জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে সঠিক পরিকল্পনাতে নিহিত অর্থনীতির মুক্তি

সৈয়দ কামরুল হাবীব | শুক্রবার , ২৯ জুলাই, ২০২২ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল সাম্রাজ্য দখলের প্রতিযোগিতা। সাম্রাজ্য যতদূর বিস্তৃত করা যায় ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাতেই লাভ। পরবর্তীতে ভূখণ্ড দখলের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। পৃথিবীতে পরাশক্তিগুলো সরাসরি অন্য দেশ বা ভূখণ্ড দখলের পরিবর্তে শক্তির উৎস দখলে মরিয়া হয়ে উঠে বিশেষ করে জ্বালানি। এক বাজার দখল ও দ্বিতীয়ত শক্তির (Power) উৎস দখল পরাশক্তির রাষ্ট্রগুলোর মূল লক্ষ্য হয়। যদি আমেরিকার ইরাক দখলের কথাই ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে সেখানে মূল্যবান ‘তেল’ ছিল পশ্চিমা দেশটির মূল উদ্দেশ্য। ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা না জড়ালে সে সময় আমেরিকার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তো। ইরাক আক্রমণের সার সংক্ষেপেও দেখা যায় আমেরিকা ইরাক থেকে সব ধরনের তেল হরিলুট করেছে। এখানে ন্যায়-অন্যায় বিষয় নয় এটা শক্তি প্রদর্শনের উন্মাদনা। পরাশক্তির কাছে ন্যায্যতা অগ্রহণযোগ্য বিষয়। ভূখণ্ড দখলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বিশ্বে বহু যুগ আগে। উনবিংশ শতকে বাজার দখলই মুখ্য হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে চীন নীরবে সব দেশকে পেছনে ফেলে পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছে নিজ গুণে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে চীনের পণ্যের ভয়াবহ বিস্তার ঘটে কয়েক দশক আগে। চীনের এই বাজার দখলের পদ্ধতি দেশটির অর্থনীতিকে দারুণভাবে চাঙা করে। চীনের এই উন্নতির সাথে সামরিক শক্তির উত্থানে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার ঘুম হারাম হয়ে যায়। বিশ্বে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে জ্বালানি সম্পদ অর্জন। খনিজ সম্পদ অর্থাৎ তেল, কয়লা, গ্যাস বা এ জাতীয় সম্পদের আধার কার দখলে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যেখানেই এ ধরনের সম্পদ আছে সেখানেই পরাশক্তিধর দেশগুলোর দৃষ্টি। বাংলাদেশও এই মানচিত্রের বাইরে নয়। ফলে ক্ষমতার পালাবদলে শক্তিধর দেশ বিশেষ করে আমেরিকা ও ভারতের এক ধরনের চাপ থাকে আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে। বাংলাদেশ নানা কারণে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ও উত্তোলনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ফাঁদে পড়েছে। বাপেক্সকে যদি বেশি শক্তিশালী করা হতো তাহলে এদেশে গ্যাসের সঙ্কট হতো না। ভূতত্ত্ব পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞের অভাব ও অনীহায় আমরা নিজেরাই দেশের ক্ষতি করেছি। বিশ্ব রাজনীতি যে শক্তির উৎসের পেছনে ছুটবে তা দূরদর্শী রাজনীতিক ছাড়া অন্যরা আমলে নিতে পারেনি বা পারে না। সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্লেষণ করলে জ্বালানি শক্তির যুদ্ধ ছাড়া আর কী বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি না নাড়তো তাহলে নিশ্চয় পুতিন এতো দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধে যেতেন না। যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদিআরব সহ যারা আমেরিকার ইশারায় নড়াচড়া করে তারাও জ্বালানি বেশি আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক সময়ে। চীনও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বাড়িয়েছে।
এখন আমরা যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎসের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখবো অতীতে আমাদের জ্বালানি খাতে যে নৈরাজ্য বিরাজমান ছিল তার রাহুমুক্ত হতে পারিনি। এর প্রধান কারণ আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে কুইক রেন্টালের মত অন্যায্য প্রকল্প গ্রহণে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চারদলীয় জোটের আমলে জ্বালানির যে ভয়াবহতা ছিল তা থেকে দ্রুত উত্তরণে মহাজোট সরকার সোজা পথে হেঁটে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং থেকে মুক্তি দিয়ে বাহবা কুড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু সাশ্রয়ী প্রকল্প যা দীর্ঘমেয়াদী ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উপায়গুলো নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা অনেকটা ভুলেই যায় সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। এক্ষেত্রে জ্বালানি আমদানির লবিং সফল হয়।
দেশের জ্বালানি খাতের সুরক্ষা নিয়ে যে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি আন্দোলন করেছিলো আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথমেই তাদের প্রতিহত করে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে আ’লীগ সরকার নানা সফল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলেও জ্বালানি সুরক্ষায় বহুজাতিক কোম্পানির ফাঁদে পা রেখেছে। এখান থেকে বের হতে পারলে সরকারকে এতো বিপুল ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি খাত সচল রাখতে হতো না। জনগণকেও নিজের সম্পদ ব্যবহারে এতো বিপুল অর্থ খরচ করতে হতো না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা সকলেই জানে। কিন্তু আমরা বর্তমানে সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানি খাতে একটি সাশ্রয়ী মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ হাত ছাড়া করেছি। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্য। বর্তমান আ’লীগ সরকার পদ্মাসেতুর মত মহাপরিকল্পনাকে শত প্রতিকূলতায় বাস্তবায়িত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় এটা যেমন সম্ভব হয়েছে তেমনি কর্ণফুলী টানেলসহ দেশে অসংখ্য মেগা প্রকল্প সফল হবে। তাই এমন নেতৃত্বের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতটি সঠিক সিদ্ধান্ত পেলে দেশ জ্বালানি উৎপাদনে অনেক আগেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হতো বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। আমাদের গ্যাসের খনি অনুসন্ধানে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে বাপেক্সকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছি। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারি সংস্থাগুলোকে অথর্ব সংস্থায় পরিণত করে বিদেশিদের হাতের পুতুল হয়ে জ্বালানি খাতে একটা সঙ্কট সৃষ্টি করেছি। ফলে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নাইকো’র মত বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে। গ্যাস ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণও এদেশ আদায় করতে পারেনি। কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা ও মানসিক দুর্বলতার জন্য আমরা আমাদের সম্পদ যথাযথ ব্যবহার করতে পারিনি। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প, সৌর বিদ্যা, উইন্ড পাওয়ার বা কয়লা বিদ্যুৎ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব জ্বালানি আমদানির পথ প্রশস্ত করেছে। এতে কারা লাভবান হয়েছে তা বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন জাতির স্বার্থে। সারা বিশ্বে সীমানা রক্ষার যুদ্ধ বা ভূখন্ড দখলের যুদ্ধ নেই বললেই চলে। এখন যুদ্ধটা অদৃশ্য যুদ্ধ। শক্তিমত্তার যুদ্ধ চলছেই, তবে সেটা বাজার দখল আর জ্বালানি করায়ত্তের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক দেশ নি:শেষ হতে পারে। কারণ বিশ্বে এখন জ্বালানিই হচ্ছে মূল শক্তি। জ্বালানি ছাড়া শিল্প-কৃষি সব খাতেই ধস নামবে। তাই বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো এখন জ্বালানি নিয়েই ভাবছে বেশি। আমাদের টেকসই অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও সঠিক গবেষণা। আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে নিজস্ব উদ্যোগে জ্বালানি খাত সমৃদ্ধ করা গেলেই দেশের অর্থনীতি মজবুত হবে এবং বিশ্বে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো। তাই প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারকদের দেশের অর্থনীতি ও বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতির সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা