জুলাই অভ্যুত্থান : অপ্রতিরোধ্য সাহসে এগিয়ে যায় যৌবন

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৫ জুলাই, ২০২৫ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হল গত ৫ আগষ্ট ২০২৪। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে উদিত হল নতুন সূর্য। দেদিপ্যমান আলোয় উদ্ভাসিত হল বাংলার আকাশ। দেড় হাজার ছাত্র জনতার রক্তের বিনিময়ে বাংলার মানুষ পেল দ্বিতীয় স্বাধীনতা। সবুজ মাঠের আনাচেকানাচে এখনও লেগে আছে রক্তের দাগ, উন্মত্ততার হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল স্বৈরশাসনের সহযোগীরা। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ যেন আছড়ে পড়েছিল ৫ আগষ্ট। লাখো ছাত্র জনতার সরব পদচারণায় সেদিন কেঁপেছিল ঢাকার রাজপথ। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল হাজারো প্রতিষ্ঠান। গণভবন অভিমুখে ছাত্র জনতার অবিরাম যাত্রা যেন নিঃশেষ করে দিচ্ছিল স্বৈরশাসনের দিনক্ষণ। অবশেষে আসল সেই মহা জাগতিক মাহেন্দ্রক্ষণ। ফ্যাসিস্ট সরকার বাধ্য হয়েছিল সেদিন বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যেতে। এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হল ৫ই আগষ্ট। বিজয় উদযাপন করল বাংলাদেশের কোটি কোটি নিষ্পেষিত, নির্যাতিত ছাত্র জনতা। শুধুমাত্র কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে শুরু হয়েছিল ঘটনার সূত্রপাত। নিছক একটি মাত্র কোটার সংস্কার চেয়েছিল দীর্ঘদিনের অবহেলিত ছাত্র সমাজ। আর সেই কোটাটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় ফ্যাসিস্ট সরকারের। আর সেটা হল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। অন্যায়ভাবে দীর্ঘদিন এই কোটা জিইয়ে রেখেছিল স্বৈরশাসক সরকার। আর তাদের ভীড়ে চাপা পড়ে যায় আগামীর সম্ভাবনাময় মেধাবীরা। দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত ছিল এসব মেধাবীরা। আর তাই ক্ষোভে ফুঁসছিল বারবার উপেক্ষিত বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম দিয়ে তারা বিক্ষোভ শুরু করে ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে শুরু হওয়া ৩৬ দিনের আন্দোলনঅবশেষে রূপ পায় এক মহাসফলতা। আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভকারীদের উপর চরম দমননিপীড়ন চালায় ফ্যাসিস্ট সরকার। অবশেষে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। দু’দিন ব্যাপী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত উত্তাল রাজধানী ঢাকায় লংমার্চের অংশ হিসেবে ৫ আগষ্ট ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে মানুষ রাজধানীতে আসতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহেনা সহ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং তার দীর্ঘদিনের ১৬ বছরের অবৈধ শাসনকালের অবসান ঘটে। এই ৩৬ দিনের আন্দোলনে অসংখ্য ছাত্র জনতা দেশ মাতৃকার যুদ্ধে শাহাদাতের নজরানা পেশ করেযেভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে বাংলার দুর্দান্ত ও দুর্দমনীয় দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করে শাহাদাতের নজরানার ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল সারা বিশ্বে। তেমনিভাবে ২০২৪ সালে দীর্ঘ ৫৩ বছর পর বাংলার শান্তিকামী মানুষ আবারও যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করল। ঢাকার রাজপথের ইটসুড়কিতে এখনো যেন লেগে আছে রক্তের দাগ। আর সেই রক্তের দাগের উপর লাখো কোটি মাইল দূরে অবস্থিত সূর্যের রশ্মি বিষ্ফোরিত হয়ে জানান দেয় মুগ্ধ, আবু সাঈদের মতন শহীদদের পদচারণা মুখ। গত বছরের ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ৫ জন বিক্ষোভকারী শহীদ হয়। ঢাকার রায়ের বাজার গোরস্থানে প্রায় ৪৬টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়। নিহতদের ৭৮% প্রাণঘাতি গুলির আঘাতে মারা গেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী১৬ জুলাই থেকে ১১ আগষ্ট ২৪ সাল পর্যন্ত গণহত্যায় ১৪০০ জনের বেশি শহীদ হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায়পুলিশ সদস্যরা একটি ভ্যানে মৃতদেহ জমা করছেন। রক্তমাখা কয়েকটি মৃতদেহ আংশিকভাবে চাদরে মোড়ানো ছিল এবং অস্ত্রধারী পুলিশের পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা সেগুলো ভ্যানগাড়িতে তুলছিল। ধারণা করা হচ্ছেভিডিওটি সাভারের আশুলিয়া থানার আশপাশের এলাকার এবং ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর। জানা যায়, সেই ৬টি মৃতদেহ পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। অবশ্য সে ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের কয়েকজনকে বর্তমান সরকার আইনের আওতায় এনেছে। ছাত্রজনতার ক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা থেকে। আবু সাঈদ ছিল ছাত্র জনতার আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণার বাতিঘর। তাঁর শাহাদাত বাংলাদেশসহ বিশ্ব বিবেককে তোলপাড় করে তুলেছিল সেদিন। তাঁর রক্তমাখা শার্ট হাতে নিয়ে তাঁর সহযোদ্ধারা প্রতিজ্ঞা করেছিল এই যৌবন অপ্রতিরোধ্য, তারা কভু পরাজয় মানে না। আর সেই দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ ভেঙ্গে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল আবু সাঈদের সহপাঠিরা। এই একটি মৃত্যুই ফ্যাসিস্ট সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন। এভাবে ৩৬ দিনের অসংখ্য ছাত্র জনতাকে নির্মমভাবে সরাসরি প্রাণঘাতি গুলি করে, হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলে, ফ্যাসিস্ট সরকারের দলীয় কর্মীদের দিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করেছে হাজারও ছাত্র জনতাকে। এরপরও আন্দোলন থামেনি বরং আরও বেগবান হয়ে উঠে। স্বৈরশাসক সরকার যদিও দৃশ্যমান প্রচুর উন্নয়ন সাধন করেছে বাংলাদেশের আনাচেকানাচে। কালভার্ট, ব্রীজ, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, আন্ডারগ্রাউন্ড স্পেসসহ যাতায়াতের বহু উন্নতি সাধন করেছে কিন্তু তাদের দমননিপীড়ন, গণহত্যা সমস্ত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞকে ফিকে করে দিয়েছে। তাদের মারণাস্ত্রের নিচে চাপা পড়ে আছে দীর্ঘ ১৬ বছরের উন্নয়ন। পরপর তিনটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, দিনের ভোট রাতে করা, একতরফা নির্বাচন, ডামি নির্বাচন, বিরোধী দলকে জেলে অবরুদ্ধ রেখে নির্বাচন করা বাংলার গণমানুষকে বিষ্মিত, বিক্ষুব্ধ ও হতবাক করেছে। এই ১৬ বছরে বুটের তলায় পিষ্ঠ বিক্ষুব্ধরা সেদিন যেন জেগে উঠেছিলরক্তের ধমনীতে প্রবাহিত হয় আন্দোলনের জোয়ার আর সেই জোয়ারে ভেসে গেল স্বৈরশাসকের অবৈধ শাসন। ছাত্র সমাজকে রাজাকার বলায় আরও বেশি মাতাল হয়েছিল সেদিনের বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা। ৫আগষ্ট স্বৈরশাসনের অবসানের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার ধীরে ধীরে সমস্ত গুম, হত্যা, অপহরণের সাথে জড়িত সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে অবৈধ শাসনের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে। কয়েক ডজন মন্ত্রী, সাংসদ, উচ্চ পর্যায়ের নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বিচারক, পুলিশ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, র‌্যাব কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারের জালে অবরুদ্ধ হন। জুলাইয়ের গণহত্যার জন্যে আলাদাভাবে এই সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়। ১৯ আগষ্ট ২০২৪ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল ৩টি গণহত্যার তদন্ত শুরু করেছে। যার মধ্যে অভ্যুত্থানের সময় ৪৫০ বিক্ষোভকারী হত্যার সাথে জড়িত অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০২৫ সালের ১০ জুলাই গণহত্যায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা সহ ৩ জন আসামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়। ঐ দিনে এই মামলার অপর এক আসামী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল আল মামুন গণহত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজসাক্ষী হওয়ার সম্মতি দেন। এই বছরের ৯ জুলাই বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস তাদের ইউটিউব চ্যানেলে একটি তথ্য চিত্র প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে এক অডিও রেকর্ডিং অনুসারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে ২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দেন এবং ‘তারা যেখানেই আন্দোলনকারীদের পাবেন গুলি করবেন’ বলতে এই রেকর্ডিং এ শুনা যায়। অজ্ঞাত পরিচয়ে একজন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনে ফাঁস হওয়া অডিওটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ যে, তিনি সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের গুলি করার জন্য সরাসরি অনুমোদন দিয়েছিলেন। গত ১৮ জুলাইয়ে ফাঁস হওয়া রেকর্ডিং এর কন্ঠের সঙ্গে শেখ হাসিনার কন্ঠের সাথে মিল সনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন যে, প্রাথমিক তদন্তে প্রতিবাদকারীদের গণহত্যায় হিন্দি ভাষাভাষী সশস্ত্র কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আহতরা অভিযোগ করেছেন যে, এসব ব্যক্তিরা হিন্দি ভাষাভাষী ছিলেন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছেদ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আত্নাহুতি দিয়েছেন তাদের আত্না কি আদৌ শান্তি পাবে? গণহত্যার সাথে জড়িত যারা দেশের বাহিরে আছেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করার এখনই মোক্ষম সময়। যারা গণহত্যায় জড়িত মন্ত্রী, সাংসদ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা গ্রেফতার হয়েছেন তারা যেন আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে সেই লক্ষ্যে বর্তমান সরকারকে আরও দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধন করতে হবে। তবেই জুলাইআগষ্টের শহীদদের আত্না শান্তি পাবে। আর বাংলার ১৮ কোটি মানুষ সেদিকেই মুখিয়ে আছেন। জুলাইআগস্টের গণহত্যায় জড়িত অপরাধীদের যেন সঠিক বিচার নিশ্চিত হয় সে ব্যাপারে বাংলার ১৮ কোটি মানুষ মহান রাব্বুল আ’লামিনের কাছে প্রতিনিয়ত আর্জি পেশ করছেন।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস
পরবর্তী নিবন্ধউত্তরায় শুটিং হাউজ বন্ধের নোটিশ নির্মাতা শিল্পীদের প্রতিবাদ