ধর্মকে ঢাল বানিয়ে দেশে-দেশে কালে-কালে বহু মানুষের প্রাণ নিয়েছে স্বার্থান্ধ মানুষ। পশ্চিমা বিশ্বের উদার মানবিক চরিত্র সেটা কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়। ইতিহাসের পাতায়-পাতায় রক্তাক্ত অক্ষরে লেখা আছে তাদের ধর্মান্ধ, স্বার্থান্ধ ও অমানবিক আচরণের বিবরণ। ইংরেজদের অত্যাচার ও নৃশংসতার কাহিনী এই উপমহাদেশের অধিবাসীদের ভালোই জানা আছে। সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। জোয়ান অব আর্কের জীবনী যখনই পড়তে নিয়েছি ততবারই ইংরেজদের শঠতা ও নিষ্ঠুরতায় মন বিষিয়ে উঠেছে। আমাদের ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়েদ্দাদারের কথা বারবার মনে এসেছে। দেশকে ভালবাসার অপরাধে তারা হত্যা করেছে অগণিত দেশপ্রেমিক মানুষকে।
তবে জোয়ান অব আর্কের প্রতি তাদের নিষ্ঠুরতার সকল
সীমা অতিক্রম করেছিলো।
জোয়ান অব আর্ক এক ফরাসী বীরযোদ্ধা, সেনাপতি ও বিপ্লবী, ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। তার দেশপ্রেম, সাহস, ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় বন্ধ হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শতবর্ষী যুদ্ধ। মূলত তিনিই মুক্ত করেছিলেন ফ্রান্সকে ইংরেজদের হাত থেকে।
১৩৩৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় অ্যাওয়ার্ড অবৈধভাবে ফ্রান্সের সিংহাসন দাবি করেন। এতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ শুরু হয় যা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত চলে। ইতিহাসে এটি শতবর্ষী যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৪১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজাহ্যানরী পঞ্চম এক যুদ্ধে ফরাসীদের পরাজিত করে ফ্রান্স দখল করেন। এর ফলে ফ্রান্স খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে কোন জাতীয় ঐক্য ছিল না নেতৃত্ব দেওয়ার মত শক্তিশালী কোন ব্যক্তিও ছিল না। চার্লস দ্যা পনথু যার নেতৃত্ব ছিল অত্যান্ত দুর্বল। এই সময় এক কৃষক কন্যা যার কাজ ছিল মেষ চড়ানো আর মায়ের কাছে সেলাই শেখা। নিতান্তই কিশোরী। সে স্বপ্ন দেখতে লাগলো ফ্রান্সকে মুক্ত করবে। তার দৃঢ় সংকল্প সে পারবে দেশকে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত করতে আর নেতৃত্ব দিতে। ভাবতে থাকেন কীভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেন। জোয়ান গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটলেন। দেখা করলেন সেনা কমান্ডের সাথে। অনুরোধ করলেন, রাজা চার্লসের সাথে দেখা করিয়ে দিতে। কমান্ডার তার কথায় গুরুত্ব দিলেন না। কিন্তু জোয়ান হাল ছাড়ার পাত্রী নন। এক পর্যায়ে স্থানীয় নেতাদের সহায়তায় তিনি রাজার সাথে দেখা করলেন। রাজা সংশয়ে পড়লেন যে কীভাবে তিনি একজন কিশোরীর হাতে একটি দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব তুলে দেবেন?
এই কিশোরী কি সত্যি একজন ঈশ্বরের দূত নাকি একজন উন্মাদ? অনেক ভেবেচিন্তে তিনি বিশ্বাস করলেন জোয়ানকে এবং কিছু সৈন্য দিয়ে তাকে অরলিন্স শহরে পাঠালেন যা ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডের দখলে ছিল। অরলিন্সবাসী ঘটনাটি জেনে খুব আশাবাদী হয়ে উঠলেন এবং বিশ্বাস করলেন যে ঈশ্বর তাদের জন্য দূত পাঠিয়েছে তাদের মুক্ত করার জন্য। শুরু হলো যুদ্ধ। জয় করলেন অরলিন্স শহর। প্রতিহত করলেন ইংরেজদের। এদের পর এক শহর যুদ্ধ করে জিতে নিলেন। তার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে এক সময় পুরো ফ্রান্স ইংরেজদের দখল মুক্ত করেন। অবশেষে সমগ্র ফ্রান্সের সম্রাট হন চার্লস। আর জোয়ান অব আর্কের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। যুদ্ধ শেষে ফিরে যেতে চাইলেন জোয়ান তার সেই নিভৃত পল্লীতে। কিন্তু সম্রাট তাকে তার রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত করলেন।
পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন কাস্পিন শহর বার্গাণ্ড ডান্সদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তিনি ছোট একটি সেনাদল নিয়ে সেখানে অভিযান চালান। কিন্তু ইংরেজ ও বার্গান্ডদের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল ফরাসীরা। এই পরাজয়ের জন্য তারা জোয়ানকেই দায়ী করলো। কারণ তারা বিশ্বাস করতো জোয়ান ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। অথচ তার চেষ্টার কমতি ছিল না। তিনি ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে যান দুর্ভাগ্যবশত বন্দী হন বার্গান্ডার ডিউকের সেনাপতি লুক্সেমবার্গের হাতে। জোয়ানের মাথার দাম দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ইংরেজরা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। সেই লোভে লুক্সমবার্গ ইংরেজদের কাছে জোয়ানকে বিক্রি করে দেয়। শুরু হলো বিচারের নামে প্রহসন ধর্ম যাজকেরা শরীক হলেন তাতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো, জোয়ান ডাইনী, সে ধর্মীয় অনুশাসন অস্বীকার করেছে, সে ব্যভিচারিনী। এসব অভিযোগের দায়ে ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী জোয়ান অব আর্কের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো। ফ্রান্সের সম্রাট তার সাহায্যে এগিয়ে আসলেন না। প্রকাশ্যে রাস্তার একটা মঞ্চের উপর তাকে বাঁধা হলো। নৃশংসভাবে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো। একবার নয় দুই বার নয় তিন বার করে তার হাড়মাংসকে পুড়িয়ে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল। তার অপ্রতিরোধ্য সাহস, গভীর দেশপ্রেম ও নির্বিক চিত্ত সেনাবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জোয়ান ফ্রান্সে বিরল যুদ্ধজয় এনে দিয়েছিল। অনেকেই বিশ্বাস করে তার ঐশ্বরিক শক্তি ছিল। আসলে তার গভীর দেশাত্মবোধই ঐশ্বরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
১৪১২ সালে পূর্ব ফ্রান্সের ডম রেমী অঞ্চলে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। বাবা জ্যাক ডি আর্ক। মা ইসাবেল রোমিই। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। মৃত্যুর পূর্বে তিনি একটি ক্রুশ হাতে নেন। তিনি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করে দিয়ে তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বলেন। তার মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর পোপ তৃতীয় ঘোষণা দিলেন জোয়ান অব আর্ক আসলে নিষ্পাপ ছিলেন। চার্চ মিথ্যা রায় দিয়েছিল। পাঁচশ (৫০০) বছর পর ১৯২০ সালে ক্যাথলিক চার্চ জোয়ানকে সেইন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। ফ্রান্স এবং সেনাবাহিনীর প্যাট্রন সেইন্ট এখন জোয়ান অব আর্ক।
এক সময়ের ডাইনী অপবাদের দায়ে পুড়িয়ে মারা জোয়ান অব আর্ক ফ্রান্সের জাতীয় বীর ও দেশপ্রেমের প্রতীক।