দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি শিল্পায়ন। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যেসব প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহযোগিতা জরুরি তার মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি। বিগত সময় হতে চলমান গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা এর জন্য দায়ী। কারিগরি, পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে মজুত থাকার পরও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের কারণে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বায়ত্বশাসিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কোনো ক্ষমতায় রাখা হয়নি। তাদের কাজ ও মেধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও জবাবদিহীতা নেই। উর্ধ্বতন মহল হতে আদিষ্ট হয়ে কাজ করার প্রবণতার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো এক প্রকার অকেজো ও অলস হয়ে পড়েছে।’
উধ্বর্তন মহল হতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাই হলো তাদের কাজ। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধার বিকাশ ঘটেনি এবং মাঠ পর্যায়ের চাহিদা উর্ধ্বতন মহলে পৌঁছেনি। জ্বালানি সেক্টরের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মাঝে চট্টগ্রামের জনসাধারণের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ এর সেবা প্রদানের বিষয় ও গ্যাস জটিলতা ও সমাধানের বিষয় নিয়ে আলোকপাত করছি।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের অসহযোগিতার কারণে গ্যাস সংযোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতা ও প্রতিকূলতা এবং গ্রাহক সেবা প্রদানে হয়রানি ও জটিলতা প্রভৃতি বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। এসব জটিলতা নিরসন কল্পে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ ও হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
চট্টগ্রাম আদিকাল হতে শিল্পনগরী, বন্দর নগরী, বাণিজ্য নগরী প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত। অথচ চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র লক্ষণীয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল। এসব শিল্পাঞ্চলে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ হতে অনুমোদন নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও শুধু গ্যাস সংযোগের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিনিয়োগ। যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও জটিলতার কারণে বিনিয়োগকারিদের মাঝে ভুল ম্যাসেজে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে।
উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দুরভিসন্ধির কারণে আবাসিক গ্যাস সংযোগও বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ২৫ হাজার গ্রাহকের সকল প্রকার কার্যাদি সমাপ্তের পরও সংযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ কেজিডিসিএল এর সেবার প্রতি আস্থা হারিয়েছে বহু আগে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত দশ বছরে এখাতে সরকারের রাজস্ব বাড়েনি বরঞ্চ কমেছে।
কয়েক বছর হতে কোম্পানি সমূহের ক্ষমতা খর্ব করে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ, বর্ধিত সংযোগ, পুনঃ সংযোগ, সরঞ্জাম পরিবর্তন সহ সকল প্রকার কার্যক্রম জ্বালানি সচিবের নেতৃত্বে পরিচালনা পরিষদের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে। মাসের পর মাস বছর ধরে গ্যাস সংযোগ হতে বঞ্চিত হয়ে আসছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হতে যে সব গ্রাহককে সংযোগের অনুমোদনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাদেরকেই শুধু সংযোগ দেয়া হয়েছে। সাধারণ শিল্প বিনিয়োগকারি এবং ক্ষুদ্র শিল্প বিনিয়োগকারি সহ সকল শ্রেণির গ্রাহকরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন সময় হয়েছে এসব আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন করে চট্টগ্রামের গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। চট্টগ্রামের গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ এর পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হলেও এর পরিচালনা বোর্ডে নেই চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কোনো প্রতিনিধিত্ব। ফলে চট্টগ্রামের গ্রাহকদের স্বার্থ বিষয়ে কথা বলার প্রতিনিধিত্ব না থাকায় উপেক্ষিত হয়েছে চট্টগ্রামের স্বার্থ।
চট্টগ্রামের শিল্পায়ন ও সাধারণ গ্রাহকদের কথা বিবেচনায় রেখে চট্টগ্রামের জন্য এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার হলেও এর সুফল চট্টগ্রামের শিল্প বাণিজ্য এবং আবাসিক গ্রাহকরা কোনো সময়ই পায়নি। বরঞ্চ এলএনজি সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হলেই চট্টগ্রামের জনগণ জিম্মি হয়ে পড়ে। ন্যাশনাল গ্রীড হতে এ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য কোনো কারিগরি ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ বিষয়ে সংবাদপত্র সমূহে বারবার লেখালেখি হলেও গ্যাস সেক্টরের চট্টগ্রাম বিদ্বেষী কর্মকর্তাদের লোমও স্পর্শ করেনি। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ তে বর্তমানে দক্ষ লোকবল সংকট প্রকট। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহ ৪/৫ জন মহাব্যবস্থাপক ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানি হতে বদলী করে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে চট্টগ্রামের প্রতি তাদের কোনো মমতাবোধ বা দায়িত্ববোধ নেই বললেই চলে।
কর্ণফুলী গ্যাসের নিজস্ব কর্মকর্তা না হওয়ায় স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়ে আসা এসব কর্মকর্তারা শুধু সময় ক্ষেপণ করে দিন পার করেন। চট্টগ্রামের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানির প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফলে সেবা প্রদানকারী এ প্রতিষ্ঠান হতে কাঙ্ক্ষিত কোনো সেবা শিল্প বিনিয়োগকারিরা বা আবাসিক গ্রাহকরা পায়নি। বিষয়টা জরুরিভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া জরুরি। চট্টগ্রামে বিপুল সংখ্যক শিল্পে সংযোগ না হওয়ায় সরকার রাজস্ব হতে বঞ্চিত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা হাজার হাজার কোটির টাকা বিনিয়োগ করেও হতাশায় ভুগছে। অনেকে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের বর্তমানে প্রতি মাসে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ঘনমিটার। কেজিডিসিএল সরবরাহ করে প্রায় ২০০ থেকে ২১০ মিলিয়ন বা ২০ থেকে ২১ কোটি ঘনমিটার। চট্টগ্রাম জেলায় বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজি গ্যাসের মাধ্যমে ৯৯ শতাংশ গ্যাাস সরবরাহ করা হয়। এর বিকল্প হিসাবে রাখা হয়নি দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গ্যাসের সংযোগ। ফলে মেরামত বা আমদানিতে জটিলতায় সংকটে পড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাস ব্যবহারকারী।
গ্যাস বিতরণ সংস্থার মতে, আমদানি করা এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের পর পাইপ লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য দেশে ভাসমান টার্মিনাল ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) আছে দুটি। সংস্কারজনিত কারণে এর একটি থেকে সরবরাহ বন্ধ রয়েছে মে থেকে। অন্যটি হতে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সরবরাহ কমে যায়। ভোগান্তিতে পড়েছে বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্রাহকরা। প্রকৃত অবস্থা এই যে, চট্টগ্রামের জন্য এলএনজি গ্যাস আমদানির পরও পরিস্থিতির তেমন উন্নয়ন হয়নি, যা হতাশাজনক।
চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি আমদানি নির্ভর গ্যাস হওয়ায় ঝুঁকি বেশি। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যনুযায়ী দেশের বড় বড় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এলএনজি আনার দিকে ঝোঁকটা বেশি বলে প্রতিয়মান হয়। ফলে গ্যাস সঙ্কটের সমাধান করা দূরে থাক বরঞ্চ দিন দিন সংকট গভীর হচ্ছে।
গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন গ্যাস বিপণন নীতিমালা–২০১৪ অনুসরণ করা হলেও সে অনুযায়ী সংযোগ দেয়া হয় না। সময়ে সময়ে জারী করা প্রজ্ঞাপনের কারণে বন্ধ হয়ে যায় গ্যাস সংযোগ। কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে গ্যাসের ট্যারিফ মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে শিল্পের উৎপাদনকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে।
সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিকট কতিপয় প্রস্তাবনা এখানে তুলে ধরছি। গ্যাস সংযোগ প্রক্রিয়া সহজিকরণের লক্ষ্যে কোম্পানীগুলোকে পূর্বের ন্যায় ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন। নতুন সংযোগ, শিল্প সংযোগ, পুনঃ সংযোগসহ সকল সংযোগ প্রক্রিয়া অনুমোদনের জন্য কোম্পানী সমূহের প্রধানকে ক্ষমতা প্রদান, আবেদনকৃত সকল আবেদনকারীকে সংযোগ প্রদান, শিল্পাঞ্চল বা অন্য কোনো অজুহাতে যাতে সংযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। জটিল বিষয় বা বড় ধরনের শিল্প গ্রাহকদেরকে গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে এবং নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য পরিচালনা পরিষদের অনুমোদনের ব্যবস্থা নিবেন। সকল প্রকার প্রজ্ঞাপন বাতিল করে গ্যাস বিপণন নীতিমালার আলোকে গ্যাস সংযোগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। আবাসিক গ্রাহকদের যারা ইতিমধ্যে সকল জামানত পরিশোধ করেছেন তাদেরকে গ্যাস সংযোগ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মহানগরে আবাসিক ক্ষেত্রে বর্ধিত সংযোগ প্রদান চালু করণ। চট্টগ্রামে আবেদনকৃত সকল গ্রাহককে স্বল্পতম সময়ে গ্যাস সংযোগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ। কেজিডিসিএল বোর্ড চট্টগ্রামের এবং চট্টগ্রামের গ্রাহক প্রতিনিধির সমন্বয়ে পরিচালনা পরিষদ গঠন। দুর্নীতি প্রতিরোধকল্পে বর্ণিত বিষয়াদি পর্যালোচনা করে পূর্বের ন্যায় কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অনুমোদন ও গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষমতা দেয়া জরুরি।
বর্তমান সময়ে সরকারের পক্ষ হতে সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে। শিল্প সমূহে উৎপাদনের স্বার্থে এবং দেশী–বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য এবং দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য এবং বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বর্ণিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক–শিল্পশৈলী।