টাকা পেয়ে কাজ ফেলে পালালেন ঠিকাদার

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৫ মার্চ, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নগরের পোর্ট কানেক্টিং রোডের উন্নয়ন কাজের বিলের টাকা ব্যাংকের (ইউসিবিএল, কুমিল্লা শাখা) নির্ধারিত হিসাবে জমা না দিয়ে ঠিকাদারের নামে সরাসরি ইস্যু করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। যার পরিমাণ ২৪ কোটি ৯১ লাখ ৯৬ হাজার ৩০৭ টাকা। বিপুল অংকের এ টাকা পেয়ে মাঝপথে কাজ ফেলে পালিয়েছে দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত অক্টোবর থেকে কাজ বন্ধ রেখেছে তারা। দীর্ঘদিন কাজ না করায় গত সপ্তাহে (বৃহস্পতিবার) কার্যাদেশ বাতিল করেছে চসিক। এতে একদিকে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে টাকা আদায়ে চসিকের বিরুদ্ধে মামলার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যাংক।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের নির্ধারিত হিসাবের বিপরীতে চেক ইস্যু না করে ‘অনিয়ম’ করায় প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (নং ০১/২০২১) হয়েছে। আজ সোমবার বিকেল তিনটায় এর শুনানি হবে। নির্ধারিত হিসাবের বিপরীতে চেক ইস্যু না করায় ব্যাংকের পক্ষে চসিকের কাছে দুই দফা ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আজ তৃতীয় দফায় ব্যাখ্যা চেয়ে আরেকটি পত্র পাঠানোর কথা রয়েছে ব্যাংকের।
জানা গেছে, পোর্ট কানেক্টিং রোডের উন্নয়ন কাজের জন্য চারটি প্যাকেজে নিয়োগ দেয়া হয় ঠিকাদার। এর মধ্যে দুই নম্বর প্যাকেজে বড়পোল থেকে তাশফিয়া আনন্দিপুর গেট পর্যন্ত এক দশমিক ৬৭৫ কিলোমিটার সড়কের জন্য ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩৩৯ টাকায় ‘মের্সাস রানা বির্ল্ডাস’কে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর কার্যাদেশ দেয়া হয়। একইদিন তিন নম্বর প্যাকেজে নিমতলা বিমান চত্বর থেকে বড়পোল ব্রিজ পর্যন্ত এক দশমিক ৬৮২ কিলোমিটার সড়কের জন্য ৫০ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৮ টাকায় ‘মের্সাস রানা বিল্ডার্স-সালেহ আহমদ (জেভি)’-কে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে ঠিকদারি প্রতিষ্ঠান দুটি কাজের বিপরীতে ঋণ নিয়েছে ইউসিবিএল, কুমিল্লা শাখা থেকে। এক্ষেত্রে হওয়া লিয়েন অনুযায়ী, উন্নয়ন কাজের বিলের টাকা ব্যাংকের নির্ধারিত হিসাবে জমা করতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে। এ বিষয়ে ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চসিকের প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ম্যানেজারকে চিঠি দিয়ে ব্যাংক নির্ধারিত হিসাবে টাকা পরিশোধ করা হবে বলে আশ্বস্তও করেন। যদিও তা রক্ষা করা হয়নি। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার গোপন সমঝোতা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
২০ চেকের চৌদ্দটিই ঠিকাদারের নামে ইস্যু : এ পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়া কাজের বিপরীতে মের্সাস রানা বির্ল্ডাসকে ২৮ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৩৬৫ টাকা এবং মের্সাস রানা বিল্ডার্স-সালেহ আহমদ (জেভি)-কে ৩১ কোটি ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৬ টাকা পৃথক ২০টি চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করে চসিক। এর মধ্যে ৬টি চেক ব্যাংকের নির্ধারিত হিসাবের নামে ইস্যু করা হয়। তার পরিমাণ ১৯ কোটি ৭২ লাখ ৭৭ হাজার ২১৮ টাকা। বাকি ১৪টি চেক ইস্যু করা হয়েছে সরাসরি ঠিকদারের নামে।
দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাংকের নির্ধারিত হিসাব বাদ দিয়ে সরাসরি ঠিকদারের নামে ইস্যু করা চেকগুলোর মধ্যে ‘২০১৮ সালের ৯ আগস্ট তিন কোটি ৩৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৮ টাকা এবং ৩ কোটি ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯০ টাকার পৃথক দুটি চেক রয়েছে। বাকিগুলো ইস্যু করা হয় ২০১৯ সালে। এর মধ্যে বছরটির ২৮ জানুয়ারি তিন কোটি টাকা করে দুই চেকে ৬ কোটি টাকা, ২৪ এপ্রিল এক কোটি ৩৯ লাখ ১১ হাজার ৬৯৫ টাকা এবং ৩ কোটি ৩৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৬৮ টাকার পৃথক দুটি চেক, ১২ জুন এক কোটি টাকা করে দুই চেকে দুই কোটি টাকা, ৪ সেপ্টেম্বর দুই চেকের একটিতে এক কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার ৩৬ টাকা এবং অপর চেকে ৪ সেপ্টেম্বর ৬৯ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৯ টাকা, ৩০ সেপ্টেম্বর দুই চেকের একটিতে ৭১ লাখ ৭২ হাজার ৭৩৯ টাকা এবং অপর চেকে এক কোটি ৫ লাখ ১৭ হাজার ৮৩২ টাকা, ২৩ ডিসেম্বর দুই চেকের একটিকে এক কোটি এক লাখ ৮২ হাজার ৩৪৩ টাকা এবং অপর চেকে পরিশোধ করা হয় ৯৮ লাখ ১৭ হাজার ৬৫৭ টাকা।
ব্যাখ্যা চেয়েছে ব্যাংক : ইউসিবিএল কুমিল্লা শাখার প্রধান ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইমতিয়াজ হক দুই দফা চিঠি দিয়ে চসিকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর প্রথম দফা এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেন। চসিকের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা বরাবর আজ আরেকটি চিঠি দেয়া হবে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন ইমতিয়াজ হক। তিনি বলেন, চসিক প্রশাসক এবং প্রধান প্রকৌশলীকে দুই দফা চিঠি দিয়েছি। তারা কোনো জবাব দেননি। আরেকটি চিঠি কাল (আজ) ইস্যু করবো। এরপরও জবাব না দিলে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। চসিসকে দেয়া চিঠিগুলোতে বলা হয়, মেসার্স রানা বিল্ডার্স লি.-সালেহ আহমেদ জেভির নামে চসিকের ইস্যুকৃত ১১ কোটি ৫৭ লাখ ৯০ হাজার ১৮২ টাকা এবং মের্সাস রানা বির্ল্ডাস এর নামে ১০ কোটি ৩৪ লাখ ৬ হাজার ১২৫ টাকার চেক ব্যাংকের অ্যাসাইন্টমেন্টকৃত হিসাবে জমা হয়নি। চিঠিতে কার নামে চেকগুলো ইস্যু করা হয়েছে সেটাও জানতে চাওয়া হয়। এতে আরো বলা হয়, চেক আদায়ের জন্য চিঠিপত্র ও ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করে তাগাদা দিলেও ব্যাংকের নির্র্ধারিত হিসাবে জমা দেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বলেন, টাকা না পেলে আমরা ঠিকদারের বিরুদ্ধে মামলা করবো। সেখানে চসিককে বিবাদী করা হবে। তার প্রস্তুতি চলছে। তবে তার আগে চেষ্টা থাকবে টাকা আদায়ের।
সাইফুদ্দিনের বক্তব্য : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘মেয়র মহোদয়ের নির্দেশ ছাড়া কিছু করার সুযোগ নাই। ওনার নির্দেশেই চেকগুলো ঠিকাদার বরাবর ইস্যু করেছি।’
এদিকে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া চসিকের বিভাগীয় মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘অভিযুক্তের আচরণ চাকরি বিধিমালা, ২০১৯ এর বিধি ৪৯ (ক) (খ) মোতাবেক অসদাচরণ পর্যায়ভুক্ত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা : কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, মের্সাস রানা বির্ল্ডাস মাত্র ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মের্সাস রানা বিল্ডার্স-সালেহ আহমদ (জেভি) ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে। এর আগে ২০২০ সালের মে মাসে রানা বিল্ডার্স ৬৩ শতাংশ এবং মের্সাস রানা বিল্ডার্স-সালেহ আহমদ (জেভি) ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ কাজ শেষ করেছিল। অর্থাৎ গত এক বছরে কাজের অগ্রগতি তেমন ছিলই না।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ১ অক্টোবর থেকে কাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দু’টি। কাজ সম্পন্ন করতে তাদের বারবার তাগাদা দেয় চসিক। সর্বশেষ কার্যাদেশ বাতিল করা হয় গত বৃহস্পতিবার। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ আছে আগামী জুন পর্যন্ত। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে বাড়বে ভোগান্তি।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমদ বলেন, ‘তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। এজন্য কার্যাদেশ বাতিল করেছি। দ্রুত সময়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র শবে বরাত ২৯ মার্চ
পরবর্তী নিবন্ধপেকুয়ায় দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ল ৬ দোকান ও দুই বসতঘর