পবিত্র কুরআনের আলোকে মক্কা মুকাররমার পরিচয় ও গুরুত্ব: দোজাহানের কান্ডারী, মুক্তির দিশারী সমগ্র সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জন্মভূমি মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতরণের শহর। এ আলোকিত নগরীর প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে মহান আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরীফ। আল্লাহ তা’আলা এ পবিত্র শহরের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, মানব জাতির জন্য সর্ব প্রথম যে ঘর নির্মিত হয়েছিল তা বক্কায় যা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। (সূরা: আল ইমরান, ৩:৯৬)
আয়াতে মক্কা বক্কা বলা হয়েছে, বিভিন্ন তাফসীর শাস্ত্র ও ইতিহাস পর্যালোচনয় পবিত্র মক্কার পঞ্চাশটির অধিক নামের সন্ধান পাওয়া যায়। স্বয়ং কুরআনে এর অসংখ্য নাম উল্লেখ রয়েছে, তম্মধ্যে মক্কা বক্কা, উম্মুল কুরা, আল বায়তুল আতীক, আল বালাদুল আমীন, আল কারইয়াহ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য এছাড়া ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় আর রাস আল হারামুল আমীন, আল মুকাদ্দাসা, আল ওয়াদী, আল বালাদ ইত্যাদি অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি শপথ করছি এ নগরীর (মক্কাশরীফের) আর আপনি এ নগরীর অধিবাসী। (সূরা: বালাদ, ৯০:১–২)
পবিত্র মক্কায় ক্বাবা শরীফের অবস্থান : পবিত্র মক্কা নগরী জিদ্দা থেকে প্রায় ৭২ কি:মি দূরে অবস্থিত। ক্বাবা শরীফ আল মসজিদুল হারাম মক্কা নগরীতে অবস্থিত। প্রতিবৎসর পৃথিবীর মুসলমানগণ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে পবিত্র হজ্বব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফে সমবেত হন। এ শহরের মর্যাদা ও পবিত্রতা পবিত্র কুরআন কর্তৃক স্বীকৃত। পৃথিবীর কোনো অমুসলিম নাগরিকদের এ শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় আইনেও এ শহরে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ তা’আলা এর মর্যাদা প্রসঙ্গে এরশদ করেছেন, হে মু’মিনগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র সুতরাং এ বৎসরের পর তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকট না আসে। (সূরা: তাওবা, ৯:২৮)
এই শহরেই নূর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম কুরআনের অহী লাভ করেন, ভূপৃষ্ঠের নাভি তথা পৃথিবীর মধ্যস্থানে পবিত্র মক্কা মুকাররমা অবস্থিত। বর্ণিত আছে হযরত আদম আলাইহিস সালাম হজ্বব্রত পালন করার জন্য পদব্রজে চল্লিশবার এ শহরে তাশরীফ নিয়েছেন।
ক্বা’বা ঘর তথা বায়তুল্লাহ শরীফ’র নির্মাণ: এ পবিত্র ঘরের নির্মাণ পূন:নির্মাণ আল্লাহ তা’আলার নির্দেশেই হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা’আলা সম্মানিত গৃহ ক্বাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতার কারণ করেছেন। (সূরা: মায়িদাহ, ৫: ৯৭)
এ ক্বাবা শরীফ মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সেতুবন্ধন, গোটা বিশ্বের মুসলিম জাতির মিলনকেন্দ্র, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, সেই সময়কে স্মরণ করুন! যখন ক্বাবা গৃহকে মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম। (সূরা: বাকারা, ২: ১২৫)
ক্বাবা শরীফের নির্মাণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, এক বর্ণনা মতে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে সর্বপ্রথম ফেরেস্তারা এ ঘর নির্মাণ করেছেন। নির্মানের পর সর্বপ্রথম ফেরেস্তারা সর্বপ্রথম এ ঘরের তাওয়াফ করেছেন। অত:পর হযরত আদম আলাইহিস সালাম যখন জান্নাত থেকে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করেন তখন জিবরীল আলাইহিস সালামকে সাথে নিয়ে মক্কা শরীফ গমন করেন ও ক্বাবা শরীফ পূন: নির্মাণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু বর্ণনা করেন, নূহ আলাইহিস সালামের যুগে সংঘটিত মহাপ্লাবনে ঘরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং তার স্থানে লৌহিত বর্ণ একটি টিলা রয়ে যায়। কিস্তিতে আশিজন নর–নারী আরোহী ছিলেন, ঐ কিস্তি দিবারাত্রি কাবা শরীফের তাওয়াফ করেছিল। (তাফসীর ইবনে কাসীর, খন্ড: ২, পৃ: ৪৪৭)
নুহ আলাইহিস সালামের তুফানের চারশত বৎসর পর আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাবা শরীফ পুন:নির্মাণ করেন, তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করেছিলেন, কাবার নির্মাণ কাজ খনন কালে কাবার পুরাতন ভিত্তি প্রকাশ পেয়েছিল।
ক্বাবা নির্মাণকালে ব্যবহ্নত পাথর: ক্বাবা শরীফ নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরগুলো নুরানী ফেরেস্তাগন কর্তৃক পৃথিবীর পাঁচটি পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে এসেছিলেন। পাহাড়গুলো হচ্ছে ১. সিনাই পর্বত, ২. যযতুন পর্বত, ৩. কুহে লেবনান, ৪. জুদী পাহাড়, ৫. হেরা পর্বত। ( তারিখে মক্কা মুকাররমা, খন্ড:২, পৃ: ২২৪)
ক্বা’বা ঘর যুগে যুগে একাধিকবার নির্মিত হয়েছে: ক্বা’বা ঘর নির্মানের ইতিহাস অনুসন্ধানে ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত তথ্য মতে ক্বা’বা ঘর আরো বহুবার নির্মিত হয়েছে। যেমন: জুরহুম গোত্র কর্তৃক নির্মিত, আমালিকা গোত্র কর্তৃক নির্মিত, কুসাই বিন কিলাব গোত্র কর্তৃক নির্মিত কুরায়শ গোত্র কর্তৃক আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) কর্তৃক নির্মিত হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফ কর্তৃক নির্মিত। (তারিখে মক্কা মুকাররমা, খন্ড: ২, পৃ: ৪৩)
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কা’বা ঘর নির্মাণ করার সময় যে দুআ পাঠ করেছিলেন তা আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কা’বা গৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিলেন তখন তারা বলেছিল হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে এটা গ্রহণ করুন। নিশ্চয় আপনি শ্রবণকারী মহাজ্ঞানী। (আল কুরআন, সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ১২৭)
এ শহরে বসবাসকারী বান্দাদের নিরাপদ অবস্থান ও তাদের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ফলমূল প্রয়োজনীয় রিযকের যেন কোন প্রকার অভাব ও ঘাটতি সৃষ্টি না হয় এ জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, হে আমার প্রতিপালক! এ শহরকে নিরাপদ করুন, এবং এর অধিবাসীদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান করুন। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১২৬)
আল্লাহর নবীর দুআর বরকতের ওসীলায় অদ্যাবধি পৃথিবীর প্রত্যস্ত অঞ্চল থেকে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মুসলমান ওমরা পালনকারী হিসেবে এ পুণ্যময় শহরে অবস্থান করা সত্ত্বেও জীবনোপকরনের চাহিদা পূরণে কোন প্রকার অভাব অনটন খাদ্য সংকট ও ঘাটতি বলতে নেই। এমন কি বার্ষিক হজ্বব্রত পালনকারী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ মুসলমানদের সমাবেশ ঘটলেও কোথাও কোনো প্রকার ক্ষুধা মন্দা ও অভাবের তাড়নায় মানবেতর জীবন যাপনের দু:সংবাদ কখনো শোনা যায়নি। এ সব কিছুই মহান আল্লার অনুগ্রহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব রাহমাতুল্লীল আলামীনের পদধূলি ধন্য বরকতময় জমিনের জন্য নবীজির দুআ ও হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দুআর ফসল।
মক্কা শরীফে প্রবেশকালে নবীজির দুআ: আল্লাহর প্রিয় হাবীব দোজাহানের সরদার আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা নগরীর আরবের শ্রেষ্ঠ কুরায়শ বংশে হযরত আবদুল্লাহর পৃষ্ঠে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাতা হযরত মা আমেনার নূরানী প্রকোষ্টে যে নবীজির শুভ পদার্পন ঘটেছিল। যে দিন খানায়ে ক্বা’বা বায়তুল্লাহ শরীফ আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল, কিসরার রাজপ্রাসাদের পিলারগুলো একে একে ধসে পড়েছিল, সেই নবীজি এ খানায়ে কা’বা বায়তুল্লাহ শরীফকে অত্যাধিক ভালবাসতেন এ ঘরের মর্যাদা ও সম্মান সমুন্নত রাখতে আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন। মক্কা শরীফ প্রবেশ কালে নূর নবীজি এ দুআ করতেন “হে আল্লাহ এ ঘরের মর্যাদা মাহাত্ন্য সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করুন। যারা এ ঘরের সম্মান করে ও মর্যাদা দেয়, যারা এ ঘরে হজ্ব ও উমরা করে তাদের মর্যাদা সম্মান মাহাত্ন্য ও পুণ্য বৃদ্ধি করে দিন। (মুসনাদে শা ফিঈ, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, কৃত: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর (র.), খন্ড: ৫ম, পৃ: ২৫৬)
ক্বা’বা শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করা ইবাদত: ক্বা’বা শরীফের ফযীলত সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ১. ক্বা’বা শরীফ দেখা মাত্রই যে দুআ করা হবে কবুল করা হয়। ( কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৪, পৃ: ৪৫৮)
২. উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ক্বা’বা শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করা ইবাদত। (কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৪, পৃ: ৪৫৮)
৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনেন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, নবীজি এরশাদ করেছেন, ক্বা’বা শরীফের উপর দৈনিক আল্লাহর পক্ষ থেকে একশত বিশটি রহমত বর্ষিত হয়। ষাটটি রহমত তাওয়াফকারীদের জন্য, চল্লিশটি রহমত নামায আদায় কারীদের জন্য। বিশটি রহমত ক্বা’বা দর্শনার্থীদের জন্য। (বায়হাকী ফাযায়েলে হজ্ব, পৃ: ১০৫)
মসজিদুল হারামে এক রাকাত নামাযে এক লক্ষ রাকাতের সওয়াব: হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মদীনা মনোওয়ায় আমার মসজিদে এক রাকাতে পঞ্চাশ হাজার এবং মক্কা মুকাররমার মসজিদুল হারামে এক রাকাত নামাযে এক লক্ষ রাকাতের সওয়াব রয়েছে।
হে আল্লাহ আমাদেরকে মক্কা মুকাররমায় ও মসুজিদুল হারামের ফযীলত বরকত ও পবিত্র হজ্বব্রত পালন করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ বেলাল উদ্দিন
পটিয়া সরকারি কলেজ, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কোন স্ত্রী লোক স্বামী বা মুহরাম ছাড়া নিজ পীরের সাথে বা পীর ভাইয়ের সাথে বা কাফেলার কোন মহিলা সঙ্গীনীর সাথে হজ্বে যেতে পারবে কিনা?
উত্তর: মহিলাদের উপর হজ্ব ওয়াজিব হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলো মহিলার সাথে স্বামী অথবা অন্য কোন মুহরাম সঙ্গে থাকা। কাজেই কোনো মহিলা স্বামী ছাড়া বা মুহরাম ছাড়া অন্যকোন লোকের সাথে নিজ পীর হোক, পীর ভাই হোক বা মহিলার বান্ধবী সঙ্গিনী হোক, কারো সাথে হজ্বে গমন করা জায়েজ নেই। (ফতওয়ায়ে শামী, ২য় খন্ড)
যে স্ত্রী লোকের স্বামী নেই এবং মুহরামও নেই, তার উপর হজ্ব ওয়াজিব নয়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৬ষ্ঠ, পৃ: ১৪)
এভাবে মুহরাম ছাড়া কোনো বৃদ্ধ লোকের সাথেও হজ্বে গমন করা মহিলাদের জন্য হারাম। মুহরাম ছাড়া কোন মহিলা হজ্ব সম্পন্ন করলে প্রতিটি কদমে কদমে গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, খন্ড:৪র্থ, পৃ: ৬১৯)
মুহরাম অর্থ এমন পুরুষ হওয়া যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া চিরদিনের জন্য হারাম। যেমন পিতা, ছেলে এবং ভাই। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৬ষ্ঠ, পৃ: ১৪)। হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্ল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোনো স্ত্রী লোক মুহরাম ব্যাতীত কখনো সফর করবেনা। (মুসলিম শরীফ, খন্ড: ১ম, পৃ: ৪৩৪, মিশকাত: হাদীস: ২৫১৩)