ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ঘেঁষে ৪-৫ তলা বিল্ডিং

মতিঝর্ণায় আড়াইশ পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রেলওয়ের উচ্ছেদ পরিকল্পনা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২২ মে, ২০২২ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বর্ষা আসন্ন। প্রতি বছর এ মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। তাই বর্ষা এলে চট্টগ্রামের প্রশাসনসহ স্থানীয় বসবাসকারী এবং নানান শ্রেণী-পেশার মানুষের পাহাড় ধস নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। প্রতি বছর নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বসবাস করছেন।

পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। এরমধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে ৫৩১ পরিবার ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪।

কিন্তু স্থানীয় কাউন্সিলরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুধুমাত্র নগরীর মতিঝর্ণা, টাংকির পাহাড়-বাটালি হিল-টাইগারপাস হয়ে এসব এলাকায় ১ লাখের উপরে লোক বসবাস করে।

গতকাল সরেজমিনে মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ঘেঁষে বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। আবার অনেকগুলো পাহাড়ের উঁচু-ঢালু জায়গায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ৪-৫ তলা বিল্ডিং পর্যন্ত উঠে গেছে। একেকটি বিল্ডিংয়ে চরম ঝুঁকির নিয়ে ১০ থেকে ১৫ পরিবার বসবাস করছে। অনেকগুলো বিল্ডিংয়ের উপরে টিনের ছাউনি দিয়েও বাসা তৈরি করে ভাড়া দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী বাড়ছে।

অন্যদিকে প্রশাসন বলছে, সিদ্ধাস্ত বাস্তবায়নে পাহাড় মালিকদের উদাসীনতা, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নেওয়া ও পুনর্বাসনে সফলতা আসছে না।

গতকাল মতিঝর্ণার পাহাড়ি এলাকায় বস্তিতে বসবাসকারী রিকশচালক আবদুল মতিন ও ভ্যানচালক রফিকসহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দা জানান, তারা ভূমিহীন। তাদের যাওয়ার মতো স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। আর নগরীর সাধারণ বাসা ভাড়ার তুলনায় এখানে বাসা ভাড়া অনেক কম। তাই বাধ্য হয়ে ও জেনেশুনেই তারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসন বিভিন্ন সময় তাদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি কখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

খবর নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ের মালিক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতার সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু মহল পাহাড়গুলো দখল করে সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুব উল করিম আজাদীকে জানান, লালখান বাজার মতির্ঝণা পাহাড়টি মোট ২৬ একর। এরমধ্যে আমাদের রেলওয়ের ১৮ একর। অবশিষ্ট ৮ একর সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ বিভাগের। কিছু অংশ জেলা প্রশাসনের ১ নং খাস খতিয়ান ভুক্ত। এখানে যুগ যুগ ধরে অবৈধ দখলদাররা বসবাস করে আসছে। অনেকে ৫-৬ তলা বিল্ডিংও করেছে। আমরা সরারাচর যেভাবে উচ্ছেদগুলো করি মতির্র্ঝণায় কিন্তু সেভাবে উচ্ছেদ করা যাবে না। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মতিঝর্ণা উচ্ছেদের জন্য আমরা এক সপ্তাহের কর্মসূচি নিয়েছিলাম। সবার সহযোগিতা চেয়েছিলাম। তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য ডিও লেটার দিয়েছিলেন উচ্ছেদ না করার জন্য। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটারটি রেল ভবনে পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তীতে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। তখন মতিঝর্ণার ৫ হাজার অবৈধ বসবাসকারী জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছিলেন উচ্ছেদ না করার জন্য। এখন আবার আমরা মতিঝর্ণাসহ আরো কিছু এলাকায় উচ্ছেদের পরিকল্পনা নিয়েছি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় লালখান বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল আজাদীকে বলেন, নগরীর মতিঝর্ণা, টাংকির পাহাড়-বাটালি হিল-টাইগারপাস হয়ে এসব এলাকায় ১ লাখের উপরে লোক বসবাস করে। এখানে ২০ হাজার ভোটার আছে। শুধুমাত্র মতিঝর্ণা এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে এমন আড়াইশ পরিবার রয়েছে। এসব পাহাড়ে যারা বসবাস করছে তারা নিজেরা-নিজেরাই ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা বর্ষা এলে পাহাড় কেটে দেয়, যাতে মাটি নিচে পড়ে তার বাসবাসের এলাকাটি খোলামেলা-বড় হয়ে যায়।

তিনি বলেন, এখানে যারা বসবাস করছে-অনেকেই বিল্ডিং করেছে, আসলে তাদেরকে এভাবে উচ্ছেদ করা যাবে না। এরা ৮০ থেকে ৯০ বছর ধরে বসবাস করছে। পাহাড়ে বসবাসকারীদের অনেকেই ভূমিহীন-অসহায়। এরা যাবে কোথায়! এখানে ৮-১০ একর জমি আছে। পরিকল্পিতভাবে দুই একরের উপর যদি তাদেরকে বসবাসের ব্যবস্থা করা যেত-তাহলে অবশিষ্ট ৮ একর রক্ষা পেত। আমি অনেকবার বলেছি, পাহাড়গুলোর চারিদিকে যদি রিটেনিং ওয়াল করে দেয়া যায় তাহলে পাহাড়গুলো রক্ষা পেত। রিটেনিং ওয়াল দিয়ে পাহাড়গুলো সংরক্ষণ করা গেলে দখলমুক্ত করা সম্ভব হতো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধরিজার্ভ আবার ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল