মুক্তির মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত লালসবুজ পতাকার প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় জেল–জুলুম–নির্যাতনের অসহনীয় যন্ত্রণাদগ্ধ বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। শুধু সার্বভৌম ভূখণ্ড নয়; মহান স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার উদ্দেশ্যে গণমানুষের অধিকার সুরক্ষা এবং দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ ছিল তাঁর লালিত স্বপ্নের প্রণিধানযোগ্য অধ্যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পটভূমিতে তিনি নির্মাণ করেছেন দেশোদ্ধার–উন্নয়ন অগ্রগতির সুদূরপ্রসারী রূপকল্প। দেশে ফিরেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্ব নেতৃত্বে মুক্ত দেশের মাটিতে প্রথম ভাষণে জনগণের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে। আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।”
১৯৫৫ সালের ৫ জুন গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ২১ দফা দাবির অন্যতম নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশের মাধ্যমে বাঙালি জাতির যুগান্তকারী মুক্তি সনদ রচনা করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনিত রাষ্ট্রদ্রোহী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাংলার জনগণের অব্যাহত আন্দোলনে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর এই মুক্তিতে আবেগ–আনন্দে উদ্বেলিত প্রায় ১০ লাখ ছাত্র–জনতার সমাবেশ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেদিন থেকে আর বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য কোথাও বাঙালিরা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ ছাড়া অন্য কোন নামে সম্বোধন না করার ইতিহাস রচনা করেছেন। তিনি রাজনীতির আকাশে কিংবদন্তি অবিসংবাদিত নেতা বাঙালির বঙ্গবন্ধু হিসেবে খ্যাতিমান হলেন।
১২ই জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করে বিপর্যস্ত এবং প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত প্রাণপ্রিয় দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার অবিচল প্রত্যয়ে কঠিন নতুন সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করেন। মাত্র নয় মাসের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানে স্বাক্ষর করেন ১৪ ডিসেম্বর যা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। প্রায় সকল ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে অভূতপূর্ব সংস্কার সাধনের মাধ্যমে দেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অবস্থানে সুদৃঢ় করতে সমর্থ হন। একটি আত্মনির্ভরশীল জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতিকে আর্থ–সামাজিক মুক্তির পরিক্রমায় সাধারণ মানুষের অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–স্বাস্থ্য–বাসস্থান নিশ্চিতকল্পে দুর্নীতি দমন, কৃষি ও শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, দেশের মৌলিক সমস্যাসমূহের অন্যতম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে দেশকে সুমহান মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশের মাটিতে পা রাখার পরের দিনই ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ নীতির ভিত্তিতে প্রণয়ন করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। এর মধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল তাৎপর্য নিহিত। এই নীতির ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধুর শাসনামল থেকে শুরু করে আজকের বাংলাদেশ বিশ্বসম্প্রদায়ের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা– মেধা– অভিজ্ঞতা– দূরদর্শিতার সমন্বয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে করেছেন অতিশয় গতিময় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণে অল্প সময়েই সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থানকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও দেশকে শান্তির মডেলরূপে উঁচুমাত্রিকতায় সমাসীন করেন। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুসম্পর্কের ভীত নির্মাণ কারো অজানা নয়। তাঁর জীবদ্দশায় বাংলাদেশ অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি অর্জনে সফল হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে নিজের কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ না রেখে পুরোবিশ্বে শান্তির দূত হিসেবে নিজের পরিচিতিকে এক মহান উপমায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি বাংলাদেশসহ পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে শান্তির স্বর্গরাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে আমৃত্যু আন্দোলন–সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব পরিষদের প্রেসিডেনসিয়াল কমিটির সভায় পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে বিবেচনায় বিশ্বশান্তি পরিষদ ১০ অক্টোবর পদক প্রাপক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করে এবং পরের বছর ২৩ মে এশীয় শান্তি সম্মেলনে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে সেই পদক পরিয়ে দেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মানিত মহাসচিব রমেশচন্দ্র।
উদ্বোধনী ভাষণে পরিষদের সম্মানিত মহাসচিব জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নির্ভীক কান্ডারী এবং বিশ্বের সকল নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষণবঞ্চনার শিকারে বিপন্ন জনগণের অধিকার আদায়ে তৎকালীন সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তী আজীবন সংগ্রামী বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে অভিষিক্ত করেন। সেদিন থেকেই বাঙালির বঙ্গবন্ধু বিশ্ব দরবারে অভিহিত হলেন ‘বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব’। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বিশ্ব শান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ পুরস্কার এই জুলিও কুরি শান্তিপদক। সাম্য–মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া এই পদক বঙ্গবন্ধু উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষদের। উক্ত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতার বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’
আমাদের জানা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কতিপয় ফরাসি, জার্মান, অস্ট্রিয়, হাঙ্গেরিয় ও ইংরেজ নাগরিক বারব্যুস, রোলার্ট, হার্গিজ, নিকোলাই– এর নেতৃত্বে ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ কারাইট’ নামে একটি যুদ্ধবিরোধী সংঘ গঠন করেন। ১৫ দফা সম্বলিত তাঁদের প্রকাশিত একটি ইশতেহারে জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস প্রমুখ স্বাক্ষর করেছিলেন। যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে জার্মানিতে আলবার্ট আইনস্টাইনকে নানাভাবে অপদস্ত হতে হয়েছিল। বিশ দশকে ইউরোপে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানপর্বে ১৯২৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিরোধী লীগ গঠিত হয়। ত্রিশ দশকের মধ্যভাগে ফ্যাসিস্ট হিটলার–মুসোলিনী–ফ্রাঙ্কোর যুদ্ধোন্মত্ততার প্রেক্ষিতে প্যারিস, মাদ্রিদ ও ব্রাসেলস– এ বিশ্বশান্তি ও সভ্যতা রক্ষায় বেশ কয়েকটি বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। জার্মান পদানত ফ্রান্সে শত নিপীড়ন–নির্যাতনসহ জীবন ঝুঁকির বিনিময়ে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি যুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ গঠন করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদ–সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে এবং শান্তির পক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ও সংগঠনকে শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে ‘জুলিও কুরি’ নামাকরণ করে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জনকারীর মধ্যে আছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগণ্য নেতা–প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চিলির সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা ও মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের নাগরিকবৃন্দের বঞ্চণার বিষয় ধারণায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন না। বিশ্ব ইতিহাসের নানামুখী নিপীড়ন–নির্যাতন বিষয়সমূহ তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণের স্রোতধারা প্রবাহমান ছিল। পরাধীনতার গ্লানিকে সংহার করে সমগ্র মানব মুক্তির আন্দোলন–সংগ্রামের প্রতি তাঁর অবিচল সমর্থন ছিল অবারিত। নির্ভীক–দৃঢ়চেতা অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে বঙ্গবন্ধু কখনো কোন সংশয়–দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতেন না। সত্যের কাঠিন্যে জীবন ঝুঁকির বিনিময়ে তিনি সকল অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ন্যূনতম পিছপা হননি। ধারাবাহিকতায় তাঁরই সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নয়; উন্নয়ন অগ্রগতির সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বসমাদৃত। জাতি সংঘসহ এই ধরিত্রীর অনুন্নত–উন্নয়নশীল–উন্নত বিশ্বের সকল বঞ্চিত নাগরিকবৃন্দের পুরোধা প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আজ বিশ্বজয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াকে সমুদয় সূচকে উন্নীত করে বিশ্বে অগ্রভাগে নেতৃত্বের সুদৃঢ়তায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণে অন্ধকার–পরনির্ভরশীলতার পরাকাষ্ঠাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞায় বীরদর্পে এগিয়ে আপামর জনগণের ঐক্যবদ্ধতায় লালসবুজ পতাকার বাংলাদেশকে সর্বত্রই অপরাজিত রাখছেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়