দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরে বেসরকারি থাবায় সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মিথ্যা ঘোষণা এবং শুল্ক ফাঁকি এক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে। দেশের জ্বালানি খাতের বেসরকারি অংশীদারিত্বের সঠিক মনিটরিং এর অভাব সরকারের রাজস্ব আয়, জ্বালানি নিরাপত্তা, জ্বালানির মানসহ সার্বিক ক্ষেত্রে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশে ডিজেল বিক্রি প্রায় ৭ লাখ টন কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিপিসি সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা উপরোক্ত আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, দেশের সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললেও তেল বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়া মানেই সর্যের ভিতরে ভূতের বসবাস শুরু হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে দেশের জ্বালানি তেল আমদানি এবং বাজারজাত করে আসছিল। গত বছর–কয়েক আগে দেশে বেসরকারিখাতে রিফাইনারী স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। যারা দেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রের কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন করে বিপিসির কাছে বিক্রি করে আসছিল। বিগত সরকার গত বছর বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুদ, পরিশোধন, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা–২০২৩ জারি করে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এই নীতিমালার সুযোগে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত তিন বছর বার্ষিক টার্নওভার কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হয়েছে এমন কোম্পানিগুলো ১৫ লাখ টন ধারণক্ষমতার রিফাইনারী স্থাপনের অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি কোম্পানিগুলো আমদানিকৃত ক্রুডঅয়েল ব্যবহার করে যে জ্বালানি তেল উৎপাদন করবে প্রথম তিন বছর সেখান থেকে ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, জেট ফুয়েল ও ফার্নেস অয়েলের ৬০ শতাংশ কিনে নেবে বিপিসি। বাকি ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নিজস্ব পেট্রোল পাম্প তৈরি, বিপিসির নিয়ন্ত্রাণাধীন পেট্রোলপাম্পগুলোতে তেল বিক্রি এবং বিদেশেও তেল রপ্তানির সুযোগ দেয়া হয়। তবে কোম্পানিগুলো এই ৪০ শতাংশ তেল বিক্রি করতে না পারলে তা বিপিসি কিনে নেবে। এক্ষেত্রে বিপিসিকে দুই মাস আগে কি পরিমাণ তেল বিক্রি করতে চাচ্ছে তার একটি হিসেব দিতে হবে। ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি জ্বালানি তেল উৎপাদন এবং বিপণন শুরু করেছে।
বিপিসির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেসরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে আসার পরই রহস্যজনকভাবে দেশে জ্বালানি তেল আমদানি কিংবা বিপণন কমতে শুরু করেছে। দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত জ্বালানি হচ্ছে ডিজেল। এক বছরের ব্যবধানে দেশে ডিজেলের ব্যবহার প্রায় ৭ লাখ টন কমে গেছে।
বিপিসির দেয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে (২০২৩–২৪) দেশে ৬৭ লাখ ২৭ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রয় হয়েছে। এর মধ্যে ডিজেল বিক্রি হয় ৪২ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৭ টন। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ছয় লাখ ৯০ হাজার ৯৫৬ টন বা ১৪ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরে দেশে ডিজেল বিক্রি হয়েছিল ৪৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৩ টন। এর আগের বছরও দেশে ডিজেল বিক্রি হয়েছিল ৪৯ লাখ টন। দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা ও বিক্রি প্রতিবছরই বাড়ছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধিও অনেক। কিন্তু আচমকা ১৪ শতাংশ ডিজেল বিক্রি কমে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসে বিপিসি প্রশাসন।
একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেশের কৃষি উৎপাদন, শিল্প প্রক্রিয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, গৃহস্থালি ও অন্যান্য সকল কাজই গত অর্থবছরে স্বাভাবিক ছিল। তাহলে হুট করে ডিজেল বিক্রি কমে গেলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে।
বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিপিসির বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ থাকলেও জ্বালানি তেল আমদানি কিংবা শুল্ক পরিশোধে কোনো গোঁজামিল দেয়ার সুযোগ নেই। পণ্যের মান রক্ষার ক্ষেত্রেও বিপিসি আপোষ করেছে এমন প্রমাণ নেই। বিপিসি তেল আমদানি করে বিপণন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিক্রি করে। তারা সামান্য কমিশন পেয়ে থাকে। কিন্তু বেসরকারিখাতে জ্বালানি তেল আমদানিতে হিসেবে গোলমাল করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তাই হয়েছে বলে মন্তব্য করে তারা বলেন, কোনো কোম্পানি ৭০ হাজার টন ক্রুড আমদানি করে ৪০ হাজার টন এনেছে বলে যদি হিসেব দেয়, তাহলে তা ধরবে কে? সরকারের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া বার্ষিক ৫ হাজার কোটি টাকার উপরে টার্নওভার থাকা একটি কোম্পানিকে ধরতে যাওয়ার রিস্ক কেউ নিতে পারে না। তাছাড়া বিপিসি কাস্টমস কিংবা অন্যান্যদের ম্যানেজ করার মতো সুযোগও তাদের রয়েছে। ফলে বেশি জ্বালানি তেল এনে কম হিসেবে দিয়ে শত শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। অপরদিকে তাদের উৎপাদিত জ্বালানি তেলগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশে বিক্রি করেছে। দেশের মানুষ ঠিকই জ্বালানি তেল ব্যবহার করেছে, কেউ কেউ মুনাফার পাহাড় গড়েছে, কিন্তু দিনশেষে সরকারই কেবলমাত্র রাজস্ব হারিয়েছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।