্ক্যানিং সিস্টেম)। ইউভিএসএস দিয়ে যানবাহনের নিচের অংশে বিস্ফোরকজাতীয় সরঞ্জাম আছে কিনা তা যাচাই করা হবে।

রাজনৈতিক দলের হরতাল কর্মসূচি থাকলেও আজ টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পূর্ব ঘোষণা বহাল রাখা হয়েছে। আজ ভোর ৬টা থেকে নির্ধারিত যানবাহন টানেল অতিক্রম করতে পারবে। টানেল দিয়ে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি চলতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্মাণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এই টানেল দিয়ে যানবাহন ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে।

টানেলের আদ্যোপান্ত : কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চীনের বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই শুরু। তারপর প্রায় ৯ বছরের পরিক্রমায় গতকাল উদ্বোধন হলো স্বপ্নের টানেল।

২০১৫ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার দুই বছর পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় টানেল প্রকল্প এলাকার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে এ খনন কাজ উদ্বোধন করেন। এর আগে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের নবগঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে টানেলটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণের প্রস্তাব করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

প্রায় ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।

কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা নেভাল অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই সুড়ঙ্গ পথ কর্ণফুলীর ওপারে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে আবার ভূপৃষ্ঠে উঠেছে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব নিয়ে আজ থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হবে ভোর থেকে। টিউব দুটির একটির সঙ্গে অপরটির দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুটি করে চারটি লেইন রয়েছে।

কর্ণফলী নদীর দক্ষিণে আনোয়ারায় রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইউএফএল ও পারকি সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী পেরিয়ে আনোয়ারা দিয়েই বাঁশখালী, কঙবাজার, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগে স্থাপিত হবে নতুন দিগন্ত।

বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পের শুরুর দিকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। অনুমোদনের দুই বছর পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হলে ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা করা হয়। পরে খরচ বেড়ে হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। টানেল প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসারা দেশে আজ শান্তি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, ঢাকা রণক্ষেত্র