জেনেসিস

জীবনের উৎস অনুসন্ধানের চিত্রকাব্য

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ৭ অক্টোবর, ২০২৪ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

মৃণাল সেনের সবক’টা চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘জেনেসিস’ ছবিটি একটু ভিন্ন ধরনের। কাহিনীরেখা, চিত্রনাট্য এবং কারিগরি প্রয়োগের সমন্বয়ে ছবিটির গড়ন মৃণাল সেনের প্রচলিত ঘরানার অনেকটুকু বাইরে। ‘জেনেসিস’ বহু ভাষিক ছবি। হিন্দি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় নির্মিত। কলাকুশলীদের অনেকে বিভিন্ন দেশের। প্রযোজনাও। কিন্তু ভারতে ছবিটি বিভিন্ন উৎসব ছাড়া সাধারণ্যে তেমন প্রদর্শিত হয়নি। যদিও অন্যান্য দেশে ‘জেনেসিস’ প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটি নিয়ে ভারতে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। ছবির কাহিনী এবং চিত্রনাট্যে একটি বিপ্লবার্থক বিষয় রয়েছে যা হয়তো এতদ্‌অঞ্চলে সাধারণ সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না। আর এটাই হয়তো ছবিটি একপেশে করে রাখার কারণ। অথচ মৃণাল সেনের সেরা ছবিগুলির মধ্যে ‘জেনেসিস’ অন্যতম।

সচরাচর মৃণাল সেনের ছবিতে অনেক চরিত্রের সমাগম লক্ষনীয়। বিশেষ চরিত্রগুলিকে কেন্দ্র করে পারিপার্শ্বিক অনেক চরিত্র আবর্তিত হয়। কিন্তু ‘জেনেসিস’ ছবিটি গড়ে উঠেছে চারটি মাত্র চরিত্রকে ঘিরে। এক কৃষক, নিঃস্ব এক তাঁতী, অনাহূত এক ছিন্নমূল অসহায় নারী আর এক ধূর্ত বণিক; এই চার চরিত্রের সমন্বয়ে তৈরি মৃণাল সেনের চিত্রকাব্য ‘জেনেসিস’। চারটি চরিত্রে প্রাণসঞ্চার করেছেন যথাক্রমে নাসির উদ্দিন শাহ্‌্‌, ওম পুরী, শাবানা আজমী ও এম.কে. রায়না তাঁদের অনবদ্য অভিনয়গুণে। বিশেষ করে প্রথম তিনজনের অভিনয় প্রতিযোগিতামূলক। পুরো ছবিতে সংলাপ হাতে গোনা। চিত্রভাষাকে সূক্ষ্মভাবে মূর্ত করে তুলেছেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী এই তিন অভিনয়শিল্পী তাঁদের অসামান্য কুশলতায়। তাঁদের দেহভঙ্গিমা ও অভিব্যক্তি প্রতিটি ফ্রেমকে জীবন্ত করে তুলেছে এমনভাবে যে, চোখ সরানো দায়। লোকেশনও এছবির মুখ্য একটি চরিত্র। ইতালীয় আলোকচিত্রী কার্লো ভারিনির সদাচঞ্চল ক্যামেরা এক্ষেত্রে সঙ্গত করেছে পুরো ছবিতে। কাব্যিক চিত্রগ্রহণ মূর্তকে করে তোলে বিমূর্ত (চরিত্রাভিনয়) আর বিমূর্ত হয়ে ওঠে মূর্ত (লোকেশন)। অপরূপ দৃশ্যায়নের রাজযোটক এলিজাবেথ ওয়ায়েলচলির দ্যুতিময় সম্পাদনা। সম্পাদনার গতিশীলতার চমৎকারিত্বের প্রতিটি ফ্রেম গায়ে গায়ে এতটাই মিশে রয়েছে পুরো ছবিটিকে একটাই দৃশ্য বলে ভ্রুম হয়। প্রতিটি দৃশ্যান্তর (কাট) অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সুমিশ্রিত।

সমরেশ বসুর ছোটগল্প ‘উরাতীয়া’র মৃণাল সেন কৃত চলচ্চিত্রায়ন ‘জেনেসিস’। সমরেশের গল্পটির পরতে পরতে রয়েছে জীবনের নানা রহস্যের অনুষঙ্গ যা অত্যন্ত নিপূণভাবে চিত্রনাট্যে তুলে ধরেছেন মৃণাল। চাষী আর তাঁতী যেন অন্ন ও বস্ত্রের শ্রমের প্রতিভূ যে দুটি মানবজীবনের প্রধান অবলম্বন। তবে বাসস্থান ভঙ্গুর এবং নারী এখানে পরিবার ও সৃষ্টির প্রতীক। চিত্রনাট্যের চলন খুব সহজ সরল হলেও গল্পের ভাবানুসরণে অনেক কিছুই চলচ্চিত্রে অনুচ্চারিত রেখে গেছেন পরিচালক যার অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের দায়িত্ব দর্শকদের দায়িত্বে নিজেদের মতো। এজন্যে ক্লু হিসেবে রেখেছেন অনেক সিম্বল, মোটিফ, ইমেজ আর মন্তাজ।

ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক জঁ ক্লদ কারিয়ের ‘জেনেসিস’ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘বস্তুত,চমকে দেবার মতো কোনো কিছুই এখানে করা হয়নি, ঘটনা ঘটার আগেই সব কিছু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব কিছুই সহজ, শান্ত স্বচ্ছ। কোনো কৃত্রিম রহস্য সৃষ্টি করা হয়নি। অনেক কিছু অনুচ্চারিত ছোট ছোট দৃশ্যে অনেক কিছু উচ্চারিত। সবকিছুই ঘটে যাচ্ছে। তবে ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নয়, বলার গুনে সব ফুটে উঠছে। আর এই বলার ভঙ্গিটা এক কথায় অপূর্ব, অবিস্মরণীয় এই অভিজ্ঞতা। যেন চিত্রনাট্যে তাঁর অফুরন্ত বলার আছে, অনির্বচনীয় ফ্রেমিং এবং যথার্থ ছন্দটি খুঁজে বার করার নিরন্তর প্রয়াসে, ছবির পর ছবিতে মৃণাল সেন যেন হয়ে উঠছেন আরো নিখুঁত নির্ভুল যথাযথ ও দ্যুতিময়। অভিনেতা অভনেত্রীর সঙ্গে পরিচালকের আন্ত সম্পর্ক নিয়েও একই কথা বলা যায়এ ছবিতে, এই ‘জেনেসিস’এ তার পরম প্রকাশ।’ (বিভাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রসঙ্গ মৃণাল সেন, চলচ্চিত্র সমালোচনা’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ক্রম ৩২২৩২৩)

জঁ ক্লদ কারিয়েরের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, তিন যুগন্ধর অভিনয় শিল্পীর অভিনয় ‘জেনেসিস’এর প্রাণস্পন্দন যা প্রতিটি শটে প্রবাহিত। এ প্রসঙ্গে মৃণাল সেনের একটি কথাও প্রণিধান্যযোগ্য, ‘অভিনয়ই অভিনেতার সঙ্গে পরিচালকের ভিতরে একটা বিদ্যুৎচমকের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।’ (শিলাদিত্য সেন সম্পাদিত ‘সিনেমা, আধুনিকতা।। মৃণাল সেন’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ক্রম ৯৫) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার প্রকাশ। একজন অভিনয়শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতিঅভিব্যক্তির প্রকাশের অবকাশ থাকে তার অভিনয়ে, পরিচালকের বিস্তৃত নির্দেশনার পরেও। ‘জেনেসিস’ ছবিতে তিন অভিনয়শিল্পীর অভিনয়ে এ ধরনের প্রচুর সুক্ষ্ম কাজ লক্ষ করা যায়। যার গুণে ছবিটি হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে। ছবির শেষ পর্যায়ে যে দৃশ্যে অনাগত শিশুটির পিতৃপরিচয় নিয়ে তাঁতী, চাষী ও তাদের মধ্যবর্তিনী নারীর মধ্যে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়, সেই সিকোয়েন্সে অসামান্য অনেক অভিব্যক্তি, বাচিক ও দেহজ অভিনয় এবং সংলাপ প্রক্ষেপণ উপহার দেনওম, নাসির, শাবানা। অনেকগুলো ছোট ছোট দৃশ্য এবং দ্রুত সম্পাদনা (কাট) এই সিকোয়েন্সটিকে একই সঙ্গে রাহস্যিক ও মর্মস্পর্শী করে তোলে। এই দৃশ্যটিই এই চলচ্চিত্রের ভরকেন্দ্র যা ‘জেনেসিস’ নামটিকে অর্থবহ করে তোলে। অসহায় নারী যখন বলে, ‘আমি তো জানি না সন্তানটি কার, তোমাদের দুই ভাইয়েরই এই সন্তান, আর তা যদি না মানো, তবে সন্তানটি আমার।’ এই সংলাপ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মানুষের, মনুষ্যত্বের, মাতৃত্বের জয়ধ্বনি অনুরণিত হয়। ঘোষিত হয় পৃথিবী নামের বিচিত্র গ্রহটির জীবন চক্রের আবহমানতার জয়গাথা। অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে হাজার বছরের পুরাণকথার পাশাপাশি নতুন এক জীবনবেদের মন্ত্রচরৈবতি।

জেনেসিস’ ওল্ড টেস্টাসেন্ট বা বাইবেলের প্রথম অংশের সৃষ্টিতত্ত্ব অধ্যায়, যেখানে জননজন্মউৎপত্তিসৃষ্টির কথা সবিস্তারে বলা রয়েছে। মৃণাল সেন যখন তাঁর ছবির মূল বক্তব্যকে স্পষ্টীকরণের জন্যে এই শব্দটিকে তাঁর ছবির শিরোনাম করে নেন তখন তা বড়ো ধরনের এক ইঙ্গিত বহন করে। ছবিতে এসেছে মহাজনের ঋনের ফাঁদ, বণিকের শোষণচক্র ও মুনাফার লোভ, এসেছে নিঃস্ব তাঁতী ও চাষীর অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে সামান্য গ্রাসাচ্ছনের প্রচেষ্টা, সর্বহারা এক নারীর নতুন করে বাঁচার এবং পরিত্যক্ত এক জনপদের ধ্বংস্তূপকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে জীবনে ফিরে আসার গল্প।

চলচ্চিত্র সমালোচক প্রলয় শূর তাঁর ‘মৃণাল সেনের জেনেসিস’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আইজেনস্টাইন থেকে শুরু করে পন্টিকার্ভো কিংবা পোলানস্কি সিনেমার এইসব প্রতিভাবান পরিচালকদের ছবিতে আমরা জীবনের প্রধান প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হই, মৃণাল সেনের ‘জেনেসিস’ ছবিতে আমরা এক বেদনাবিদ্ধ সত্যের মুখোমুখি, এতে ইতিহাসের স্বাদ জীবনেরই স্বাদ, এ ইতিহাস আমাদের পরিচিত, আর সে জন্যেই এই গল্পের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হোক ইতিহাসের ব্যাপকতম জ্ঞান, মৃণাল সেন হয়তো এটাই চেয়েছেন, চেয়েছেন কিনা কে জানে, আমাদের তো এরকমই মনে হলো, ছবি দেখে আমরা অফুরন্তভাবে বিস্মিত, পরিচালক প্রথম দৃশ্য থেকেই জাগিয়ে তুলেছেন দর্শকের রোমাঞ্চময় অনুভূতি, এ ছবির আবেদন তাই অপ্রতিরোধ্য’ (প্রসঙ্গ মৃণাল সেনচলচ্চিত্র সমালোচনা, পৃষ্ঠা ক্রম ৩২৪৩২৫)

(ক্রমশঃ)

পূর্ববর্তী নিবন্ধগানের ভুবন
পরবর্তী নিবন্ধরামু ও টেকনাফে ৩৮ হাজার ইয়াবাসহ আটক ৩