টরন্টোতে চিটাগাং অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা ইনক আয়োজিত মেজবান ২০২৫ ছিল যেন প্রবাসের মাটিতে চট্টগ্রামের পুনর্জাগরণ। প্রবাসীদের হৃদয়ে জমে থাকা শেকড়ের টান, মাটির গন্ধ ও ঐতিহ্যের অহংকার যেন একদিনে ফিরে এলো রঙে, গন্ধে, স্বাদে ও আবেগে।
বাইরে বরফ পড়ছে, ঠান্ডা বাতাসে কাঁপছে শহর, অথচ হলের ভেতর ছিল এক অন্য পৃথিবী—উষ্ণতা, মমতা, ভালোবাসা আর উদযাপনে ভরা। শীতের রুক্ষ বৃষ্টি নয়, ঝরে পড়ছিল সাদা বরফের তুলো। রাস্তা ছিল কুয়াশায় ঢাকা, বাতাস ছিল ধারালো ছুরির মতো ঠান্ডা। ৩০ নভেম্বর ২০২৫—রবিবার।
এমন দিনে ঘর থেকে বের হওয়াই কষ্টকর। কিন্তু সেই দিনটিতে এক অদৃশ্য শক্তি মানুষকে টেনে নিয়ে গেছে এক ঠিকানার দিকে—Chinese Cultural Centre of Greater Toronto—যেখানে সেদিন কানাডার বরফের ভেতর উষ্ণ আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি উৎসব।
বেলা গড়িয়ে দুপুর নামতেই অতিথিদের ঢল নামে। পরিবার, বন্ধু, শিশু, প্রবীণ—সবার মুখে ছিল হাসি আর আবেগ। প্রবাসজীবনের ক্লান্তি যেন সেদিন পাঁচ ঘণ্টার জন্য ভুলে গিয়েছিল সবাই। ৩,০০০-এরও বেশি চট্টগ্রামি এবং বাংলাদেশি অতিথির উপস্থিতি প্রমাণ করল—চাটগাঁর টান ভাষায়, খাবারে, স্মৃতিতে ও হৃদয়ে অটুট। লাইনে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে কেউ বলছে—“বদ্দা অনে খঅন্ডে?” আরেকজন ফোনে বলছে—“পরিবার নিয়া আইছি, লাইনে আছি।”—এই হাসি, কথোপকথন, ভাষার মিষ্টতা যেন চট্টগ্রামের অলিতে-গলিতে ভেসে যাওয়া সুর হয়ে ফিরে এলো। দুপুর ১২টা বাজতেই দরজা খুলল। চোখে পড়ে লম্বা লম্বা সারি।
ভিজে রাস্তা, জমে থাকা বরফ, কড়া ঠান্ডা—কিছুই থামাতে পারেনি মানুষের ঢল। শিশুরা হাত ধরে টেনে এনেছে বাবা-মাকে, তরুণরা দলের পর দল হেসে হেসে ঢুকছে, প্রবীণরা ধীর পায়ে কিন্তু উজ্জ্বল চোখে বলছেন—“মেজবান, বাদ যাইযুম কেনে?” মনে হচ্ছিল এই ঠান্ডা শহরে যেন একদিনের জন্য বসন্ত নেমে এসেছে—হাসি, গল্প, আলাপ, পরিচয়ের গলিঘুঁজি জেগে উঠেছে প্রাণে।
হল ছিল সাজানো চট্টগ্রামী ঐতিহ্যের রঙে। ব্যানার, সজ্জা, আলো, মানুষের আনাগোনা—মনে হচ্ছিল টরন্টো নয়, আমরা যেন চাটগাঁর সাগরপাড়ের কোনো মহৎ উৎসবে। সংগঠক, স্বেচ্ছাসেবক, কমিটির সদস্যরা সকাল থেকেই কেবল একটি লক্ষ্য নিয়ে ছুটেছেন—প্রতিটি অতিথি যেন হাসিমুখে ফিরে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে অতিথিদের স্বাগত জানানো, খাবারের ধারা বজায় রাখা, প্রবেশ-নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা—সবকিছু তারা করেছেন অবিরাম হাসি ও দায়িত্ববোধ নিয়ে। যত এগোনো যায়, ভেতর থেকে তীব্র মাংসের মেজবানি ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। সেই গন্ধ যেন চাটগাঁর বাড়ির উঠোনে চলে গেলো মানুষকে অচেতন ভাবেই। সাজসজ্জা ছিল চাটগাঁর রঙে—লাল-কালো ব্যানার, ঐতিহ্যবাহী স্টিকার, সংস্কৃতির প্রতীক, বড় বড় অক্ষরে লেখা মেজবান ২০২৫—মনে হচ্ছে যেন সাগরপাড়ের মেলা এসে বাসা বাঁধল টরন্টোর বুকে।
হলে প্রবেশ করতেই বেজে ওঠে চিরচেনা কণ্ঠ— “বদ্দা আইছছো না? খঅন্ডে?” এই এক বাক্যে জমে থাকা বরফ ভেঙে যায়, প্রবাসের দীর্ঘ একাকীত্ব এবং ক্লান্তি গলে যায়। কে কোথা থেকে এসেছে তা আর mattered করছিল না। সবাই এক হয়ে গেল—চাটগাঁইয়া পরিচয়ে।
প্রায় তিন হাজার মানুষের ভিড়। চোখে বিস্ময়—কেউ ছবি তুলছে, কেউ ফেসবুক লাইভ করছে, কেউ দূরদেশে থাকা আত্মীয়কে কল দিয়ে বলছে “দেখো, ক্যানাডার মেজবান দেখতাসো?” শিশুদের দৌড়ঝাঁপ, মায়েদের ব্যাগে বাচ্চার খাবার, বাবাদের হাতে গরম কফির কাপ—সব মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য। কেউ কাউকে ঠেলে দেয়নি, কেউ তাড়াহুড়া করেনি—সবাই বরং অপেক্ষার ফাঁকে গল্প করছে, পরিচিতি খুঁজছে, হেসে উঠে বলছে “আপনে কোথায় চাটগাঁ? কাজির দেউড়ি? চৌমুহনী? চকবাজার?”
সময়ের প্রবাহ নিঃশব্দে গলতে থাকে। ভেতরে তখন খাবারের এক অনন্ত সম্ভার সাজানো। বিশাল টেবিলজুড়ে বাসমতি চালের সাদা ভাত, পাশে ফুটন্ত রসে ভাজা লালচে রঙের মেজবানি বীফ, আরেক পাশে ডাল-মাংসের স্বাদে তুলতুলে গ্রেভি—যা এক চামচ ভাতে মাখালে মনে হয় দুনিয়ার সেরা খাবার। পাশে টাটকা গার্ডেন স্যালাড, ঠান্ডা পানি ও সফট ড্রিংকস, আর শেষে গরম গরম সুগন্ধি চালের পায়েস—যা মুখে দেওয়া মাত্রই শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তারপর চাটগাঁর অতিথিপরায়ণতার শেষ রীতি—এক খিলি মিষ্টি পান সাথে পান মশলা, মিষ্টি ঠোঁটে লেগে থাকে দীর্ঘক্ষণ।
আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত ছিল— ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের বা যাদের গরুর মাংস খাওয়া পছন্দ নয়, বা যারা ছাগলের মাংস ভালোবাসেন তাদের প্রতি সম্মান রেখে আলাদা আয়োজন ছিল। ওদের জন্য ছিল সুগন্ধে ভরা নরম ছাগলের মাংসের কারি, পাশে ছাগলের মাংসের ডাল—যা খেতে খেতে অনেকে বললেন, “এ খাবারের স্বাদ যেন শৈশবের ঈদের দুপুর!” যেন মা রান্না করেছেন, ঘরে বসে খাচ্ছি—এমন অনুভূতিতে ভিজে গিয়েছিল অনেকের চোখ। শুধু খাবার নয়—তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে ছিল স্বতন্ত্র সার্ভিং স্টেশন, আলাদা বসার স্থান, যাতে কেউ অস্বস্তিতে না থাকেন, বরং ভালোবাসা আর সম্মানের উষ্ণতায় উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। সেদিন অনেকেই হাত রাখলেন আমাদের হাতে, বললেন—“আপনারা শুধু মেজবান করেননি, মানুষের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন—এটাই আসল আতিথেয়তা।” এই প্রশংসা, এই কৃতজ্ঞতার শব্দ—দিনের শেষে আমাদের হৃদয় ভরে দিয়েছে পরম শান্তিতে।
খাবার ছিল অসীম—যে যতবার খেতে চায়। এ যেন শুধু আহার নয়—সম্মানের প্রতীক, সম্ভ্রমের ঘোষণা। চাটগাঁর মেজবানি মানেই অতিথি আপ্যায়নের রাজকীয়তা; সেই রাজকীয়তা প্রবাসেও অমোঘ উজ্জ্বল।
আয়োজকরা তখন ছুটছেন হলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে—কারো প্লেটে ভাত কমে গেছে, কেউ মাংস আরেক চামচ চাচ্ছেন, কোথাও সারি বেড়ে গেছে—স্বেচ্ছাসেবকেরা হাসিমুখে বলছেন, “অনেক খানা আছে, লগে লগে পাইবেন, আফসোস নাই, ন খাই যাইবেন না কেউ।” এই হাসি, এই যত্ন—অতিথিরা বলছিলেন, “দেশে না ফিরেও আজ যেন দেশে আছি।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টরন্টোর মেয়রের প্রতিনিধি, কাউন্সিলরগণ, Scarborough–South East এর MPP, ফেডারেল এমপি এবং প্রবাসী কমিউনিটির নামী-দামি ব্যক্তিত্ব। মঞ্চে তাঁদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল গর্ব—চট্টগ্রাম সংস্কৃতি শুধু বেঁচে নেই, বরং প্রবাসে আরও দুর্দান্তভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
বিকেল গড়িয়ে ৫টা এলেও মানুষের মন যায়নি। কেউ বিদায় নিচ্ছেন ধীরে ধীরে, আলিঙ্গন করছেন পুরনো বন্ধু, কেউ বলছেন—“ইনশাআল্লাহ পরেরবার আরেকটা বড় আয়োজন হবে।” কামরায় এখনো ধরে আছে মাংসের ধোঁয়া, মানুষের চিৎকার, শিশুর হাসি। যেন চলে না গিয়েও দিনটি বুকের ভেতরে থেকে গেলো। একজন স্বেচ্ছাসেবক পরে লিখলেন, “আমি সেদিন ছবি তুলতে পারিনি— কিন্তু আমার হৃদয়ে হাজার ছবি জমা আছে।” এই বাক্যই হয়তো ব্যক্ত করে সেই দিনের অনুভূতি। শরীর ভেঙে পড়েছিল অনেকের, ক্লান্তি চোখে-মুখে, তবুও মনে ছিল শান্তি— কারণ অতিথিরা খুশি, মানুষ বলেছে “এটাই সেরা মেজবান,” আর তারাই এই অনুষ্ঠানের সত্যিকারের পুরস্কার।
মেজবান ২০২৫ ছিল না কেবল একটি অনুষ্ঠান—এটি ছিল প্রবাসে চট্টগ্রামের প্রাণের উৎসব, স্মৃতির পুনর্জন্ম, মাটির প্রতি প্রেমের উৎসর্গ। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও আমরা ভুলিনি আমাদের পরিচয়। আমরা অনুভব করেছি— গায়ের রং, ভাষার টান, খাবারের স্বাদ— আমাদের শেকড় আমাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম আমাদের আবেগ, মেজবান আমাদের অহংকার।
এই ঐতিহ্য যেন শুধু ইতিহাস না হয়ে ওঠে— প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে যাক আলোর প্রদীপ হয়ে। টরন্টোর আকাশে সেই দিন যে মায়া ভেসেছিল— তা চিরদিন ভাসুক আমাদের স্মৃতিতে।
চিটাগাং অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা ইনক কৃতজ্ঞতা জানায় সব অতিথি, সংগঠক, স্বেচ্ছাসেবক ও মমতায় ভরা মানুষদের। আপনাদের উপস্থিতিই প্রমাণ— চট্টগ্রাম শুধু ভূগোল নয়, চট্টগ্রাম একটি অনুভব।
চট্টগ্রাম আমাদের আত্মা। মেজবান আমাদের ভালোবাসা। এই ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক—হৃদয়ে, প্রবাসে, ইতিহাসে।
আবার ফিরবো আরও বড় আয়োজন নিয়ে—আরও হাসি, আরও মিলন, আরও মেজবানি নিয়ে। এ ভালোবাসা বেঁচে থাকুক—মেজবান ফিরে আসুক আবারও, আরও জাঁকজমক রুপ নিয়ে। প্রবাসেও আমরা এক, আমরা চাটগাঁইয়া, আমরা মেজবানের উত্তরাধিকারী।












