ছাত্রজীবন থেকে ইচ্ছে ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার। প্রবাসে থাকা স্বামী সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। ২০২০ সালে দেশে এসে করোনা মহামারিতে আটকা পড়েন। পরে বিদেশে গেলেও দেড় মাসের মাথায় কঠিন রোগ নিয়ে ফিরে আসেন। একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে স্বামীর চিকিৎসা; অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েন গৃহিণী সায়রা আক্তার। কিন্তু বসে থাকলে তো হবে না। সাহস করে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করলেন। স্বর্ণালংকার বিক্রি করে বাড়ির পাশে খনন করেন একটি পুকুর। পুকুরে চারপাশে শুরু করেন সবজি চাষ। এক পর্যায়ে মাছ ও সবজি চাষ শুরু করেন। এই সময় তিনি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। কৃষি কর্মকর্তা তাকে মাছ ও সবজি চাষের পাশাপাশি জৈব সার (ট্রাইকো কম্পোস্ট সার) উৎপাদনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। শুরুটা এভাবেই হলেও এখন তার মাসিক আয় লাখ টাকা। নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং তার খামারে প্রতিদিন কাজ করেন ৮ জন নারী–পুরুষ। জৈব সার উৎপাদন করে বেশ সাড়া জাগানো সায়রা আক্তার ধৈর্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের লালানগর গ্রামের বাসিন্দা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সায়রা আক্তারের বাড়ির পাশে ১১০ শতক জায়গার একপাশে রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরের উত্তর পাশে রয়েছে টিনশেড ঘরের মধ্যে জৈব সার উৎপাদন কারখানা। সেখানে কাজ করছেন কয়েকজন লোক। সায়রা আক্তার বলেন, প্রথম পর্যায়ে গ্রামের মানুষ আমাকে নিয়ে হাসি–তামাশা করত। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সবসময় উৎসাহ দিত। এ কারণে আমি আজ সফল হতে পেরেছি। প্রতি ৪৫ দিন পরপর ১০ টনের বেশি জৈব সার উৎপাদন হয় আমার কারখানায়। প্রতি কেজি ২০ টাকা করে বিক্রি করি। যেসব উপাদান দিয়ে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরি হয় সেগুলো হলো– গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, সবজির উচ্ছিষ্ট, কচুরিপানা, কাঠের গুঁড়া, ভুট্টার ব্রান, চিটাগুড়া, ছাই ও নিমপাতা এবং ট্রাইকোডারমা ছত্রাকের অণুবীজ। এসব উপাদান নির্দিষ্ট অনুপাতে একত্রে মিশিয়ে বিশেষ উপায়ে হাউসে জাগ দিয়ে ৪০–৪৫ দিন রেখে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করা হয়। সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন হাটবাজার, কসাইখানা ও খামার থেকে সারের জৈব উপাদানগুলো সংগ্রহ করা হয় বলে জানান সায়রা আক্তার। পরে কেঁচো সারেও সফলতা লাভ করেন তিনি। উপজেলার লালানগর গ্রামের কৃষক মঈন উদ্দিন বলেন, আমি ২ বছর ধরে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করছি। রাসায়নিক সারের তুলনায় এই সারের স্থায়ীত্ব বেশি। তাই ফসল উৎপাদনের খরচ কম হচ্ছে। এতে আমরা লাভবান হচ্ছি। প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শ্রমিক জাফর বলেন, কয়েক মাস ধরে ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও কৃষি জমিতে কাজ করি। যেদিন কৃষিকাজ করি সেদিন ৬শ টাকা ও যেদিন জৈব সারের কারখানায় কাজ করি সেদিন ৭শ টাকা মজুরি পাই। সায়রা আক্তারের সাফল্য দেখে গ্রামের বেকার তরুণ–তরুণীরা এ কাজে বেশ উৎসাহী হচ্ছে। উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, ট্রাইকো কম্পোস্ট সারের ভালো গুণ রয়েছে। এ সার গাছের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ, ফলন বৃদ্ধি ও গাছকে সতেজ রাখতে ভূমিকা রাখে। এই সারের বিশেষ আরেকটি গুণ হচ্ছে, গাছের পাশাপাশি মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ সার প্রয়োগে মাটির গুণাগুণ ঠিক থাকে। ফলন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। সারটি উৎপাদন করতে ৪৫ দিন সময় লাগে। এ সার উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় গরুর গোবর।