জ্ঞানতাপস প্রফেসর ড. আলী আসগর স্মরণে

প্রদীপ ভট্টাচার্য | বুধবার , ৭ আগস্ট, ২০২৪ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশের বিশ্ববরেণ্য পদার্থ বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক প্রয়াত জ্ঞানতাপস প্রফেসর ড. আলী আসগর। বহুগুণে গুণান্বিত তাঁর নতুন করে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞান চর্চা ও সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি যেমন দেশে ও বিদেশে পরিচিত ঠিক তেমনি পরিচিত একজন শিশুদের অধিকার আদায়ের সফল নেতৃত্বদানকারী সংগঠক হিসেবে। বিজ্ঞান চর্চা প্রসারের অনন্য দিশারী জ্ঞানতাপস প্রফেসর ড. আলী আসগর ১৯৩৯ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহ্‌জাদপুর উপজেলার চরনরিনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একজন বরেণ্য স্কুল শিক্ষক পিতা গোলাম হোসেন এবং গৃহিণী মা জোবেদা খাতুনের ছয় সন্তানের মধ্যে স্যার ছিলেন পঞ্চম সন্তান। দুই সন্তানের জনক ও স্ত্রী ড. ফরিদা বেগমকে নিয়েই ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আলী আসগরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি ছাত্রদের সাংস্কৃতিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। পাশাপাশি গরীবমেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতেন সবসময়। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের ফাঁকে ১৯৮২ হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিশুকিশোর সংগঠন খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিকভাবে চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সুদীর্ঘ এই পথ চলার শুরুতেই আমি খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় স্যারের সাথে আমার সর্বপ্রথম সাংগঠনিক পরিচয়। সভা ও দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে খেলাঘর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার তৎকালীন এক অনুষ্ঠানে স্যারকে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে স্যারকে স্যার সম্বোধন করতেই স্যারের সাথে বাঁধে বিপত্তি। প্রথমে উচ্চকণ্ঠে বললো আমাকে স্যার বলে ডাকো কেন? ভাইয়া বলে ডাকতে পার না। উত্তরে বললাম স্যার আপনি একজন শিক্ষক, তাছাড়া আপনার কাছ থেকে আজ সাংগঠনিক ভাবে অনেক কিছু শিখলাম, ভবিষ্যতেও অনেক কিছু শিখবো, তাই স্যার সম্বোধন করলাম। সাথে সাথে অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠলো ঠিক আছে তোমার যা ইচ্ছে তাই ডাক। সেদিন থেকেই এ গুণীকে স্যার সম্বোধন করতে শুরু করলাম।

তাঁর কর্মময় জীবনের ছিঁটেফোঁটা ব্যাখ্যা বা উল্লেখ করা হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কাছে থেকে দেখা এ জ্ঞানতাপসের ক্ষুদ্র পরিসরে আমি গর্ব করে বলতে পারি স্যার শুধু আমাদের কাছে স্মরণীয় না, আমাদের কাছে সূর্য। স্যার খুব জটিল বিষয়কে সহজ ভাবে নিতেন। আলোচনা শুরু করলে কখনো সময়ের দিকে তাকাতেন না। কিন্তু অধ্যয়নে যার উৎসাহ সার্বক্ষণিক, আবার লেখার ব্যাপারে তার উদাসীনতা অপরিসীম। উপরন্তু ঘরোয়া সভা সমাবেশ ও সম্মেলনে অনুকরণীয় নিজস্ব ভঙ্গিতে অনর্গল কথা বলতে তিনি যেমন আগ্রহী তেমনি লোকসম্মুখে আনুষ্ঠানিক ভাষণ দিতে তাঁর ছিল অনিহা। শিশুর মতো সহজ সরল রসসরাস প্রদীপ্ত ব্যক্তিত্ব স্যারের সাথে যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই স্যার তা আন্তরিকতার সাথে শুনতেন। কোনো দ্বিধা করতেন না। বাইরে থেকে স্যারকে যতটুকু কঠিন মনে হতো আসলে অন্তর্গতভাবে ছিলেন খুব নরম মনের মানুষ। পড়াশোনায় তাঁর গভীরতা কতটুকু ছিল তা তাঁর লেখা ও কথায় প্রকাশ পেত। এমনকি মিডিয়ার বিভিন্ন টকশোতে মার্জিত, ভদ্র আচরণও যুক্ত ছিল প্রকাশ্য। একজন আদর্শবাদী শিক্ষক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি নীরব সমর্থক ও শিশু সংগঠক হিসাবে তাঁর কীর্তিময় জীবন বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্মরণযোগ্য নিঃসন্দেহে। তিনি সাম্যবাদীনীতি ও আদর্শের অঙ্গীকারে অটল ছিলেন। অতঃপর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে লালিত সংস্কৃতি ও শিশু সংগঠন খেলাঘরের সাথে যুক্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এদেশের শিশুকিশোরদের জন্য কাজ করে গেছেন। স্যারের জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে খেলাঘর নিয়ে। খেলাঘর আন্দোলনকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অতুলনীয়।

এছাড়া বাংলাদেশের শিশু অধিকার আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ধারণা তৈরিতেও বড় ভূমিকা রেখেছেন এবং আমাদের শিশুদের চিন্তার জগতে তিনি বড় ধরনের অনুঘটক ছিলেন। সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান চর্চা ও খেলাধুলার চর্চার মধ্যদিয়ে শিশু কিশোরদের আনন্দময় শৈশব গড়ার স্বপ্নে তিনি ছিলেন উজ্জীবিত।

তাঁর সাথে খুব কাছের সাংগঠনিক সঙ্গী ছিল খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ, জিয়া উদ্দিন ও ডা. লেলিন চৌধুরীসহ অনেকে। খেলাঘরের বিভিন্ন জেলা সম্মেলন, সভা সমাবেশেসহ বেশ কয়েকবার খেলাঘরের জাতীয় সম্মেলনোত্তর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচনী সভায় স্যারের সাথে গভীর রাত জেগে তাঁর নেতৃত্বে খুব সুচারুভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত করেছি। স্যার কখনো খেলাঘরের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অকারণে তর্কবিতর্ক অহেতুক কুটবাক্য বলা থেকে শুধু দূরেই থাকতেন তা নয়, সাংগঠনিক পরিপন্থি কোনও কাজকে স্যার সমর্থন করতেন না একবাক্যে।

খেলাঘর জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের সুবাদে তাঁর কাছে থেকে কাজ করার সান্নিধ্যে যেমন হয়েছে ঠিক তেমনি স্যারের ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ স্বভাবতই শুধু আমাকে নয় সকলকেই মুগ্ধ করতেন। আমি সৌভাগ্যবান তাঁর মতো একজন জ্ঞানতাপসের কাছে থেকে বিভিন্ন কাজ করার সুযোগ পেয়ে। পাশাপাশি তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব খুব সহজেই সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে আকৃষ্ট করতো। অত্যন্ত সুদর্শন, সাদামাটা চলাফেরা এবং সবসময় সাধারণ পোশাকে থাকতে অভ্যস্ত ছিলেন স্যার। তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে ৮০ টির অধিক বিজ্ঞান গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করেছেন এবং স্যারের বিজ্ঞান গবেষণা, সর্বজনীন বিজ্ঞান শিক্ষা ও শিক্ষার মানোন্নয়নের উপর প্রায় বিশটিরও অধিক গবেষণাধর্মী বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি বই পড়ে অনেক অজানা বিষয় জানার সুযোগ হয়েছে। স্যার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক এবং সাময়িকীতে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ এবং মানুষের মধ্যে সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের জন্য ৫০০ এর অধিক আর্টিকেল লিখেছেন। তাঁর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন অনেকেই। তাই বিজ্ঞানসমাজ এই জ্ঞানতাপসের জ্ঞানের মৌন পাহাড় মনে রাখবে আজীবন।

স্যার মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ হৃদয়ে ধারণ এবং লালন করতেন। শোষণমুক্ত অসামপ্রদায়িক প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে আমাদের প্রেরণার উৎস ছিলেন। তিনি দেশের পশ্চাৎপদতা সাহিত্য সংস্কৃতিক ও সমাজের সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে নিবিড় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এই কিংবদন্তি ছিলেন খেলাঘরের নিবেদিত প্রাণ। তাঁর অক্লান্ত শ্রম, অর্থ ও মেধায় এদেশের শিশু কিশোরদের মুখে হাসি ফুটাতে ও শিশুদের অধিকার, নিরাপত্তা, জীবনমান উন্নয়ন, মৌলিক ও ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন বিধায় আমার মতো খেলাঘরের অগণিত শিশুকিশোর, অভিভাবক, শুভানুধ্যায়ী ও খেলাঘর সংগঠকরা স্যারকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। স্যার আজীবন শোষণহীন, প্রগতিশীল, অসমপ্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন এবং সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার ধারাকে শাণিত করার পাশাপাশি তাঁর হাতে গড়া ‘বিজ্ঞান খেলাঘর’ ও বিজ্ঞানচর্চার আন্দোলনকে প্রসারিত করেছেন। তিনি ১৬ই জুলাই ২০২০ মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বেও খেলাঘরের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু জীবন এবং মৃত্যুর মালিক স্রষ্টা স্বয়ং। সুতরাং তাঁর চলে যাওয়া আপাত দৃষ্টে শূন্য মনে হলেও প্রকৃতঅর্থে আমরাই হয়ে গেলাম শূন্য। খেলাঘরের এই শূন্যতা পূরণ কবে হবে কিংবা শূন্যস্থান পূর্ণতা পাবে কিনা তা হয়তো জানা নেই। কিন্তু তাঁর মতো জ্ঞানতাপসের শূন্যতা বহন করার শক্তিসাহসহিম্মত না থাকলেও তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় শুধু স্থায়ী আসন নয় খেলাঘরের ইতিহাসে তাঁর স্থান অনন্য হয়ে থাকবে অগণিত শিশুকিশোর, কর্মী সংগঠক, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীর কাছে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, খেলাঘর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি ও সদস্য,

খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধআইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করছে অন্য বাহিনী