জুম্‌’আর খুতবা

কুরআন ও হাদীসের আলোকে শহীদের মর্যাদা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৪ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা জেনে রাখুন! শাহাদাত উচ্চমর্যাদা লাভের এক সুমহান স্তর। শহীদদেরকে আল্লাহ মর্যাদামন্ডিত করেছেন, তাঁর অনুগ্রহ দয়া ও করুণা দ্বারা সিক্ত করে ও নিয়ামতরাজি দিয়ে শোহাদায়ে কেরামকে ধন্য করেছেন।

শহীদগণের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা চিরন্তন শাশ্বত মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এরশাদ করেছেন

এবং যে আল্লাহ ও রাসুলের হুকুম মানে তবে সে তাঁদেরই সঙ্গ’লাভ করবে যাদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। অর্থাৎ নবীগণ, সিদ্দিকগণ, (সত্যনিষ্ঠগণ) শহীদগণ এবং সৎ পরায়ন ব্যক্তিগণ, এরা কতই উত্তম সঙ্গী (তরজমা কানযুল ঈমান) সূরা :৪ নিসা, পারা: ৫ আয়াত ৬৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন “এবং যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে কখনো তাদের মৃত বলে ধারণা করোনা বরং তারা নিজ রবের নিকট জীবিত রয়েছে। জীবিকা পায়” (তরজমা কানযুল ঈমান)

শহীদের সংজ্ঞায় মযহাবের সম্মানিত ইমামগণ বলেছেন, মুশরিকদের হাতে যারা নিহত হয়, অথবা যুদ্ধ ময়দানে আঘাত প্রাপ্ত অবস্থায় যাদের পাওয়া যায় অথবা অন্যায়ভাবে মুসলমানরা যাকে হত্যা করেছে সে শহীদ।

শহীদ দু’ প্রকার হাকিকী এবং হুকমী ‘শহীদে হাকিকী হচ্ছে’ আল্লাহর যমীনে দ্বীনকে সমুন্নত করার উদ্দেশ্য যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, সে হচ্ছে শহীদ। শহীদে হুকুমী কয়েক প্রকার, যেমন হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শহীদ পাঁচ প্রকার, মহামারী রোগে মৃতবরণকারী, সন্তান প্রসবকালে যে নারীর মৃত্যু হয় সে শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত্যু হলে সে শহীদ, মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হলে সে শহীদ, আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করলে সে শহীদ (বুখারী শরীফ)

হাদীসের আলোকে শহীদের মর্যাদা:

শাহাদাতের গুরুত্ব ও শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনুল করীম ও হাদীসে রসুলে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদের ছয়টি মর্যাদা রয়েছে ১. রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পূবেই তাঁকে ক্ষমা করা হয়। ২ শহীদ নিজের ঠিকানা জান্নাতে প্রত্যক্ষ করে। ৩. তাঁকে কবরের শাস্তি হতে নিরাপদ করা হয়। ৪. কিয়ামতের ভয়াবহতা হতে নিরাপদ থাকবে। তাঁকে জান্নাতী পোসাক পরিয়ে পবিত্র রমনী হুরের সাথে বিবাহ দেয়া হবে। ৬. আত্মীয় স্বজনের মধ্য থেকে সত্তর জনের সুপারিশ করার জন্য তাঁকে অনুমতি দেয়া হবে। (সুনানে তিরমিযী)

হযরত আনাস বিন মালেক (.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এমন কোন ব্যক্তি নেই যে জান্নাতে প্রবেশ করার পর পুনরায় দুনিয়াতে আসতে চাইবে। হ্যাঁ তাঁকে দুনিয়ার সব আসবাব পত্র দেয়া হবে। কিন্তু শহীদ ব্যতীত সে চাইবে পূনরায় দুনিয়াতে ফিরতে এবং দশবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হতে কেননা সে শাহাদাতের মর্যাদা অবলোকন করেছে। (বোখারী শরীফ)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শপথ সে মহান সত্তার যার কুদরতে আমার আত্মা ও জীবন উৎসর্গীত। আমার পরম ইচ্ছে যে আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবো। অত:পর পুনরায় জীবিত হবো, অতঃপর শহীদ হবো পুনরায় জীবিত হবো, পুনরায় শহীদ হবো পুনরায় জীবিত হবো। শাহাদাতের অমীয় সূধা পানে ধন্য হবো। (বোখারী শরীফ)

শহীদগণ জান্নাতে অবস্থান করবেন:

শহীদগন খোদা প্রদত্ত অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়ে প্রভুর পক্ষ থেকে রিযক প্রাপ্ত হবেন। জান্নাতে অবস্থান করবেন। হযরত হাসনা (রা.) বলেন, আমার চাচা (আসলাম ইবনে সুলাইম) (রা.) আমাকে বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ কে জিজ্ঞেস করলাম কে কে জান্নাতে যাবে? তিনি এরশাদ করেন, নবী জান্নাতে যাবেন, শহীদগণ জান্নাতে থাকবেন, নবজাত শিশু জান্নাতে থাকবেন, (আবুদাউদ) আমিরুল মুমীনীন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (.) সর্বদা আল্লাহর দরবারে শাহাদাতের প্রার্থনা করতেন যে “ হে আল্লাহ আমাকে আপনার রাস্তায় শাহাদাত নসীব করুন এবং আপনার শহরে (মদীনায়) আমাকে ইন্তেকাল নসীব করুন, (বোখারী শরীফ) জেনে রাখুন, মুমীনগণ তাঁদের কথা ও কর্মে নামায, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত, দানসাদকা ইত্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে কলেমা ও ঈমানের স্বাক্ষ্য দিয়ে থাকেন, কিন্তুশহীদগণ দেহের রক্ত, প্রাণ উৎসর্গ করে তাওহীদের সাক্ষ্য দেন। একারণে গোসল ও কাফন ছাড়া রক্তমাখা কাপড়সহ শহীদদের দাফন করা হয়।

নিদ্রার পর অযু ব্যতীত নামায হয় না। সম্মানিত নবীগনের নিদ্রা দ্বারা অজু ভঙ্গ হয় না। শহীদগণের মৃত্যুতে গোসল ওয়াজিব হয়না। (হানাফী মাযহাবের ফিকহর কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য)

ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদতের সময় আকাশ রক্তিম হয়ে যায়:

হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র শাহাদাত পৃথিবীর ইতিহাসে এক হৃদয় বিদায়ক মর্মান্তিক ঘটনা। সেদিন কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) আহলে বায়তের ৭২ জন বা ৮২ জন, নূরানী আওলাদগন, দ্বীনের ঝান্ডা সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে ইয়াজিদের সাথে কোনো প্রকার আপোষ করেননি। অন্যায় জুলুম নির্যাতন ও অসত্যের কাছে মাথা নত না করাই কারবালার শিক্ষা। হাদীস বিশারদগনের বর্ণনামতে ইমাম আলী মকামের শাহাদাতের কথা স্মরণ করে করে সত্যান্বেষী মু’মিন বান্দারা অনন্তকাল ধরে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাবে। নবীজির আউলাদের শাহাদতের উপর সমগ্র সৃষ্টি রাজি মানবজাতি, জ্বিনজাতি, ফেরেস্তারাজি, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের প্রতিটি সৃষ্টি শোক প্রকাশ করেছে। ইমাম তাবরানী সে করুণ মূহুর্তের দৃশ্যপট বর্ণনা করেন যে, ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে যখন শহীদ করা হয় তখন আকাশ রক্তিম আকার ধারণ করে। (মুজামুল কবীর, হাদীস: ২৮৩৭)

ইমাম হোসাইন (রা.)’র শাহাদাতে জ্বীনজাতিও কান্না করেছিল:

হেদায়তের সমুজ্জ্বল প্রদীপ, সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক, নবী মোস্তফার আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক অকুতোভয় সিংহ পুরুষ মজলুম মানবতার চেতনার বাতিঘর, ইমাম আলী মকামের শাহাদাতে সেদিন জ্বীন জাতিও নিজেদের অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিল। হযরত উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাহাজাদা হযরত হোসাইন (রা)’র শাহাদাতে জ্বীনরা বেদনা বিধূর শোকার্ত হয়ে ক্রন্দন করতে আমি শ্রবণ করেছি। (মু’জামূল কবীর, হাদীস, ২৮৬২)

বায়তুল মুকাদ্দাসে যে কোনো পাথরের নীচে রক্ত দেখা যেত:

নবী বংশের প্রতি ইয়াজিদ বাহিনীর কত নির্মম ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা, ইমামের নির্মম শাহাদাতের শোকাবহ স্মৃতি বায়তুল মুকাদ্দাস ও সিরিয়ার লোকালয় ও জনপদে সেই শোকগাথার স্মারক চিহ্ন মু’মিনরা প্রত্যক্ষ করেছে। এ প্রসঙ্গে ইমাম তাবরানী ইমাম জুহরী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত মাওলা আলী (রা.)’র পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)কে যখন শহীদ করা হয়েছে তখন বায়তুল মুকাদ্দাসে এমন কোন পাথর পাওয়া যায়নি যা উঠালে তাজা রক্ত পাওয়া যেতনা। (আল মুজামুল কবীর, হাদীস : ২৮৩৪)। আমি অভিশপ্ত শয়তানের প্রতারনা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন “যাঁরা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলোনা। বরং তারা জীবিত হ্যাঁ তোমাদের খবর নেই।” (সূরা : বাকারা পারা ২ আয়াত ১৫৪), হে আল্লাহ! আমাদের কে শোহাদায়ে কেরামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুস্মরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ বরকত উল্লাহ

আনন্দ বাজার, হালিশহর, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মুসলমানের জানাযা আদায়ে কী ফযীলত রয়েছে, জানাযায় লোক কত কাতার দাঁড়াবে?

উত্তর: এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো মুসলমানের জানাযায় উপস্থিত হওয়া। জানাযা আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জানাযা সালাত আদায় করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে সে এক কীরাত পরিমাণ সওয়াব অর্জন করবে। যে ব্যক্তি দাফন করা পর্যন্ত উপস্থিত থাকলো সে দু কীরাত সওয়াব অর্জন করবে। জিজ্ঞেস করা হলো দু’কীরাত কি? নবীজি এরশাদ করেন দুটি বিরাট পর্বতের সমপরিমাণ। (সহীহ মুসলিম, হদীস: ৯৪৫), অন্য হাদীসে এরশাদ হয়েছে, এক কীরাত হলো উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৯৪৫)

মৃত ব্যক্তির জানাযার কাতার বেজোড় করা সুন্নাত। হযরত মালিক ইবন হুবাইরা (রা.) কর্তৃক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির জানাযা তিন কাতার লোক আদায় করেছে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়েছে। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ১০২৮)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাউখালীতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণারের উদ্বোধন
পরবর্তী নিবন্ধছৈয়দ হোসাইন