কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্প ঝুলে গেছে। দফায় দফায় বৈঠক ও আলোচনা হলেও সৃষ্ট সংকটের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। নদীর উপর সেতুর উচ্চতা নিয়ে দেখা দেয়া জটিলতায় এই সেতু নির্মাণ আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সেতুর অর্থ সংস্থান থেকে প্রায় সবকিছু গুছিয়ে আনা হলেও বিআইডব্লিউটিএর আপত্তির মুখে বহুল প্রত্যাশার এই সেতুর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নেভিগেশন চ্যানেল ঠিকঠাক রাখার জন্য বিআইডব্লিউটিএ সেতুর যেই উচ্চতা রাখার প্রস্তাব দিয়েছে তাতে কালুরঘাটে স্বপ্নের সেতু অধরা থেকে যাবে বলে আশংকা সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সেনা চলাচলের জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণের তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে ব্রুনিক এন্ড কোম্পানির ব্রিজ কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স–হাওড়া নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেতুটি নির্মাণ করে। শুধুমাত্র ট্রেন চলাচলের জন্য ৬৩৮ দশমিক ৫ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এই সেতু নির্মাণে নদীতে ছয়টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টিল পিলার, দুটি এ্যাবটমেন্ট ও ১৯টি স্প্যান দেয়া হয়। ১৯৩০ সালের ৪ জুন সেতুটি উদ্বোধন করা হয়। এটি মূলত রেলসেতু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্যদের ব্যবহৃত মোটরযান ও যুদ্ধযান চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে এসে সেতুটিতে সব ধরনের যান চলাচল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। দীর্ঘদিনের ব্যবহারের পর ২০০১ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। তারপরেও একাধিকবার সংস্কারের মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়ে গত ১৯ বছর ধরে সেতুটিতে ট্রেন ও যান চলাচল করছে। এছাড়া একমুখী যান চলাচল করায় সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রতিদিন। রেল কাম সড়কসেতু হওয়া রেল চলাচলের সময়ও সেতুটি পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হয়। এতে বোয়ালখালী শহরের কাছের উপজেলা হলেও এখানকার মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিগন্যালে আটকা পড়ে থাকতে হয়।
অবশেষে বোয়ালখালীসহ বিস্তৃত এলাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাট কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে। প্রকল্পটি যাচাই–বাছাই শেষে কয়েক দফা পুনর্গঠন করা হয়। উপস্থাপনগত ত্রুটির কারণে প্রকল্পটি একনেক থেকেও ফেরত পাঠানো হয়। পরবর্তীতে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এই সেতুর একটি চূড়ান্ত ডিজাইন দাঁড় করানো হয়। ঢাকা–চট্টগ্রাম–কঙবাজার রেল প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে কালুরঘাটে অবস্থিত পুরনো রেল সেতুর পাশে নতুন ‘রেলওয়ে কাম রোড সেতু’ নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করা হয়। এই ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত দ্যা ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) এর সাথে রেলওয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শূন্য দশমিক ৭২ কিলোমিটার লম্বা সেতুটির উপর দুটি রেলসড়ক দিয়ে ডিজাইন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কোরিয়ার অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের আপত্তির কারণে একটি রেল সড়ক অন্তর্ভুক্ত করে নতুন ডিজাইন তৈরি করা হয়। প্রস্তাবিত নকশায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেতুর উচ্চতা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৬২ মিটার বা প্রায় ২৫ ফুট। কিন্তু এই উচ্চতার ব্যাপারে আপত্তি জানায় বিআইডব্লিউটিএ। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেতুর যেই উচ্চতার কথা বলা হয়েছে তাতে নেভিগেশন চ্যানেল হুমকির মুখে পড়বে। সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার বা ৪০ ফুট করার শর্ত দেয় বিআইডব্লিউটিএ। এই আপত্তিতেই মহাসংকটে পড়ে কালুরঘাট সেতু।
রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, বিষয়টি নিয়ে প্রকল্পের অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত দ্যা ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে বলা হয়। ইতোমধ্যে রেলওয়ে থেকে বিআইডব্লিউটিএর সাথে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। তাদেরকে সেতুর উচ্চতা কমিয়ে নির্ধারণ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ কোনো ভাবেই উচ্চতা কমাতে রাজি হচ্ছে না। এতে করে সেতুটির ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, বর্তমানে কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা ৪ দশমিক ২ মিটার। এটিকে যদি আরো আট মিটার বা ২৫ ফুটের মতো উচু করা হয় তাহলে সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। কারণ হুট করে রেললাইন উঁচু করে ফেলা যায় না। বেশ দূর থেকে ক্রমান্বয়ে উচু করতে হয়। আবার একইভাবে বেশ দূরে গিয়ে স্ল্যাভ মিলাতে হয়। প্রস্তাবিত কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা যদি ৪০ ফুট করতে হয় সেক্ষেত্রে জান আলী হাট এবং গুমদন্ডি রেলওয়ে স্টেশনকে বহু উঁচু করতে হবে। যা অনেক কঠিন এবং ব্যয়বহুল কাজ। এই অবস্থায় সেতু নির্মাণের পুরো প্রকল্পটি নতুন করে ডিজাইন করাসহ অনেক কিছু পাল্টে ফেলতে হবে। যা সম্ভব হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিআইডব্লিউটিএ সেতুর উচ্চতা নিয়ে অহেতুক জটিলতা করছে। নদীর ওই অংশটিতে তেমন কোনো জাহাজ চলাচল নেই। নেভিগেশন চ্যানেল রক্ষার নামে এই ধরনের জটিলতা তৈরি পুরো প্রকল্পটিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। কমিটি সরজমিনে বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। আমরা বিআইডব্লিউটিএর সাথে বৈঠক করেছি। আলাপ আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু উনারা নেভিগেশন চ্যানেল ১২.২ মিটার ক্লিয়ার চাচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আরো বৈঠক করব। আলাপ আলোচনা করব। একটি সুষ্ঠু এবং সুন্দর সমাধানে আসতে পারব। সেতুর উচ্চতা একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তবে সেতুর উচ্চতা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজে কোনো অগ্রগতি হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা চট্টগ্রামের স্বার্থেই সেতুর উচ্চতা ১২.২ মিটার করার প্রস্তাব দিয়েছি। চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঝড়ের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য কর্ণফুলীর জাহাজগুলোকে কালুরঘাট সেতু পার হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ওই দুঃসময় জাহাজ পারাপারে সেতুটি যাতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে সেজন্য আমরা সেতুর উচ্চতা বাড়াতে প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি বর্তমান কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর উচ্চতা ১৮ দশমিক ৩ মিটার বা ৬০ ফুট উল্লেখ করে বলেন, আমরা তৃতীয় সেতুটির উচ্চতা ১২.২ মিটার করতে বলেছি। এটি স্রেফ জাহাজ চলাচল নিরাপদ রাখার জন্য। বিআইডব্লিউটিএর এই শর্তের কারণে পুরো প্রকল্পটি ঝুলে যাওয়া প্রসঙ্গে শীর্ষ এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা যদি বিষয়টি না বলি পরবর্তীতে বিপদের সময় আমাদেরকে দোষারোপ করা হবে। তিনি চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বন্দর এবং জাহাজ চলাচলের স্বার্থে সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপোষ করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন।
বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা করব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু ঝড় হয়েছে। কিন্তু কালুরঘাট ব্রিজ পার হয়ে কোনো জাহাজ অবস্থান নিয়েছে বলে শোনা যায়নি। ভবিষ্যতেও কোনো জাহাজকে সেতু পার হয়ে যেতে হবে কিনা তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হবে। বিষয়টি নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছুই উল্লেখ করে ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা বলেন, অচিরেই আমরা সুন্দর একটি সমাধানে পৌঁছতে পারব।