মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তুমব্রু সীমান্তের ওপারে গোলা বর্ষণের ঘটনা থামছে না। তাই সীমান্তবাসীর শঙ্কাও কাটছে না। গোলা বর্ষণের বিকট শব্দে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল সোমবারও থেমে থেমে গোলা বর্ষণের শব্দ শোনা গেছে। ভোরে ও সন্ধ্যায় গোলা বর্ষণের শব্দ মারাত্মক হয়। সম্ভবত যুদ্ধবিমান থেকে তখন হামলা চালানো হয়। তবে গতকাল কোনো মর্টার শেলের গোলা এসে পড়েনি বাংলাদেশ সীমান্তে।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকা থেকে ৩শ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরাতে চায় সরকার। এজন্য বান্দরবান জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল সীমান্ত এলাকা এবং সম্ভাব্য চারটি অস্থায়ী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, গত শুক্রবার মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হতাহতের ঘটনার পর উখিয়া উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে। ইউএনও সেখানে নির্দেশ দিয়েছেন, সীমান্তের শূন্যরেখার ৩০০ থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে তালিকা তৈরি করার। ইতোমধ্যে জরিপ করে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। যদি সীমান্তে কোনো ধরনের বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে ঝুঁকিতে থাকা এসব পরিবারের লোকজনকে যাতে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানায়, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, রেজু ও আমতলী সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলছে। চলমান সংঘাতে মিয়ানমার বাহিনীর ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষেপ করা গোলা এসে পড়ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। সাম্প্রতিক সময়ে তিন দফায় মর্টার শেল এবং ভারী অস্ত্রের গুলি এসে পড়েছে ঘুমধুম সীমান্তে। ১৬ সেপ্টেম্বর এসে পড়া মর্টার শেল বিস্ফোরিত হয়ে শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫ জন। এছাড়া ওইদিন সকালে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মাইন বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি যুবকের পা উড়ে যায়। তারা জানান, তুমব্রু থেকে তুয়াইঙ্গা ঝিরি হয়ে মনজয় পর্যন্ত ১২ গ্রামের ৫শ পরিবার আতঙ্কে আছে।
সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে প্রতিনিধিদল : বর্তমান পরিস্থিতিতে তুমব্রু সীমান্তে বসবাসরত ৩শ পরিবারকে নিরাপদে সরাতে চাচ্ছে সরকার। সেই লক্ষ্যে গতকাল বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল তুমব্রু সীমান্ত এলাকা এবং অস্থায়ী ৪টি আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। কেন্দ্রগুলো হলো তুমব্রু, ভাজাবুনিয়া, বাইশফাঁড়ি ও গর্জনবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর আগে প্রতিনিধিদলটি বেলা ১১টায় ঘুমধুম পৌঁছে পার্শ্ববর্তী কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে যান। সেখানে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সরানো সাড়ে ৪শ পরীক্ষার্থীর খোঁজ নেন। পরে তুমব্রু শূন্যরেখায় বসবাসরতদের অবস্থান দেখেন। তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।
রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার দিল মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ আরেফ আহমদ জেলা প্রশাসকসহ প্রতিনিধিদলকে বলেন, শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দিতে ২০১৮ সালের ২ মার্চ তুমব্রু সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল মিয়ানমার জান্তা। তখন প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যেত। মাইকিং করে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হতো। নইলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দিত। সেই সময় বিজিবির তৎপরতায় সেনা সমাবেশ সরিয়ে নিলেও একাধিক চৌকি স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, পশ্চিম তুমব্রু থেকে বাইশফাঁড়ি পর্যন্ত সীমান্ত সড়কের মিয়ানমারের পাশে অবস্থানরত তিনশ পরিবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দুই দফা সভা হয়েছে। গতকাল সিদ্ধান্ত মোতাবেক জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। প্রাথমিকভাবে অতি ঝুঁকিপূর্ণ তিনশ পরিবারের প্রায় দেড় হাজার মানুষকে উত্তর ঘুমধুমের কচুবুনিয়াসহ আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরিয়ে নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শনের জন্য ঘুমধুম সীমান্তে এসেছি। এখানে বসবাসকারী মানুষগুলো খুবই সাহসী। অল্পতে ভয় পাবার মানুষ সীমান্তবাসীরা নয়। তারা যুগ যুগ ধরে সীমান্তের এমন কঠিন পরিস্থিতি দেখেই বেড়ে উঠেছেন। রীতিমত অস্থিতিশীল সীমান্ত পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েই বসবাস করে আসছেন। সীমান্তের বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলতেই তুমব্রু সীমান্তে আমাদের আগমন। স্থানীয় বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের সাথে কথা বলেছি, তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং শঙ্কার কথা শুনেছি। সীমান্ত পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। কিন্তু সীমান্তে বসবাসকারী মানুষগুলো সাহস হারাননি। প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি বিবোচনায় সীমান্ত ঘেঁষে বসবাসকারী ৩শ পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার একটা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ তাদের সরিয়ে নেয়া হবে তা এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, পরিস্থিতি বুঝে ক্রমান্বয়ে অন্যদেরকেও আশ্রয়ে নেয়ার চিন্তাভাবনা করা হবে।
পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতের মর্টার শেল এবং ভারী অস্ত্রের গুলি মাঝে মাঝে এসে পড়ছে ঘুমধুম সীমান্তে। বিষয়গুলো নিয়ে সীমান্তের মানুষজন শঙ্কিত। সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও আতঙ্কিত না হতে জনপ্রতিনিধিদের সাথে মিলে সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের আশ্বস্তের কাজ করছে পুলিশ। সীমান্তে জনসাধারণের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধির যৌথ সভায় সীমান্ত ঘেঁষে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়ার একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে সীমান্ত পরিদর্শনে এসেছে প্রতিনিধিদল। সীমান্তের সবার সাথে কথা বলেছে।
এ সময় ছিলেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সালমা ফেরদৌস, বান্দরবান জেলা পরিষদ সদস্য ক্যনুয়ান চাক, থানার অফিসার ইনচার্জ টানটু সাহা ও ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজসহ ইউপি সদস্যরা।