জ্যোতির্ময়–এই মহান পুরুষটির পুরোনাম জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। তিনি আমৃত্যু ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানের জ্যোতি ছড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘আমি মানুষ সুতরাং কোন মানুষই আমার অনাত্নীয় নয়’। যেমন বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। শেখ মুজিব এদেশের মানুষকে খুবই ভালোবাসতেন। এদেশকে ভালোবেসে সারাজীবন বিভিন্ন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কারাবরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু খুব দৃঢ়চেতা, অকুতোভয় এক মহান যোদ্ধা ছিলেন।
তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছিল দেশপ্রেম। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করে বলেছিলেন ‘আজ আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার সাত কোটি বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবাই আমরা বাঙালি আমরা আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক’। যাকে নিয়ে এ লেখা– জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমাজে অতি পরিচিত মুখ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও অনেক গুনে গুনান্বিত।
ছিলেন নিরঅহংকারী, অরাজনৈতিক, সহজ সরল একটা মানুষ। তাঁর কথা বার্তায় ছিল মানবিকতার অবাধ বিকাশ এবং সর্বোপরি মানুষের ন্যায় সংগত ও যুক্তিশীল অধিকার সংরক্ষণের পক্ষে। এমনি একজন মানবতাবাদী ব্যক্তিকে ১৯৭১ সনে ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাত্রিতে বর্বর পাক সেনারা গুলি করে। তিনি বুলেট বিদ্ধ হয়ে মারাত্নকভাবে আহত হন। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ৩০ মার্চ ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান। সেই রাত্রে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা শুধু ঢাকা শহরে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছিল। পাকিস্তানীরা তালিকা করে তখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। আজ সে সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়। পরবর্তীতে জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার জীবন কাহিনি ও কর্মকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। একটা স্মারক গ্রন্থ রচনা করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা স্মারক গ্রন্থ’। যাদের সহযোগিতায় সেটা রচিত হয় তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম ও জাতীয় অধ্যাপক ড. রংগলাল সেন। আরও সহযোগী ছিলেন স্ত্রী বসন্তী গুহ ঠাকুরতা ও কন্যা মেঘনা গুহ ঠাকুরতা। ১৯৮৬ সালে সেটা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থে আরও যারা লেখক ছিলেন তাদের একজন হলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী। জ্যোতির্ময় কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বিশ্ববাসীকে চমৎকৃত করেন নি। তাঁর চরিত্র ছিল নিখুঁত সুন্দর কালিমামুক্ত কাব্যময় জীবন–যেটা মানুষকে আত্নগৌরবে ভূষিত করে– সেটা তিনি বুঝেছিলেন। মানবতাবাদী সমাজ–দার্শনিক জাতীয় অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহম্মদ লিখেছেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ছিলেন একজন আদর্শ ও মানবতাবাদী পুরুষ। তাঁর মধ্যে ছিল অফুরন্ত ও অটুট আশাবাদ। ১৯৭১ সালে তখন মৃত্যুপথ যাত্রী ড. জ্যোতির্ময় বিশ্বাস করতেন যে উন্মত্ত হিংসা ও বিদ্ধেষের শিকার তিনি হয়েছেন সে হিংসা–বিদ্ধেষ একদিন দূর হবে। মানুষ তার সৃজনশীল প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে এক নতুন সুন্দর শান্তিময় পৃথিবী পাবে। তাঁর সহকর্মী সাবেক রাষ্ট্রদূত উপাচার্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ লিখেছেন জ্যোতির্ময়ের কাছে তাঁর শিষ্টাচার, সুরুচি ও সহৃদয়তা সবসময় ছিল। জ্যোতির্ময়ের প্রত্যক্ষ ছাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সাহিত্যিক অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে যে দূরত্ব এটাকে তিনি একেবারেই মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। নিজেকে তিনি ধরা দিতেন পূর্ণ পরিচয়ে। শিব নারায়নের সাথে তাঁর আদর্শিক মিল ছিল। শিব নারায়নের লেখায় জানা যায় জ্যোতির্ময় বলেছেন, ‘আমি মানুষ সুতরাং কোন মানুষই আমার নিকট অনাত্নীয় নয়’। এই বিখ্যাত উক্তি তিনি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন। বুদ্ধির মুক্তি, বিবেকের উজ্জীবন, বিবেকের সংস্কার সাধন প্রভৃতি পদ্ধতিকেই তিনি মানবীয় উৎকর্ষের উপযোগী মনে করতেন। তাঁর মেধা ছিল প্রখর, স্পষ্ট ছিল উচ্চারণ, আকর্ষণীয় ছিল ব্যক্তিত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দীন জাহাঙ্গীর লিখেছিলেন– তাঁর কথার মধ্যে প্রগতি, মানবিকতা ও মুক্তি শব্দগুলি ঘুরে ঘুরে আসতো। আর এক ছাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক শেখ আবদুল ওয়াব এর কথায় তরুণ সমাজের উপর স্যারের দারুন আস্থা ও আশা ছিল। তরুণদের উচ্ছলতা, খেয়াল, তৎপরতা এবং স্বচ্ছ দৃষ্টির মধ্যেই যে সমাজ মুক্তির বীজ লুকানো আছে তা জ্যোতির্ময় ঠাকুরতা বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রায়ই ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ডেকে কথা বলতেন এবং আবার তাদের কথা শুনতেন। ছাত্রদের তাঁর বাসায় চায়ের দাওয়াত দিতেন। জ্যোতির্ময় তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবেসে ১৯৭১ সনে দেশ ত্যাগ করেননি। খুবই মর্মান্তিক–বর্বর পাকিস্তানীরা জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার মত এদেশের অসংখ্য মহান, প্রতিভাবান লোককে হত্যা করেছিল। শুধু গুলি করে মারেনি, রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। এ প্রজন্মকে এগুলি জানা দরকার। এখানে ইতিহাস বিকৃতির কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে সত্যকে কখনো লুকানো যায়না। সত্য–সত্যই। আমরা অনেকেই তখনকার অতি জনপ্রিয় উপস্থাপক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানীর কথা ভুলতে বসেছি। টেলিভিশনে সেই সময়ে তাঁর খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘যদি কিছু মনে না করেন’। আমরা অধীর আগ্রহে সেটা দেখার জন্য বসে থাকতাম। সেই অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থাপন করতেন নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলী বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। থাকত নিরাপদ বুলেট বিদ্ধ শিশুদের মৃত্যু যন্ত্রণার দৃশ্য। সেটা এখনো থামেনি। সেই ফজলে লোহানীর ভাষায়– জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা রোমান দার্শনিক সিসেরোর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রায়ই বলতেন– ‘সালুস পপুলি সু প্রিমা এস্তলেকস’। অর্থাৎ মানুষের মঙ্গলই হচ্ছে সর্ব প্রধান আইন।
আমাদের প্রত্যাশা– মানবতাবাদী এমন পুরুষ বারে বারে যেন এদেশে জন্মগ্রহণ করে। এ সমস্ত মহান ব্যক্তিরা যাতে মূল্যায়িত হয় এটাই কাম্য।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।











