‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে/ জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তাঁর কাঁদে/ ছেলেটি মরে গেছে’ –পপগুরু আজম খানের একটি বিখ্যাত গানের চরণ। যেখানে জীবন–যাপনের মান নিম্নমুখী সেখানে মানুষ বস্তিতে বাস করে। পরাহত। বাংলাদেশের বস্তিগুলোতে নেই কোনো নিয়ম–শৃঙ্খলা। অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে বস্তি। বস্তির ঘরগুলো টিনশেড, রাস্তা সরু ও স্যাঁতস্যাঁতে। কিন্তু খাড়া বস্তি কি রকম। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের হিলব্রো এলাকার পন্টে টাওয়ারকে আফ্রিকার প্রথম খাড়া বস্তি বলা হতো। ডেলালান জে নামের এক সংস্থা ঐ টাওয়ারের ‘কুখ্যাত’ ইমেজ বদলানোর চেষ্টা করছে। হলিউডের কয়েকটি মুভিতে এটি দেখানো হয়েছে, যেমন রেসিডেন্ট এভিল ও চাপি। ১৯৭৫ সালে উদ্বোধন হওয়া ভবনটি দক্ষিণ আফ্রিকার ঐশ্বর্য্যের প্রতীক ছিল। কিন্তু পরে সেটি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
জোহানেসবার্গের কিছু তরুণ কুখ্যাত ঐ টাওয়ার সংস্কার করে সেটিকে এখন সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণে পরিণত করেছেন। ২৪ বছর বয়েসী গ্রান্ট কোবো সংস্কার কাজের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। ডেলালান জে নামে এক পর্যটন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কোবো বলেন, এখানে প্রায় আট হাজার মানুষ বাস করতেন। তারা সব ময়লা ভবনের মাঝখানের জায়গাটায় ফেলতেন। একসময় প্রায় ১৪ তলা পর্যন্ত ময়লা জমে গিয়েছিল। পরে জায়গাটা পরিষ্কার করা হয়েছে, তাই দেখতে আগের মতো নেই। সে কারণে এখন আমরা আপনাদের টাওয়ারের ভেতরে এনে দেখাতে পারছি, ভেতরটা কত সুন্দর।
জুলু ভাষায় ‘ডেলালান জে’র মানে হচ্ছে ‘জাস্ট প্লে’। ডেলালান জে পর্যটন কোম্পানির চেয়েও বেশি কিছু। টাওয়ারের নীচ তলায় বাচ্চাদের জন্য জায়গাও আছে। কোবো বলেন, এখানে আসতে তাদের কোনো টাকা দিতে হয় না। আপনারা যারা টাকা খরচ করে ঘুরতে এসেছেন সেই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের কিছু স্বেচ্ছাসেবী আছেন যারা বাচ্চাদের বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করেন।
ডিআর কঙ্গোতে জন্ম নেয়া তরুণ গাইড আলভারো শিকাপা হিলব্রো এলাকায় বড় হয়েছেন। ডেলালান জে তাকে শহরের রাস্তার বিভিন্ন সমস্যা থেকে নিরাপদে থাকতে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমি যেরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম এখনকার বাচ্চারাও তেমন সমস্যায় আছে। এখন আমি এমন ট্যুর করাতে পেরে কমিউনিটিতে কিছু ফিরিয়ে দিতে পারছি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদেরও এমন সুযোগ দেয়া হয়েছিল। স্থপতি রডনি গ্রোসকপফ এই ভবনের নকশা করেছিলেন। সেখানে ৪০০–র বেশি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। আর নীচতলায় ছিল বাজার। ৫০ বছর আগে এমন নকশার কথা সচরাচর শোনা যেত না।
তার কন্যা ব্রিগেট গ্রোসকপফ এখনও তার বাবা যখন নকশা করছিলেন, সেই সময়কার কথা মনে করতে পারেন। তিনি বলেন, আসলে এটাকে সবচেয়ে ফ্যাশনেবল বাসভবন হিসেবে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল। সবগুলো অ্যাপার্টমেন্ট আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ছিল। ছোটবেলায় এখানে আসার কথা আমি মনে করতে পারি। দেয়ালজুড়ে কার্পেট ওপরে উঠে গেছে। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জিনিস এটা। এখন এই ভবনে পুরো আফ্রিকা থেকে আসা মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা বাস করেন। পন্টে টাওয়ার ধীরে ধীরে তার সহিংসতা ও দুর্বৃত্ততার ছবি মুছে ফেলে অনেকের আশার আলো হয়ে উঠছে।
কোবো বলেন, ডেলালান জের উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দেখিয়ে টাকা কামানো নয়, বরং তারা আফ্রিকার তরুণদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় দারুণ সব সুযোগ তৈরি করছেন। তিনি বলেন, আমি এই এলাকায় বড় হয়েছি। ডেলালান জের সব গাইডও তাই। সেজন্য এটাকে আমরা পর্যটন হিসাবে দেখি না, বরং আমরা মানুষজনকে আমাদের এলাকা দেখাচ্ছি– বিষয়টা এভাবে দেখি।