বরেণ্য শিক্ষাবিদ অগণিত আলেমের উস্তাদ বা শিক্ষাগুরু ছিলেন অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ)। সত্তর বছরের দীর্ঘ জীবনে বহু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ হিসেবে আজীবন ইলমে দ্বীনের খেদমতে, দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে ও সুন্নিয়তের প্রচারে তিনি নিবেদিত ছিলেন। চট্টগ্রাম চান্দগাঁওয়ে শাহসূফি মাওলানা সৈয়দ আবদুল বারী শাহজি হুজুর কেবলা (রহ) প্রতিষ্ঠিত আল আমিন বারীয়া মাদ্রাসাকে ইবতেদায়ী হতে ফাযিল (ডিগ্রি সমমান) পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন তিনি। বর্তমানে এ মাদ্রাসা কামিল স্তরে উন্নীত। তিনি ছিলেন এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। কর্মজীবন ও শিক্ষকতা জীবনে সিংহভাগ অর্থাৎ ১৮ বছর ধরে তিনি বারীয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ ছিলেন। মাদ্রাসা ও খানকার পাশে অবস্থিত মসজিদের (বর্তমানে মসজিদে সনজরি) খতিবও ছিলেন। জুমার দিনে তাঁর মোহনীয় সুরেলা কণ্ঠের খুতবাহ ও ক্বেরাত শুনে সবাই মুগ্ধ হতেন।
এক ঐতিহাসিক দিনে অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খানের জন্ম। ১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্ট তাঁর জন্ম দিন। সম্ভ্রান্ত খান বংশে বুজুর্গ পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন অত্যন্ত বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব দরবেশ মৌলভী মুহাম্মদ নূরুল হোসাইন খান (রহ)। পিতামহ হলেন ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ আবদুল গফুর (রহ:)। তাঁরা সকলের আদি নিবাস চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার খরন্দ্বীপ ইউনিয়নের মুন্সিপাড়া গ্রামে। আল্লামা নূরুল আলম খানের (রহ) পিতা দরবেশ মৌলভি নূরুল হোসাইন খান (রহ) একজন দ্বীন প্রচারক ও সাধক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দ্বীন প্রচারের এক পর্যায়ে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের টোরাগড় গ্রামে গিয়ে তিনি বসবাস শুরু করেন। তাঁর বিশেষ ইবাদত বন্দেগি ও বুজুর্গি দেখে সেখানকার অধিবাসীরা তাঁকে ‘দরবেশ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ওখানে তিনি সংসার জীবন শুরু করেন। আল্লামা নূরুল আলম খান (রহ) এর বর্তমান স্থায়ী নিবাস চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সৈয়দাবাদে। অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ) ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন তিনি। আল্লামা মোস্তফা আল হামিদি (রহ) নামে একজন বর্ষীয়ান আলেম শায়খুল হাদিস হিসেবে ছিলেন কুমিল্লা গাজিমোড়া আলিয়া মাদ্রাসায়। তিনি ছিলেন হাফেজুল হাদিস অর্থাৎ শত শত হাদিস তাঁর মুখস্থ ছিল। শায়খুল হাদিস আল্লামা মোস্তফা আল হামিদির কাছ থেকে হাদিসের পাঠ নিতে আল্লামা নূরুল আলম খান (রহ) কুমিল্লা গাজিমোড়া আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল (হাদিস) শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে এখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৭০ সনে মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্রে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। বিভিন্ন জটিল কঠিন কিতাবের জ্ঞান তাঁর আয়ত্তে ছিল।
কামিল শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবার পর আল্লামা নূরুল আলম খান (রহ)’র কর্মজীবন ও শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম বোয়ালখালী চরণদ্বীপে অবস্থিত চরণদ্বীপ ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। তিনি কিছুদিন এ মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ ছিলেন। এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হলেন পীরে তরিকত উস্তাজুল উলামা আল্লামা মুফতি ইদ্রিস রজভি (রহ)। এ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা কালে কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত বাগোয়ান পাঁচখাইন গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী আলহাজ্ব মুহাম্মদ এমদাদুল হকের কনিষ্ঠ কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আল্লামা নূরুল আলম খান (রহ)। তাঁর সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শুনে আমার নানা সাগ্রহে নিজ কন্যাকে পাত্রস্থ করেন। আর এই বিয়ের নেপথ্যে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন আমার মেজ মামা পীরে তরিকত উস্তাজুল উলামা আল্লামা মুহাম্মদ নূরুল আলম হেজাজী (মজিআ)। যিনি রাঙ্গামাটি সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।
আল্লামা নূরুল আলম খানের (রহ) খ্যাতি, গভীর জ্ঞান ও ইলমের কথা অনেকেই জেনে যায়। চান্দগাঁও বারীয়া দরবার শরিফের সাজ্জাদানশিন পীরে তরিকত শাহসূফি মাওলানা সৈয়দ আবদুল বারী শাহজী (রহ) এর সঙ্গে ইত্যবসরে তাঁর পরিচয় ঘটে। শাহজি হুজুর (রহ) বললেন, আপনি আমার দরবারে চলে আসুন। আপনাকে দিয়ে আমি একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তিনি তাতে সম্মতি দিয়ে বারীয়া দরবার শরিফে চলে আসেন। এরপর ইবতেদায়ী হতে ফাযিল পর্যন্ত বারীয়া মাদ্রাসাকে তিলে তিলে গড়ে তুললেন তিনি। তিনি ছিলেন সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৮ বছরের কর্মজীবন শেষে ১৯৯০ সনে বারীয়া মাদ্রাসা হতে বিদায়কালে শুধুমাত্র আট আনা পয়সার হিসাব দিতে পারেননি তিনি। একথা বহুজনকে বলেছিলেন শাহজি পীর সাহেব (রহ.)।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সূফী সাহেব তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। একদিন সূফী সাহেব এক ঘরোয়া আলোচনায় ওখানে সমবেত আলেমদের কাছে জানতে চাইলেন জ্বিন জাতির ইতিহাস। জ্বিন জাতির আবাস কোথায় তা জানতে চাইলেন। তাঁর এ জিজ্ঞাসার উত্তর দানে অনেক খ্যাতিমান আলেম তখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেও খুব গুছিয়ে দলিলভিত্তিক জবাব দিলেন অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ)। ‘বদায়েয়ুজ জহুর ফি ওয়াকায়েদ্দুহুর’ কিতাবের উদ্ধৃতি পেশ করে সূফী মিজান সাহেবের কাছে তিনি জ্বিন জাতির ইতিহাস বর্ণনা করলেন। বললেন ‘কুহে কাফ ’ নামক স্থানে অবস্থান করেন জ্বিন জাতি। আব্বার মুখে জ্বিন জাতির ইতিহাস বিষয়ে দলিল প্রমাণভিত্তিক এ বর্ণনা শুনে খুশি হন সূফী সাহেব। সেদিন থেকে আব্বাকে বিশেষ সমীহ করতেন সূফী মিজানুর রহমান। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় যারা অধ্যক্ষ- উপাধ্যক্ষ হিসেবে থাকেন তারা প্রশাসনিক দায়িত্বের অজুহাতে তেমন ক্লাস নেন না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী গুণের অধিকারী ছিলেন অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ)। অধ্যক্ষ হিসেবে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নিতেন। কোনো ক্লাসে শিক্ষক নেই দেখলে নিজেই ক্লাসে ঢুকে পড়তেন। বাংলা-ইংরেজি বিষয়েও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। বারীয়া মাদ্রাসার এক শিক্ষক একদিন লাইব্রেরি এই শব্দটির ইংরেজি বানান ভুল লিখেছিলেন তাঁর এক দরখাস্তে। আল্লামা খান (রহ) সহাস্যে তাঁর ভুল শুধরে দিলেন। কিন্তু এই শিক্ষককে লজ্জিত হওয়ার সুযোগ তিনি দেননি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এবং বিভিন্ন মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে সরলতার সুযোগে অনেকেই তাঁর ক্ষতি করতে চাইলেও তিনি কখনো কারো ওপর প্রতিশোধ নেননি। অনেক দুঃখ-কষ্ট নীরবে হজম করে নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি সনিষ্ঠ ছিলেন। শেষ বিচারে জয়ী হয়েছেন তিনি। ষড়যন্ত্রকারীরা নানাভাবে করুণ নিয়তির মুখোমুখি হবার বাস্তব নমুনা দেখা গেছে।
২ মার্চ ২০১৯ সন। চট্টগ্রাম চান্দগাঁওয়ে আল আমিন বারীয়া কামিল মডেল মাদ্রাসা চত্বরে মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক জাফর আহমদ স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আমার শিক্ষক। তাঁর মুখে শোনা একটি ঘটনা। আব্বার ইন্তেকালের দিন তাঁর নামাজে জানাজায় যোগ দিতে তিনি মোটর সাইকেলযোগে হামজারবাগ মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে চান্দগাঁও হাজী শরফতুল্লাহ ফিলিং স্টেশনের সামনে গিয়ে পানির ঢলে তিনি আটকে পড়েন। ২/৩ হাত উঁচু পানিতে সড়ক সয়লাব। পানির স্রোতের কারণে তিনি মোটর সাইকেলটি সামনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বারীয়া মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের পক্ষে একটি শোক ব্যানার নিয়ে নামাজে জানাজায় যাচ্ছিলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনও পানিতে ডুবে গেছে। কিন্তু গাড়ির স্টার্ট তখনো বন্ধ হয়নি। অথচ গাড়ির ইঞ্জিন ডুবে গেলে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তাই মনে মনে তিনি দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন । কারণ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে তিনি তা ঠিক করে যথাসময়ে নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। পানির মধ্যে ঠেলে সচল মোটর সাইকেলযোগে জাফর স্যার সেদিন আব্বার নামাজে জানাজায় উপস্থিতির ঘটনাটি অলৌকিক ও বিস্ময়কর বলে মনে করেন। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার তৎকালীন সহসভাপতি আলহাজ্ব এম এ ওহাব (বর্তমানে প্রয়াত) আব্বাকে খুবই ভালোবাসতেন। বারীয়া মাদ্রাসায় থাকাকালেই দুজনের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আব্বা করিমিয়া মাদ্রাসা ছেড়ে এবং বায়েজিদস্থ শহীদনগর মসজিদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর আনজুমানের ওহাব সাহেবের পরামর্শানুযায়ী আনজুমান পরিচালিত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার মহেশখালী পুটিবিলা ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। সেখানে থাকেন আড়াই বছর। ১৯৯৭ সনে আনজুমান ট্রাস্ট পরিচালিত চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর মাদ্রাসা এ তৈয়বিয়া সুন্নিয়া ফাযিল এর অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন। অত্যন্ত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক পন্থায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন করে আব্বাজান তৈয়বিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। অনেক বাধা, চক্রান্ত ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তৈয়বিয়া মাদ্রাসায় পাঁচ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। বারে বারে নিজে জুুলুমের শিকার হলেও দীর্ঘ অধ্যক্ষ জীবনে কারো ওপর তিনি জুলুম চাপিয়ে দেননি। কাউকে চাকরিতে হয়রানি করেননি। অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে কারো চাপে কোথাও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেননি। পূর্ণ সততা, দায়িত্বশীলতা, যোগ্যতা-দক্ষতার সঙ্গে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। মাদ্রাসা বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়মমাফিক তদন্তে আব্বার কাছ থেকে কোনো অসাধুতার প্রমাণ কখনো মেলেনি। মাদ্রাসার অর্থ লেনদেনে তিনি সাবধানতা অবলম্বন করতেন। নিজে ক্যাশ রাখতেন না। মাদ্রাসার ক্যাশিয়ারের কাছেই যথানিয়মে ক্যাশ তদারকির দায়িত্ব দিয়ে তিনি ঝামেলামুক্ত থাকতে চাইতেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল হাটহাজারী আনোয়ারুল উলুম নোমানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা। অধ্যক্ষ পদে থাকা অবস্থায় এ মাদ্রাসা থেকেই তিনি অবসর নিয়েছেন। এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পীরে তরিকত অধ্যক্ষ আল্লামা শাহসূফি আজিজুল হক আলকাদেরী (রহ)। ২০১৭ সনের ১৩ জুন (১৭ রমজান) অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ) ইহজীবন থেকে বিদায় নিলেও কর্মগুণেই তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। যাঁর প্রায় ৫০ বছরের শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বিভিন্ন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে এবং ইলমে দ্বীনের খেদমতে। এ মহান দ্বীনি ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানতাপস এবং কৃতী শিক্ষাবিদের ইন্তেকাল দেশ ও জাতিসহ মুসলিম মিল্লাতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাতে সুউচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমিন। লেখক : সাংবাদিক