‘এখানে পাহাড়ের ঢালে অথবা পাদদেশে খুবই বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। যে কোনো সময় ব্যাপক প্রাণহানিসহ মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই এক্ষুণি এই এলাকা দখলমুক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় আনা জরুরি’। নগরের লালখান বাজারের মতিঝর্ণা পাহাড়ের সম্ভাব্য ধস এবং ধসে প্রাণহানি এড়াতে এ সুপারিশটি করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন চট্টগ্রামের পৃথক সাতটি স্থানে পাহাড় ধসসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর গঠিত তদন্ত কমিটি এ সুপারিশ করে। তার অনেক বছর গত হলেও ওই সুপারিশটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে সুখের বিষয়, চট্টগ্রাম মহানগরীর মতিঝর্ণা–বাটালি হিল এলাকায় গত ১৪ মে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি বসতি থেকে ১০০ টির মতো পরিবারকে অপসারণ করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অভিযানে ছিলেন সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নেজারত ডেপুটি কালেক্টর মো: তৌহিদুল ইসলাম; বাকলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) জামিউল হিকমাহ এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত। চসিক ১৪ নং লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলালের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অপসারণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জানা যায়, অভিযানকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে বসবাসকারী আরো ৫০–৬০ টির মতো ঘর চিহ্নিত করা হয়েছে। এসকল ঘর ফাঁকা করতে কাউন্সিলরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এদিকে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) জামিউল হিকমাহ জানান যে, মতিঝর্ণা–বাটালি হিল এলাকায় এনজিও জাগো ফাউন্ডেশন পাহাড় কেটে স্কুল বানিয়েছে। এটি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে মামলা চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীর পাহাড়গুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী মানুষগুলোকে সরিয়ে নেয়া হলে শুধু জীবন নয়, একই সাথে পাহাড়ও রক্ষা পাবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বর্ষায় ভারী বর্ষণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সাধারণত পাহাড় ধসে মানুষ মারা যাওয়ার পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। পরে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের পরিস্থিতি একই থাকে।
তবে এবার প্রশংসার বিষয় যে, পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনার আগেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তৎপর হয়েছেন। তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি বসতি থেকে ১০০ টির মতো পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে নগরীতে ৬৫টির মতো পাহাড় রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্যে ২৮টি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ। ২৮টির মধ্যে ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করে ৮৩৫ পরিবার। এই ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ৭ পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। এর বাইরে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে এবং ঢালুতে ঘর তৈরি করে অবৈধভাবে বসবাস করে নিম্নআয়ের মানুষ। নগরীতে সব মিলিয়ে ২০ হাজার মানুষ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে।
জানা যায়, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা মানুষগুলো তাদের ঘরের মালিক নয়। স্বল্প ভাড়ায় তারা সেখানে বসবাসের সুযোগ পায়। পাহাড়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলা প্রতিটি বস্তি কোনো না কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা নিয়মিত ভাড়া আদায় করে। এই চক্রটির কারণে প্রশাসন চেষ্টা করেও পাহাড়ে বসতি বন্ধ করতে পারছে না।
আসলে চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনায় ঘটে প্রাণহানি। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। তাদের সরানো হয় শুধু বর্ষা মৌসুমে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি স্থায়ী কোনও সমাধান না হয় তাহলে প্রাণহানি আরও বাড়বে। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরিকল্পিত নগরীতে পরিকল্পনা ছাড়া কাজের বরকত নেই। যদি পরিকল্পনা থাকে, তাহলে এভাবে তাদের কোথাও স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া যেতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলো সরিয়ে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ করছি, তার কাজে গতি আনতে হবে। তাছাড়া, পাহাড় কেটে স্কুল বানানোর ঘটনার তদন্ত দরকার, যেটা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে মামলা চলছে।