জ্বরে অবহেলা নয়

২৪ ঘন্টায় আরো ৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করণীয় সম্পর্কে যা বলছেন চিকিৎসকরা

রতন বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৬ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

দিন দিন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে চট্টগ্রামে। প্রকোপ শুরু হতে না হতেই ডেঙ্গুতে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগও বাড়াচ্ছে। চলতি বছর চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত মোট ১২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মাঝে তিন জনের মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে। ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে জুন মাসে (১৪ জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যে)। আর তিন জনের মৃত্যু হয়েছে চলতি জুলাইয়ের প্রথম চার দিনে। মৃতের তালিকায় শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। তবে আক্রান্তদের মাঝে শিশুদের মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। টানা কয়েকদিন ধরে পরপর মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। ডেঙ্গুতে পরপর এই মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এভাবে নিয়মিত মৃত্যুর ঘটনা ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেয়ার আভাস দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এজন্য সকলকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন সিভিল সার্জন।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে আরও ৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬১ জনে। গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ১২৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলেও জানিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর মাঝে চমেক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৩৬ জন।

জ্বর হলে অবহেলা নয় : জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গু শনাক্তে দেরি এবং রোগীকে হাসপাতালে আনতে বিলম্বের কারণেই আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। তাই উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে জ্বর হলেই অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ বলছেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা যেটি দেখছি, বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গুসহ কোন টেস্ট না করে রোগীকে বাসায় রাখা হচ্ছে। এরপর অবস্থা খুব খারাপ হলে তখন রোগীকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে আমরা এরকম তথ্য পাচ্ছি।

শুধু দেরি করার কারণেই এবং শুরু থেকে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

একই কথা বলছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীও। তিনি আজাদীকে বলেন, অন্যান্য দেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ আছে। কিন্তু সেসব দেশে মৃত্যুর হার খুবই কম। আমাদের এখানে মানুষের অসচেতনতায় মৃত্যু বাড়ছে।

/৫ দিন জ্বরে ভুগলেও মানুষ ডেঙ্গু টেস্ট করায় না। অবস্থা খারাপ হলে তখন হাসপাতালে নেয়া হয়। অর্থাৎ হাসপাতালেও নেয়া হচ্ছে দেরিতে। আর এই বিলম্বের কারণেই অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

ডেঙ্গুতে শিশুর মৃত্যু নিয়ে যা বলছেন চিকিৎসক : ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সনত কুমার বড়ুয়া বলছেন, বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলেও ঠিকমতো বলতে না পারায় আক্রান্ত শিশুদের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যায়। দেরি হয়ে গেলে আর রিকভার করা সম্ভব হয় না। এতে অনেক শিশুর অকালে মৃত্যু হচ্ছে।

এই চিকিৎসকের মতেবিভিন্ন জটিলতা থাকলেও শিশুরা হয়তো ঠিকমতো বলতে পারছে না। যার কারণে শিশুর জ্বর হলেও অভিভাকরা দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। অথবা অবস্থা খুব খারাপ হলে তখনই শিশুকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। এসব কারণে হাসপাতালে আনার পরও অনেক শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। শিশুরা যেহেতু সবকিছু ঠিকমতো বুঝাতে অপারগ, সবচেয়ে ভালো হয় শিশুর জ্বরের পরপরই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসকের।

করণীয় : চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র জ্বর (যা টানা ৪/৫ দিন অথবা একবার কমে আবারো আসতে পারে), বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। এসবই ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ।

জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই ডেঙ্গু (এনএসওয়ান) টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী ও চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ বলছেন, পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লেও সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে না। তবে কিছু অ্যালার্মিং উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অ্যালার্মিং উপসর্গের মধ্যে রয়েছেতীব্র জ্বরের সাথে পেট ব্যথা, বমি, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরে বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ, প্রস্রাবপায়খানায় বা অন্য কোন ভাবে রক্ত যাওয়া। এসব অ্যালার্মিং উপসর্গ থাকলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

জ্বর দেখা দিলেই ডেঙ্গু টেস্টের পাশাপাশি রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, বিশেষ করে প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিট (এইচসিটি) পরীক্ষা করা জরুরি। জ্বরের তিন দিনের মধ্যেই অবশ্যই এই টেস্ট করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে অবশ্যই প্লাটিলেট ও হেমাটোক্রিট (এইচসিটি) পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্লাটিলেট দেড় লাখের নিচে নামলে এবং পরপর পরীক্ষায় প্লাটিলেট দ্রুত নামতে থাকলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এছাড়া এইচসিটি বা হিমাটোক্রিট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে বা কমে গেলে রোগীর অবস্থার অবনতি হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। তখনও রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে বলে জানান সিভিল সার্জন।

অন্যদিকে, ডেঙ্গু ধরা পড়লে অনেকেই রোগীকে ব্যথানাশক ওষুধসহ গলির দোকান থেকে ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খাওয়ান। এটি রোগীর জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন চিকিৎসকরা। অনেকেই এন্টিবায়োটিক ওষুধও খাওয়ান। যা উচিত নয় জানিয়ে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার বলেন, ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীকে ব্যথানাশক কোনো ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। জ্বর থাকলে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ানো যাবে। আর রোগীকে তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।

ডেঙ্গু আক্রান্তদের টানা ৫/৬ দিন তীব্র জ্বর থাকতে পারে জানিয়ে মেডিসিনের এই চিকিৎসক বলেন, /৬ দিন পর জ্বর নেমে যেতে পারে। তবে জ্বর নামলেও জ্বরের ৬ থেকে ১০ দিনের সময়কালটি রোগীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় রক্তের প্লাটিলেট অতিমাত্রায় কমে যেতে পারে। ফলে এই সময়ে অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। প্রয়োজনে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।

আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতর রাখতে হবে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার বলেন, কোনো এডিস মশা আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর পর অন্য কাউকে কামড়ালে তিনিও আক্রান্ত হন। এজন্য পরিবারের একজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে বাকিদেরও আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তাই আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই মশারির ভেতর রাখতে হবে। এর সাথে যুক্ত করে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলছেন, ডেঙ্গু চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাটাই উত্তম। অর্থাৎ যাতে ডেঙ্গু না হয়, আমাদের সে ব্যবস্থাই করতে হবে। দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। আর মশা নিধন সবচেয়ে জরুরি। এটি সিটি কর্পোরেশনের কাজ। কিন্তু বাসিন্দা হিসেবে আমাদের সকলকে যার যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।

ডেঙ্গু ধরা পড়লে করণীয় সম্পর্কে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুর রব মাসুম বলছেন, আক্রান্ত রোগীকে বেশি বেশি তরল জাতীয় (পানীয়) খাবার খাওয়াতে হবে। এটাই মূলত ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা। জ্বর থাকলে শুধু সাধারণ প্যারাসিটামল চলবে। আক্রান্ত রোগীর রক্ত (সিবিসি) পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত রক্তের প্লাটিলেট, এইচসিটিসহ কিছু ইনডিকেটর মনিটর করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। রোগীকে এ সময় তরল জাতীয় খাবার (জুস, ডাবের পানি, স্যালাইন, স্যুপ প্রভৃতি) বেশি বেশি খাওয়াতে হবে। পরিবারের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিকিৎসার সময়ও দিল না শ্রাবন্তী
পরবর্তী নিবন্ধধানি জমির সঙ্গে মেশার উপক্রম চলাচলের সড়ক