সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে তরুণদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে নেপাল। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে গতকাল অন্তত ১৯জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে বারো বছর বয়সের একজন শিশুও রয়েছে। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। শুধু রাজধানী নয়, বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যত্রও। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির গ্রামেও বিক্ষোভ হয়েছে। তার পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয়েছে ইটপাটকেল। উঠেছে তার পদত্যাগের দাবিও। দেশের উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে পদত্যাগ করেছেন নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক।
সমপ্রতি নেপাল সরকার ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, এক্স–সহ ২৬টি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কাঠমান্ডু পোস্টের তথ্যানুযায়ী, নেপালে ১ কোটি ৩৫ লাখ ফেইসবুক ব্যবহারকারী ও ৩৬ লাখ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী আছেন। অনেকেই ব্যবসা ও জীবিকার জন্য এসব প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ‘জেনারেশন জেড’ বা জেন জি গতকাল কাঠমান্ডুতে দেশের পার্লামেন্টের সামনে জমায়েতের ডাক দিয়েছিল। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ পার্লামেন্টের সামনে জড়ো হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সের সুরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়লে রাজধানীতে সেনাবাহিনী নামানো হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ক্রমশ পুলিশ–প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে যায়। নিয়ন্ত্রণ করতে শূন্যে গুলি ছোড়ে পুলিশ। ছোড়া হয় রবারের গুলিও। তবে বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশ শূন্যে নয়, তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। কারও গায়ে লেগেছে, কারও হাতে, আবার কারও মাথায়।
কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসনের একজন মুখপাত্র জানান, বিক্ষোভকারীরা ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছেন দেখে পার্লামেন্ট ভবন–সহ আশেপাশের সব এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। প্রথমে কারফিউ ছিল শুধুমাত্র কাঠমান্ডু শহরের বাণেশ্বর এলাকায়। কিন্তু পরে রাজধানীর সব হাই সিকিওরিটি এলাকায় সেই কারফিউ সমপ্রসারিত করা হয় –যার মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ (শীতল নিবাস), লেইনচাউরে ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবন, মহারাজগঞ্জ, সিংহ দরবারের চারদিক, বালুওয়াটারে প্রধানমন্ত্রীর নিবাস ও আশেপাশের এলাকা। স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই কারফিউ বলবৎ থাকবে, বলেছে কর্তৃপক্ষ।

গতকাল কাঠমান্ডুতে তরুণদের কর্মসূচি শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে; পরে তারা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। ২৪ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আমাদের টনক নড়িয়েছে, যদিও এখানে একত্রিত হওয়ার এটিই একমাত্র কারণ নয়। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ করছি, কেননা দুর্নীতি নেপালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, সরকারের ‘কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি’ তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। আমরা পরিবর্তন দেখতে চাই। অন্যরা এসব মেনে নিয়েছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের হাতে এর শেষ হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে, সরকার ভয় পাচ্ছে এখানেও সেরকম কিছু হবে।
ফেইসবুক, এক্স ও টুইটারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর নেপালে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন ও ছুটি কাটানোর তুলনা দিয়ে করা অনেক ভিডিও টিকটকে ভাইরাল হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় না পড়ায় টিকটক এখনও দেশটিতে সচল রয়েছে।
নেপালের সরকার গত মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধন, যোগাযোগের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং অভিযোগ সমাধান ও নিয়মনীতি মানা হচ্ছে কিনা তা দেখতে দুই কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে ৭ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিল। গত রোববার এক বিবৃতিতে দেশটির সরকার জানায়, তারা মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতাকে সম্মান করে এবং এসবের সুরক্ষা ও অবাধ ব্যবহার নিশ্চিতের পরিবেশ তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নেপাল এর আগেও জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। অনলাইন জালিয়াতি ও অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়াকে কারণ দেখিয়ে জুলাইয়ে নেপালের সরকার ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রাম বন্ধ করে দিয়েছিল। নেপালের আইনকানুন মানতে সম্মত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ গত বছরের অগাস্টে টিকটকের ওপর থাকা ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ : এদিকে তরুণদের বিক্ষোভে রক্তক্ষয়ী সহিংসতার পর নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক পদত্যাগ করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট শের বাহাদুর দেউবার বাসভবনে এক বৈঠকে দলের নেতাদেরকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি’র বাসভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে রমেশ পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে জানিয়েছে নেপালের পত্রিকা ‘দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট’।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক মন্ত্রী জানান, বিক্ষোভে ১৯ জনের প্রাণহানি এবং ৪০০ জন আহত হওয়ার ঘটনায় নৈতিক কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। রমেশ লেখক ২০২৪ সালের ১৫ জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন।
গতকাল পদত্যাগের কথা জানিয়ে কাঠমাণ্ডুর স্থানীয় সংবাদমাধ্যম অনলাইন খবরকে তিনি বলেন, আজকের বিক্ষোভে বহু প্রাণহানি হয়েছে। তার নৈতিক দায় আমারই। নৈতিকতার খাতিরে আমি পদে থাকতে চাই না।







