দীর্ঘ আলোচনার পর জুলাই সনদ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মতৈক্যে পৌঁছানো ‘অসম্ভবকে সম্ভব করা’ বলে তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, যে অসাধ্য সাধন হয়েছে, কেউ চিন্তা করে নাই যে শেষ পর্যন্ত এটা হবে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টা আশা করছেন, আগামীকাল শুক্রবার উৎসবমুখর পরিবেশে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করবেন তারা। জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে সই হতে যাওয়া জাতীয় এই সনদে স্বাক্ষরের কলমসহ ইতিহাস জাদুঘরে সংরক্ষণ করার কথাও বলেন মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
এদিন মতভিন্নতা মিটিয়ে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটাতে রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের নিয়ে জরুরি এ বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা, যিনি ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি। সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠকে কমিশনের সদস্যসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সোয়া এক ঘণ্টার এ বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জামায়াত নভেম্বরে গণভোটের দাবি জানিয়েছে। আর এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব কিছু পরিষ্কার করে জুলাই সনদে স্বাক্ষরে অগ্রসর হতে হবে। সবার বক্তব্যের শেষে বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা কয়েকবারই উপস্থিত রাজনীতিবিদদের ধন্যবাদ দেন ও অভিনন্দন জানান। এটা (জুলাই সনদ) বাংলাদেশ ও সমসাময়িক রাজনতির ইতিহাসে স্মরণীয় একটি ঘটনা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার আবদারের কারণেই আজকে আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি বলেছি আমি উপস্থিত থাকব। মূল কারণটা ছিল আজকে এমন একটা সুযোগ ছিল, জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন আপনাদের সবাইকে একত্রিত করে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসছে যে জুলাই সনদ স্বাক্ষর হবে। হয়তো সে অনুষ্ঠানে আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ হত। আমি বললাম সেটাতো আনুষ্ঠানিকতা। আমি একান্তভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই, ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমার এই ধন্যবাদ দেওয়াটা একান্ত করণীয় মনে করে আমি আজকে আপনাদের সামনে এসেছি। যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন এটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয় পৃথিবীর পলিটিক্যাল সিস্টেমের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে পরিবেশে কঠিন কঠিন বিষয়গুলো আপনারা আলোচনা করেছেন এবং সমাধানে এসছেন, কেউ ছেড়ে যাননি, কারও কোনো বক্তব্য বয়কট করে আমি চলে গেলাম আর আলাপ করব না, ওরকম করেননি। নিজেরা সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন একটা ঐকমত্যে পৌঁছতে, আপনারা পেরেছেন। যে কারণে আজকে জুলাই সনদ রচনা হয়েছে। সেজন্য আমি একা নই জাতির সবাই অভিভূত হয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজকে যে পয়েন্টে এসেছি সেটা একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করছি যে এরকম একটা কাজ হয়েছে। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে গর্ববোধ করেছি যে এরকম একটা কাজের সঙ্গে আমি শরিক ছিলাম। যে অসম্ভব কাজ আপনারা করলেন এটা যুগ যুগান্তরে স্বরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী অধ্যায় এর মাধ্যমে সঠিকভাবে রচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আর অন্য কোনভাবে এটা সম্ভব ছিল না। উৎসবের মধ্য দিয়ে আগামীকাল শুক্রবার এই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হওয়ার আশা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি, যে সংস্কারের কথা আমরা মুখে বলে যাচ্ছিলাম আপনারা সেটা প্রকৃতপক্ষে কী সংস্কার হবে তা তুলে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন। কাজেই জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমরা গোটা জাতি একটা বড় উৎসবের মধ্যে শরীক হব।
সবার ছবিসহ সনদে স্বাক্ষর করা কলমগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মানুষ ভুলতে পারবে না, কেউ ভুলতে পারবে না আপনাদেরকে। এইটা এমন একটা ঘটনা আমরা যেহেতু ঘটনার ভেতরে আছি সেজন্য অনুভব করছি না। কিন্তু বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম তাহলে দেখতাম বিশাল একটা কর্মকাণ্ড। মাসের পর মাস, সপ্তাহের পর সপ্তাহ আলোচনা করেছেন। এই মনে হচ্ছে হতাশ হয়েছেন–আবার মনে হয়েছে এটা বোধ হয় কখনো সমাপ্ত হবে না। এটা অসমাপ্ত থেকে যায়নি, আপনারা সমাপ্তিতে এনেছেন। এবং সন্তোষজনকভাবে সমাপ্তিতে এনেছেন। এমন না যে রাগ করে সমাপ্তিতে এনেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনারা ভেবে–চিন্তে নিয়ম–কানুন বের করেছেন যাতে সবাই মিলে স্বাক্ষর করতে পারেন। এটা জাতির জন্য একটা মস্ত বড় সম্পদ হয়ে রইল। সেজন্য সবাইকে অভিনন্দন জানাতে এই বিশেষ সময়টা নিয়েছে। আর যে দলিলগুলো আপনারা তৈরি করেছেন এগুলো হারিয়ে যাবে না। আমি যদ্দিন আছি চেষ্টা করবো যে এগুলো প্রত্যেকের কাছে যেন যায়। তিনি বলেন, আর আপনারা যে বিতর্কগুলো করেছেন সেগুলো অমূল্য সম্পদ। এগুলোকে বিষয়ভিত্তিক করে ভিডিও রাখা, বই করে রাখা যাতে করে এগুলো সম্পদ হিসেবে থাকে, হারিয়ে না যায়। এই ভিডিও ছেলেমেয়েরা দেখবে, নাগরিকরা দেখবে। যারা রাজনীতি করে বা করে না তারা দেখবে। বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে তাদের কাছে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা আবারও তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নির্বাচনের কথা এসছে, আবারও বলি–বারে বারে বলি ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবেই। বারেবারে বলছি উৎসবমুখর নির্বাচন হবে। এজন্য যা যা করা দরকার আমরা সাধ্যমতো তা করবো, আমাদের সাধ্যে যতখানি কূলায়। এটার সঙ্গে আমরা কোনো কমপ্রোমাইজ করবো না। আপনারা যেরকম সবাই মিলে এই সনদটা করেছেন আমাদের সরকারের কাজ হলো উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনটা করে দেওয়া। তাহলেই আমাদের কাজ একটা পরিণতিতে আসলো। তা না হলে তো পরিণতি হল না। কাজেই নির্বাচনটা যে লাগসই হয়। এটার সঙ্গে ওটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সনদ এক জিনিস আর নির্বাচন আরেক জিনিস সেটা যেন না হয়। উত্তরণটা কীভাবে হবে সেটার উত্তরও সেখানে দেওয়া হবে। ট্রানজিশনটা কীভাবে হবে সেটাও আপনারা যেভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেভাবেই হবে।