বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মা কালীকে নিয়ে যে অনেক শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন এটা আমরা সবাই কমবেশী অবগত। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতের মধ্যে ‘শ্যামা নামের লাগলো আগুন, আমার দেহ ধূপকাঠিতে’ গানটি আমার অসম্ভব প্রিয়। যতবার শুনি ততবার ভাবি একজন মানুষের মধ্যে কী রকম ভক্তিভাব থাকলে এরকম একটি গান রচনা করা সম্ভব! আমরা হয়তো জানি না সেই কাজী নজরুল মা সরস্বতীকে নিয়েও গানের আসর বন্দনায় সরস্বতীকে ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে অভিহিত করেছিলেন এভাবে
‘এসো গো মা সরস্বতী সর্বমঙ্গলা।
তোমার আসরে বাজে হারমনি বেহালা’।
স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকায় শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে বক্তৃতার কথা সবাই শুনেছি। মঞ্চে যখন স্বামীজীর বক্তৃতার পালা এলো উনি উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার পূর্বে দেবী সরস্বতীকে চোখ বন্ধ করে স্মরণ-মনন করেছিলেন। স্বামীজীর ‘গাই গীত শুনাতে তোমায়’ কবিতায় তিনি মা সরস্বতীকে নিয়ে লিখেছিলেন-
‘বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর
তরঙ্গে তোমার ভেসে যায় নরনারী’।
অন্তর্জালে একবার পড়েছিলাম আকাশ মালিক নামের একজন ভারতীয় মুসলিম সমপ্রদায়ের লোকের লেখা। সরস্বতী পুজো দেখতে গিয়ে তাঁর ভাবনা আমাকেও নাড়া দিয়েছিল। তাঁর ভাষায়- ‘আমি হাত জোড় করে, দেবীর চোখে চোখ রেখে নির্জীব কাষ্ঠের মতো অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি প্রার্থনার জন্যে নয়, অন্য কারণে। এই মুখাবয়ব, এই চেহারা, এই শাড়ি এই ঠোঁট, নাক, কান আর বিশেষ করে তার চোখের চাহনি ঠিক আমার মায়ের মতো। আমার মনে হলো, কে যেন মায়ের ছবি দেখে দেখে এই মূর্তিটি তৈরি করে এখানে রেখেছেন। এ এক অদ্ভুত মাতৃবন্দনা! মৃম্ময়ীর মাঝে চিন্ময়ীর সাক্ষাতের কথা স্বামী বিবেকানন্দ মূর্তিপূজার মর্মার্থ বোঝাতে বলেছিলেন। যথার্থ ভক্তিভাবের উদয় হলেই এটা সম্ভব হয়।
শুধু যে শিক্ষিত সমাজেই মা সরস্বতীর কদর তা কিন্তু নয়। ওঝাদের মন্ত্রে বাদ যান না দেবী সরস্বতী; কখনো দেখা যায় এই ঝাড়ফুঁক-এর মন্ত্রেও মা সরস্বতী স্থান করে নিয়েছেন। অক্ষয় কুমার কয়াল সংগৃহীত একটি ঝাড়ফুঁক মন্ত্র এই রকম:
‘আকর্ণ পূরি এ জুড়ি বাল্মীকির বাণ,
দেবতা অসুর কাঁপে নাহি সহে টান।
ইন্দ্রের ঘরনি কাঁপে পাতালে বসুমতী,
চৌষট্টি ভৈরবী কাঁপে লক্ষ্মী-সরস্বতী’।
মা সরস্বতী নিয়ে বিভিন্নজন ও সমপ্রদায়ের ভাবনা বিভিন্ন হলেও সবার সাধারণ ধারণা মা আমাদের জ্ঞানের দেবী। সনাতন ধর্মের তত্ত্ব মতে দেবী সরস্বতী বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্প, প্রজ্ঞা এবং প্রকৃতির দেবী যিনি প্রধানত জ্ঞান এবং চেতনার মুক্ত প্রবাহের প্রতিনিধিত্ব করে। সরস্বতী নামটি সংস্কৃত মূল ‘সরস’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘যা তরল’। মা সরস্বতীর বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা আনতে পরিচিত, একটি শান্ত এবং কেন্দ্রীভূত ব্যক্তিত্ব রয়েছে। সরস্বতী ভগবান শিব এবং দেবী দুর্গার কন্যা। এটা বিশ্বাস করা হয় যে দেবী সরস্বতী মানুষকে বক্তৃতা, জ্ঞান এবং বিদ্যার ক্ষমতা দিয়ে থাকেন। আমরা দেখি মা সরস্বতীর চারটি হাত রয়েছে যা মূলত মানব ব্যক্তিত্বের চারটি দিক উপস্থাপন করে থাকে। সেগুলি হলো মন, বুদ্ধি, সতর্কতা এবং অহংবোধ। আমরা দেখি তার এক হাতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং বিপরীত হাতে একটি পদ্ম যা সত্য ও জ্ঞানের প্রতীক। সরস্বতীর প্রতীকতার অন্য দুটি হাত দিয়ে বীণা তারে প্রেম এবং জীবনের সঙ্গীত বাজায়। মায়ের পরনে থাকে সাদা পোশাক-পবিত্রতার প্রতীক এবং একটি সাদা রাজহংস সরস্বতী দেবীর বাহন যা সত্তর গুণ (বিশুদ্ধতা এবং বৈষম্য) এর প্রতীক। রাজহংস জল ও দুগ্ধের পার্থক্য করতে পারে। জল ও দুধের মিশ্রণ থেকে হাঁস কেবল দুগ্ধ ও ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে। জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও তাই। নির্মাণটুকুই কেবল গ্রহণ করা হয়। হাঁস জলে বিচরণ করে কিন্তু দেহে তার জল লাগে না। মহাবিদ্যার বেলায়ও একই কথা। ক্ষীরটুকু রয়ে যায় অনুশীলনকারীর মধ্যে।
আমাদের দেশে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে দেবী সরস্বতীর উপাসনাকে বিদ্বান ব্যক্তিরা অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে শুধুমাত্র সরস্বতীই তাদের মোক্ষ-আত্মার চূড়ান্ত মুক্তি দিতে পারে। চট্টগ্রামে একটি কথা প্রচলিত আছে লক্ষ্মী ও সরস্বতী নাকি একসাথে থাকে না। সাধারণত: যখন শিক্ষা এবং শৈল্পিক দক্ষতা খুব বিস্তৃত হয়, তখন এটি মানুষকে মহান সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে লক্ষ্মী, সম্পদ এবং সৌন্দযের্র দেবী হিসাবে সমতুল্য। মানুষের সাফল্যের সাথে সাথে লক্ষ্মী আসে খ্যাতি এবং সৌভাগ্য হিসেবে। তারপর মানুষ আরও খ্যাতি এবং ভাগ্যের জন্য অভিনয় করে একজন অভিনয় শিল্পীতে পরিণত হন এবং তাই জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে ভুলে যান। এইভাবে লক্ষ্মী সরস্বতীকে ছায়া দেন। সরস্বতী বিদ্যা-লক্ষ্মীতে পরিণত হয়। মানুষ শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতি আদি ভক্তির বিশুদ্ধতা থেকে দূরে সরে যায় এবং সাফল্য ও সম্পদের পূজার দিকে ধাবিত হয়। যেটা হলো চরম বাস্তবতা। সম্ভবত একারণেই বলা হয় লক্ষ্মী ও সরস্বতী একসাথে থাকে না।
বাংলাদেশে সরস্বতী পূজোর পুরোটা সময় বসন্তের একটা আবাহন থাকে। প্রকৃতিতে ঋতুরাজের বাসন্তী রংয়ের ফুলের প্রাধান্য দেখা যায়। প্রকৃতি সাজে অপরূপ সাজে। পাশাপাশি এ সময় বসন্ত পঞ্চমীর প্রথম দিনটি প্রাক-স্কুল শিশুদের বিদ্যা আরম্ভ হিসাবে পালিত হয় যা ‘হাতেখড়ি’ নামে পরিচিত। এটি জ্ঞান ও শিক্ষা লাভের জন্য ছোট বাচ্চাদের হাতে খড়িমাটি দিয়ে লিখতে শেখানোর বা বিদ্যারাম্ভের একটি অনুষ্ঠান। চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনে দেখি প্রতিবছর মহারাজদের মাধ্যমে অনেক ছোট ছোট শিশুর হাতেখড়ি হয়। এধারাটি সনাতন ধর্মের প্রাচীন রীতি গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভের কথা মনে করিয়ে দেয়। এদিন সারাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রী পরিচালিত সরস্বতী পূজা এবং দেবী বন্দনা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্বা, গাঁদাফুল, বিল্বপত্র নিয়ে ভক্তিভরে দেওয়া হয় পুষ্পাঞ্জলি। পুরোহিত সংস্কৃত উচ্চারণে দৃঢ়কণ্ঠে মন্ত্র পড়েন। ভক্তরা সে স্তোত্র কোরাস কণ্ঠে উচ্চারণ করেন। প্রকৃতি মিলে যায় ছন্দে, লয়ে ও তালে। ঝাঁঝ, ঘণ্টা আর শঙ্খধ্বনি আনে আলাদা আমেজ, অনন্য অনুভূতি। যাবতীয় বিদ্যা, সঙ্গীত, নৃত্য, চারুকলা তথা সব নান্দনিক সৌন্দর্য-মাধুর্যের দেবী সরস্বতী। সরস্বতী বন্দনায় কাতর সবাই বিদ্যার জন্য মায়ের কাছে প্রার্থনা করে। কবির ভাষায় বলতে হয়,
‘বিশ্ব চরাচর সবে করিছে আহবান।
তুমি বিদ্যাদায়িনী মা, বিদ্যা কর দান’।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়