আজ ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৫ সালের ইরানের তেহরানে ইউনেসকোর উদ্যোগে ৮৯টি দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষামন্ত্রী ও পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আলোচনা করা হয় পৃথিবীর বর্তমান বিস্ময়কর সভ্যতা শিক্ষার অবদান। শিক্ষা উন্নয়নের পূর্বশর্ত শ্রেষ্ঠত্বের নিয়ামক। মানবসম্পদ উন্নয়নে এর কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক বিশ্বে সব আবিষ্কার ও উন্নয়নের মূূলমন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাহীন মানুষ আর পশুতে কোনো পার্থক্য নেই। যার শিক্ষা নেই বলা যায় তার কিছু নেই। সম্মেলনে বিশ্বের সাক্ষরতা পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবস্থা, শিক্ষা, শিক্ষাজীবন, জীবিকা ও বয়স্ক নিরক্ষরদের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। শিক্ষা ও জীবিকা পরস্পর অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত বলে উল্ল্লেখ করে নিরক্ষরতাকে উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে জোর প্রয়াস নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মানবসম্পদ উন্নয়নে অব্যাহত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশে দিবসটি সারা বিশ্বের মতো যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে আমাদের দেশেও পালিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে এখনো কাগজেপত্রে মাত্র ৭৮ শতাংশ সাক্ষর। এই মধ্যেও হয়তো গলদ রয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘আমাদের প্রকৃত সাক্ষর (সাক্ষরতার হার) ৫০ শতাংশেরও নিচে। যারা প্রকৃতপক্ষে সাক্ষর হয়ে উঠে না, তারা হাইস্কুলে পিছিয়ে থাকে। এবং তারা উচ্চশিক্ষায় কখনো ভালো করতে পারে না। প্রাথমিকের কাজ হলো, একটা মানুষকে সাক্ষর করে তোলা। আমাদের কথ্য ভাষা, লেখ্য ভাষা, গাণিতিক ভাষায় সাক্ষর করে তোলা। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ধরনের সম্পদ থাকে কিন্তু আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ জনসম্পদ। এই সম্পদকে যদি কাজে লাগাতে না পারি তাহলে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতি বছরই আমাদের দেশে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। সাধারণত প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করতেই ঝরে পড়ার সংখ্যা শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ে অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে যারা পাস করতে ব্যর্থ হন তাদের নামও রয়েছে ঝরে পড়ার তালিকায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির (এপিএসসি) বরাতে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে এক বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারে অবনতি হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালে যেখানে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ শতাংশের বেশি, সেটা ২০২৩ সালে নেমে আসে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশে। ২০২৪ সালে সেটা বেড়ে আবার ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার এই উল্টোযাত্রা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করা জরুরি। এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক শঙ্কা প্রকাশ করেছিল, এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদরিদ্র হবে। এর পেছনে সংস্থাটি ক্রমাগত প্রকৃত আয় কমে যাওয়া; দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্থরগতিকে দায়ী করেছিল। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সামপ্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, গত তিন বছরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দরিদ্রতা। এছাড়া কারণ হিসেবে রয়েছে অভিভাবকের অসচেতনতা, মেয়ে শিশুর প্রতি অবহেলা, বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বিশেষ করে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবারই দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে। অনেক পরিবারেই দেখা যায়, সন্তান একটু বড় হয়ে উঠলেই তাকে উপার্জনে পাঠান অভিভাবকরা। ফলে অনেকেই পড়ালেখা না করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে একরকম বাধ্য হয়েই। এ কারণেই কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থী যে কারণেই ঝরে পড়ুক না কেন, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য পরিকল্পনা করা দরকার। উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ ও আওতা বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষকেরা যেন শ্রেণিতে পাঠদানে আরও মনোযোগী হন, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে।