২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়ার প্রতিবাদে ও কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও চাকুরী প্রত্যাশীরা বিক্ষোভ করে এবং আন্দোলনকারীরা সরকারকে দাবি মানতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। পহেলা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেয় এবং তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হয়। ৭ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ ঘোষিত হয়। এরপর সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানে রাজপথে আলাদাভাবে এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। ছাত্রদের এই আন্দোলনের সাথে একের পর এক বিভিন্ন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিমনা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংহতি প্রকাশ করতে থাকে। ফলে এক পর্যায়ে এই আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৪ জুলাই ঢাকায় পদযাত্রা এবং রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ঐদিন কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন দমাতে সরকার কঠোর অবস্থানে অটল থাকায় পুলিশের গুলিতে দুইশ’র অধিক ছাত্র–ছাত্রী আহত হওয়ার খবর আসে। এরপর থেকে একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকে।
১৭ জুলাই ইউজিসি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সরকার সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখে। ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৯ জুলাই সরকার কারফিউ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬ দিন ইন্টারনেট সেবা অচল রাখা হয়। ২৪ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হলেও মোবাইল ইন্টারনেট অফ থাকে। এদিকে দেশে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত, অগণিত আহত ও গণ গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ তিন সমন্বয়ককে আটক করা হয়। ২৯ জুলাই পর্যন্ত আরো তিনজন সমন্বয়ক গ্রেপ্তারসহ অনেক নাটকীয় ঘটনার পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৩০ জুলাই সরকার ঘোষিত শোক দিবসকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্র জনতা। সেদিন আন্দোলনকারীরা শোকের কালো ব্যাজের পরিবর্তে সকলের ফেইসবুক আইডিতে লাল প্রোফাইলের ছবি ছড়িয়ে দিয়ে অন্যরকম এক প্রতিবাদ জানায়। এই লাল রংটি রাজপথে রঞ্জিত শত শত আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের লাল রক্তের প্রতীকী রং হিসেবে চিহ্নিত হয়। ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায় বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি চলে। এদিকে ডিবি অফিসে হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ক আটক অবস্থায় অনশন কর্মসূচি শুরু করলে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। ছয় সমন্বয়কের মুক্তির পর সব হিসাবনিকাশ উলটপালট হয়ে যায়।
সারাদেশে ছাত্র জনতার উপর হত্যা, গণ গ্রেপ্তার, হামলা–মামলা, গুম–খুন ও শিক্ষকদের উপর হামলার প্রতিবাদে পহেলা আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৩রা আগস্ট প্রধানমন্ত্রী আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সমন্বয়করা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানান, ‘গুলি আর সন্ত্রাসের সাথে কোন সংলাপ হয় না!’
সংলাপের পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা এক দফা, এক দাবি নিয়ে মাঠে নামে। তাদের দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এই এক দফার দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিশু, কিশোর, তরুণ–তরুণী, আবাল–বৃদ্ধ–বণিতা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সেদিন ৩ আগস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম উপস্থিত সকলের পক্ষ হয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী সভার পদত্যাগের এক দফা দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
এদিকে রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম একজন সমন্বয়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু ও ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনকারীদের মাঝে পানি সরবরাহ করা অবস্থায় মুগ্ধের নিহত হওয়ার মত কিছু হৃদয় বিদারক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসী প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে।
আন্দোলনকারীদের দমাতে বিভিন্ন স্থানে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নিউজ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার শনির আখড়ায় বিল্ডিংয়ের ছাদে খেলা করা অবস্থায় হেলিকপ্টার থেকে গুলিতে শিশু হত্যার খবরও আসে। চট্টগ্রামের ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট ও চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায় গুলিতে ও সংঘর্ষে পথচারীসহ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া আন্দোলনের অনেক লোমহর্ষক দৃশ্য ও সহিংসতার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে লাগলো। দ্রুত আরও হতাহত বৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ৪ আগস্ট ঢাকার শাহবাগ এলাকা এবং সিটি কলেজ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একইদিন চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায়ও ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এভাবে সারাদেশে আরো অনেক হতাহতের ঘটনা চলতে থাকে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমাতে সরকার ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট তিন দিনের কারফিউ ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা এসব অবজ্ঞা করে নতুন কর্মসূচি ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করে। প্রথমে ৬ আগস্ট পালন করার কথা থাকলেও পরে তা ৫ আগস্ট করা হয়। তাই ৫ আগস্ট ২০২৪ কারফিউ অমান্য করে বেলা ১১টার পর সারাদেশে থেকে শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ জনগণ ঢাকার শাহবাগে জমায়েত হতে থাকে। তারপর শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করে। এসময় শেখ হাসিনা বেলা ২টার দিকে পদত্যাগ করে এবং আড়াইটার দিকে হেলিকপ্টারযোগে ভারতে পালিয়ে যান। এভাবে স্বৈরাচারের পতন হয়।
২০২৪ সালের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের (১৮ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত) এই রক্তাক্ত ইতিহাস বাঙালি জাতির নিকট চিরস্মরণীয় থাকবে। লাল প্রোফাইলের এই কাহিনীতে যে গণহত্যা ও নির্যাতন হয়েছিল তা একাত্তরের কাহিনীকেও যেন হার মানিয়েছে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত ১৫৮১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আহতদের সংখ্যা অগণিত। কতই মর্মান্তিক! কতই না হৃদয় বিদারক ঘটনা! আমি চব্বিশের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহত সবাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : অধ্যক্ষ, বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক
ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।