এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতের বিস্তৃতি বেড়েছে বহুগুণ। ব্যাংকগুলোর আমানতের হিসাব সংখ্যায় বেড়েছে ১৫৬ শতাংশ। নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রায় সাত কোটি ব্যাংক হিসাব। আর ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩৪৮ শতাংশ। বিপরীতে হতাশাজনক চিত্র কেবল ব্যাংক ঋণ গ্রহীতার প্রবৃদ্ধিতে। গত এক দশকে ব্যাংক ঋণ গ্রহীতার হিসাব সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পরিসংখ্যানই বলছে সম্পদের মতোই দেশের ব্যাংকঋণ ও অল্প কিছু মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক ঋণের এবৈষম্য প্রকট করে তুলেছে ধনী দরিদ্রের সম্পদের ব্যবধান। একই সঙ্গে সম্প্রসারণের তুলনায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে দেশের ব্যাংকিংখাত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকার বিপুল বিনিয়োগ করলেও তার সুফল মিলছে না নতুন উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়ায়। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি এ খবরটি প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ব্যাংকখাতের হাত ধরেই। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের অর্থকরী মূলধন যুগিয়ে প্রতিষ্ঠান বড় করতে সহায়তা যুগিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা সৃষ্টির চেয়ে করপোরেটদের ব্যবসা সম্প্রসারণ বা উৎপাদন চালিয়ে নিতে অর্থায়নে বেশি আগ্রহী বলে তথ্য-উপাত্ত বলছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে সহায়ক অর্থায়নে তাদের আগ্রহ খুবই কম। এর জন্য অবশ্য ঋণের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা ও ব্যয়ের কথা বলছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। এমনকি নতুন একাধিক ব্যাংক বাজারে এলেও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অথচ পাশের দেশ ভারতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সহায়তা বা উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে একাধিক ব্যাংক তৈরি এবং তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দেয়ার জন্য স্বতন্ত্র কোন বেসরকারি ব্যাংকই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকার পরও বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে ততটা উৎসাহী নয়। কেন উৎসাহী নয় তা খতিয়ে দেখা দরকার। উন্নত দেশগুলোতে পুঁজি সংগ্রহের জন্য শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ক্ষুদ্র সম্প্রসারণ ও উদ্যোগকে অর্থায়ন করে। তবে ব্যাংক এগিয়ে আসছে না। উল্লিখিত প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে গত এক দশকে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৩৪৮ শতাংশের বিপরীতে গ্রহীতা বেড়েছে মাত্র ২১ শতাংশ। অর্থাৎ পুরনোদের মধ্যেই ঋণ বন্টিত হচ্ছে বেশি। দেশের ব্যাংক ঋণ বর্তমানে কিছু শিল্পগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। এতে সমাজে সম্পদের বৈষম্য তীব্রতর হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জোরালো ভূমিকাই দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণ বৈষম্য দূর করতে পারে।
ব্যাংক খাতের মোট ঋণের বড় একটি অংশ দেশের বড় বড় কয়েকটি শিল্পগ্রুপের কাছে রয়েছে। ফলে নতুন শিল্পোদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আবার এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান কোনো কারণে ক্ষতির মুখে পড়লে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার শঙ্কা বাড়বে। ব্যাংকের ঋণ বড় করপোরেটের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ঝুঁকিও বাড়ছে।
ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমাতে একই খাতে যেন ঋণ কেন্দ্রীভূত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। এখানকার ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ উচ্চমাত্রায় রয়েছে। এটি কমিয়ে আনতে হবে। সব ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করে দক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাংক পরিচালনা করা জরুরি। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া আবশ্যক। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ভালো উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণের সুফল পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই উদ্যোগ নিতে হবে। তবে ব্যাংকঋণের সুফল প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলার বিষয়ে শর্তারোপ করেছে। ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো শাখা খুলত। এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী এখন শহরে একটি শাখার বিপরীতে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রামে একটি শাখা খুলতে হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম মেনে শাখা খুললেও ব্যাংকগুলো লাভজনক এলাকার বাইরে যাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক রাজধানীর আশেপাশের ইউনিয়নগুলোতে শাখা খুলে অনুপাত ঠিক রাখছে।ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশনার পরও ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান। ফলে ঢাকায় প্রতিনিয়ত লোকসংখ্যা বাড়ছে। পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা না থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে নাগরিক বিশৃঙ্খলা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। আমাদের ব্যাংকগুলোর রীতি এমন হয়েছে যে আগে একটি ব্যাংক একজনকে ঋণ দিত। এখন সব ব্যাংক ওই একজনকেই ঋণ দেয়। আর নতুন কোন উদ্যোক্তা ঋণ নিতে গেলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। ফলে একদিকে যেমন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না, তেমনি অন্যদিকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে বেশি ঋণ থাকায় ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। অল্প কিছু এলাকায় ব্যাংকের ঋণ সীমাবদ্ধ রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি সম্ভব নয়। উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকগুলো সব সময় বড় ভূমিকা রাখে। যদিও এতে ঝুঁকিও বেশি থাকে। তবে এখন দেখা যাচ্ছে বড় কর্পোরেটদের ঋণ দিয়েই ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকগুলো। এসএমই ঋণে ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা তহবিল গঠন করে দিলেও তেমন সুফল মিলছে না। নানা অলিখিত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এ ঋণ পাওয়ায়। ব্যাংকগুলোও অসহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।