জ্ঞানই শক্তি জ্ঞানই আলো

ড.আবদুল আজিম শাহ্‌ | মঙ্গলবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

জ্ঞান হলো বাস্তব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, উপলব্ধি ও দর্শনের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষার নাম। ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও যাচাইযোগ্য এবং এর সুশৃংখল নিয়মতান্ত্রিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান ভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। এটি তথ্য উপাত্তসহ পরীক্ষালব্ধ বিশেষ জ্ঞান। এই শিক্ষা সবসময় প্রমাণ সাপেক্ষ। এটি কখনো অনুমান নির্ভর নয়। অপরদিকে মানবীয় গুণাবলী ধারণ, কঠোর থেকে কঠোরতম জ্ঞান সাধনাসহ চেতনাকে জাগ্রত করে আল্লাহর দর্শন লাভের মাধ্যমে অর্জিত রহস্য জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা দৈবজ্ঞান বলে। এটি ইন্দ্রিয় বাহ্য জ্ঞান বলে অনেকে একে অতীন্দ্রিয় জ্ঞানও বলে থাকে। এইজ্ঞান সহজে যে কেউ অর্জন করতে পারে না। কোনো বিশেষ কামেল মুর্শিদ বা সদগুরুর সান্নিধ্যে থেকে ত্যাগতিতিক্ষাসহ সত্য পথের সন্ধান করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই সৃষ্টির রহস্য জ্ঞান তাঁর মধ্যে নিহিত হয় এবং সমগ্র সৃষ্টি তাঁর নখদর্পণে দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি হন ত্রিকালদর্শী।

অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই তাঁর জ্ঞান সীমার মধ্যে। এ অবস্থায় তিনি অন্ত আলোক শক্তি প্রাপ্ত হন। আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য জাগতিক সনদধারী শিক্ষা আবশ্যক নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে সনদবিহীন, স্বাক্ষরবিহীন একজন মূর্খও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে মহাজ্ঞানী হতে পারেন। আর বিদ্যা হলো জাগতিক সনদদারী শাস্ত্রীয় শিক্ষার নাম। কেউ কোনো থিওরি দিয়েছেন, বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন, তা তোতাপাখির মত মুখস্ত করে ডিগ্রি অর্জন করার নাম বিদ্যা। বিদ্যা আর জ্ঞান এক নয়। একটি শিশু জন্মের পর পরিবেশ, প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা থেকে ধীরে ধীরে অনুভূতি, উপলব্ধির মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জন করে, তার নাম জ্ঞান। যেমনমায়ের ভাষা আয়ত্ত্ব করে জ্ঞানের মাধ্যমে। বাঁচার জন্য খাদ্য গ্রহণ, সুস্থ থাকা, স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ঔষধ খেতে হয়, এটি জানার নাম জ্ঞান। তবে কোনও ওষুধ খালি পেটে, কোনটি ভরা পেটে খাওয়া উচিত, কোনও খাদ্য কখন গ্রহণ করলে শরীরের জন্য ভালো, আবার কখন গ্রহণ করলে শরীরের জন্য খারাপ হয় সেটি জানার নাম বিজ্ঞান। সেজন্য জ্ঞান আর বিজ্ঞান ভিন্ন। তবে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সমন্বয় হলে শিক্ষায় পূর্ণতা আসে।

যে শিক্ষা নীতি নৈতিকতা শেখায়, মনে উদারতা আনে, মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। আর সেটাই হলো জ্ঞান। এটি মানুষকে অহংকারমুক্ত ও বিনয়ীসহ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক (.) মাইজভাণ্ডারী বলেছেন,’ ‘যে জ্ঞান ঈমানের দৃঢ়তা ও মনে উদারতা আনে সেটাই প্রকৃত জ্ঞান’। জ্ঞান মানুষকে সুবুদ্ধির পথে ধাবিত ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। সুবুদ্ধির মধ্যেই নিহিত মানবের কল্যাণ, শান্তি ও আধ্যাত্মিকতা। সুবুদ্ধির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব। অর্থাৎ জ্ঞান মানুষকে সুবুদ্ধির পথে নিয়ে যায়, আর সুবুদ্ধি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। আধ্যাত্মিক সাধক মজজুবে সালেক হযরত মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্‌ (.) ফরহাদাবাদী সুবুদ্ধির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সুবুদ্ধিতে খোদা, সুবুদ্ধিতে রাসুল (.), সুবুদ্ধিতে কোরআন, সুবুদ্ধিতে ঈমান, সুবুদ্ধিতে ইসলাম, সুবুদ্ধিতে মানবতা’। জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে সুবুদ্ধির উদয় না হলে সেই শিক্ষা বৃথা। আবার সুবুদ্ধির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করতে না পারলে সেটিও বৃথা। জ্ঞান মানবের আত্মোন্নয়ন ঘটায়, ভালোমন্দ পার্থক্য করতে শেখায়, মানবাত্মাক আলোকিত এবং চেতনাকে জাগিয়ে দৈবজ্ঞান লাভে সহায়তা করে।

যে শিক্ষা চেতনাকে জাগ্রত করতে পারে না, সেটি কখনো প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। চেতনা হলো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আধ্যাত্মিক শক্তি তথা বেলায়েতের শক্তি। যে ব্যক্তি চেতনাকে জাগ্রত করতে পারে সে স্থান, কাল ও সময়ের উর্ধ্বে বিচরণ করে এবং ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। তখন এদেরকে বলা হয় আল্লাহর বন্ধু বা আউলিয়া। এরা আল্লাহর রূপে রূপায়িত, গুনে গুণান্বিত, এবং রঙে রঞ্জিত হয়। জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে যে সত্যকে ধারণ করে, সে হৃদয়ে আল্লাহকেও ধারণ করতে পারে। তখন সে দৈব জ্ঞানশক্তি লাভ করে এবং অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়। আবার আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাথে বিজ্ঞান জড়িত। আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের প্রতিটি রহস্যাবৃত কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিজ্ঞান নিহিত। তবে আমাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই বিধায় সেটি বুঝে উঠতে ব্যর্থ হই। কারণ যেখানেই আধ্যাত্মিকতা সেখানেই বিজ্ঞান। এই জন্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের তুলনায় বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র মাত্র। পূর্বেই বলেছিভৌতিক জগতে কোনো বস্তুর প্রয়োগ কখন কীভাবে করতে হয় তা জানার নাম বিজ্ঞান।

বিজ্ঞান মানুষকে প্রযুক্তিমুখী করে। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ অবদান প্রযুক্তি। কিন্তু যে প্রযুক্তি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাচেতনা ও মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানবকে রোবটে পরিণত করে, সেই প্রযুক্তি আমি গ্রহণ করার পক্ষে নয়। প্রযুক্তি মানুষের তৈরি কিন্তু সেটি যখন মানুষকে পুতুল বানানোর চেষ্টা করে, অন্তত সেই প্রযুক্তির বিপক্ষে আমার অবস্থান। আবার অনেকে বিজ্ঞান স্বীকার করে কিন্তু আধ্যাত্মিকতাকে স্বীকার করতে চায় না। কারণ বিজ্ঞান প্রমাণ নির্ভর।

আর আধ্যাত্মিকতা অনুভূতি, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব (এটি ভৌত চোখে দেখা ও প্রমাণ করা সহজ নয়)। অপরদিকে বিদ্যা ভৌতিক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট করে। ডিগ্রিধারী বিদ্যা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জনের পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে এটাও সত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপরীত হয়। দার্শনিক হযরত ইমাম গাজ্জালী(.) ‘কিমিয়ে সাদাত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শাস্ত্র জ্ঞান আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনে বাধা স্বরূপ’। (তবে এটি ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর)। তিনি আরো বলেছেন,‘শাস্ত্র জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অর্জিত হয়’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়অনেক আউলিয়া রয়েছেন যাদের ন্যূনতম অক্ষরজ্ঞানও ছিল না। অথচ সাধনাগুনে মহাজ্ঞানীতে পরিনত হয়েছেন।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো বর্তমানে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে চাকরি, অর্থ আয় ও অপরের গোলামি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রিসহ উচ্চশিক্ষিত অহংকারযুক্ত কিছু তোতা পাখি তৈরি হয় কিন্তু মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি হয় না। যদি হতো তাহলে সমাজে ধনীদরিদ্র, ছোটবড়, উঁচুনিচুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষে পার্থক্য হতো না। যে জ্ঞান সত্যের দিকে নিয়ে যায়, সেটিই সঠিক জ্ঞান। যে জ্ঞান আল্লাহর গুনে গুণান্বিত হতে শিক্ষা দেয়, সেটিই সঠিক জ্ঞান। তাই জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই সত্য, জ্ঞানই আলো।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশজুড়ে বই উৎসব: সরকারের সফল উদ্যোগ
পরবর্তী নিবন্ধসবক্ষেত্রে ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে