ইসলামে রোযার প্রকারভেদ:
ইসলামী শরীয়তে কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ ফকীহগনের বর্ণনা মতে রোযা ছয় প্রকার। ১. ফরজ, ২. ওয়াজিব, ৩. সুন্নাত, ৪. নফল, ৫. মাকরূহ, ৬. হারাম। ১. মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতের বর্ণনামতে পবিত্র রমজানে পূর্ণ একমাস রোযা রাখা ফরজ। ২. মান্নতের রোযা ও কাফফারার রোযা পালন করা ওয়াজিব। ৩. মহররম মাসের আশুরার ৯ ও ১০ তারিখের ২টি রোযা রাখা সুন্নাত। আরাফা দিবসের জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখের রোযা রাখা সুন্নাত, শাওয়াল চাঁদের ৬ রোযা সুন্নাত। প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখের রোযা সুন্নাত। ৪. নফল রোযা, যেমন শাবানের ১৫ তারিখ শবে বরাতের রোযা, ২৭ রজব শবে মিরাজের রোযা রাখা নফল। ৫.মাকরূহ, স্বামীর বিনা অনুমতিতে নফল রোযা রাখা মাকরূহ, আশুরার একটি রোজা রাখা। এভাবে শুধুমাত্র জুমাবার দিবসে রোযা রাখা মাকরূহ, তবে নির্দ্দিষ্ট কোন তারিখের রোযা। যেমন ১৫ শাবান শবে বরাতের রোযা, ২৭ রজব শবে মেরাজের রোযা ইত্যাদি যদি জুমাবারে এসে যায় তাহলে ঐদিন রোযা রাখা মাকরূহ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন “জুমার দিন তোমাদের জন্য ঈদের দিন, সুতরাং তোমরা ঐ দিন রোযা রেখোনা এর আগের দিন বা পরের দিন রোযা রাখো। (আত্তারগীব ওয়াত তারহীব ২য় খন্ড, পৃ: ৮১, হাদীস ১১)
৬. হারাম রোযা: ইসলামী শরীয়তে নির্দ্দিষ্ট কতগুলো দিনে রোযা রাখা হারাম, যেমন ঈদুল ফিতরের দিন, ঈদুল আযহার দিন, আইয়্যামে তাশরীক তথা জিলহজ্ব মাসে ১১,১২,১৩ জিলহজ্ব তারিখে রোযা রাখা হারাম। (ফাতওয়া–এ রিজভীয়্যাহ, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)
হাদীসের আলোকে শাওয়ালের ছয় রোযার ফযীলত:
ঈদুল ফিতরের মাস পবিত্র শাওয়ালের গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের প্রত্যয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার ঈমানী চেতনা, রমজানের অর্জিত তাকওয়া ও শিক্ষাকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান পরবর্তী শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযার বিধান দিয়ে আমাদের কে আত্মশুদ্ধি ও খোদাভীতি অর্জনের পথ সুগম করে দিয়েছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখবে সে সারা বছর রোযা রাখার সওয়াব লাভ করবে।” (মুসলিম শরীফ)
ইমাম নাসাঈ ইবনে মাযাহ ইবনে খোজায়মা ইবনে হিব্বান প্রমূখ হযরত সওবান (রা.) থেকে ইমাম আহমদ, ইমাম তাবরানী (রা.) হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ঈদুল ফিতরের পর শাওয়ালে ছয় রোযা রাখল সে পূর্ণ বছরের রোযা রাখলো যে একটি নেক কাজ করল সে বিনিময়ে দশটি প্রতিদান পাবে। রমজান মাসের রোযা দশ মাসের সমান এবং শাওয়ালের ছয়দিনের ছয় রোজা দুই মাসের সমান পূর্ণ এক বৎসরের রোযা হয়ে গেল। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৭০)
মাসআলা: ছয় রোযার জন্য কোন দিন নির্দ্দিষ্ট করা নেই। মাসের যে কোন সময় রাখা জায়েজ। উত্তম হলো ছয় রোযা পৃথকভাবে রাখবে। ঈদের পর লাগাতার ছয়দিন এক সাথে রাখলেও কোন ক্ষতি নেই। (বাহারে শরীয়ত)
মাসআলা: শ্রমিক বা কর্মচারী নফল রোযা রাখার কারণে কাজ যদি পূর্ণভাবে করতে না পারে সে ক্ষেত্রে রোযা রাখার ব্যাপারে মালিকের অনুমতি নিতে হবে। আর যদি রোযা রেখে কাজ পূর্ণরূপে করতে পারে সেক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৭)
শাওয়ালের ছয় রোজার ফযীলত সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস:
১. হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে রমজানের রোযা রাখলো, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখল, সে গুনাহ থেকে এমনিভাবে মুক্ত হয়ে যাবে যেনো আজই মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হলো। (মাযমাউয যাওয়ায়িদ, ৩য় খন্ড, হাদীস ৫১০২), ২. যে ব্যক্তি শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখলো সে যেনো সারা বছর রোযা রাখলো, কেননা যে একটা নেকী করবে সে দশটি সওয়াব পাবে। রমজান মাসের রোযা দশমাসের সমান ছয়দিন দুই মাসের সমান, সুতরাং বার মাসের রোযা হয়ে গেলো। (আসসুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী, ২য় খন্ড, হাদীস নং: ২৮৬০,২৮৬১)
গরমের দিনের রোযার ফযীলত:
হযরত ইমাম কাতাদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ওস্তাদ হযরত ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে গালিব হাদ্দানী কে শহীদ করে দেয়া হলো, দাফনের পর তাঁর কবর শরীফ থেকে মিশকের সুগন্ধি বের হলো। স্বপ্নে কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, পরকালে আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়েছে? উত্তর দিলেন খুব ভাল আচরণ করা হয়েছে, জিজ্ঞেস করা হলো আপনাকে কোথায় নেয়া হলো, বললেন জান্নাতে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলের কারণে আপনার এ মর্যাদা নসীব হলো, উত্তর দিলেন কামিল ঈমান, তাহাজ্জদ নামায ও প্রচন্ড গরমের দিনে রোযা রাখার কারণে এ ফযীলত অর্জন হয়েছে। (হিলইয়াতুল আউলিয়া, খন্ড: ৬ষ্ঠ, পৃ: ২৬৬)
হযরত সৈয়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সৈয়্যদুনা আবু মুসা (রা.) কে একটি সামুদ্রিক জিহাদে প্রেরণ করেন অন্ধকার রজনীতে যখন নৌকার পাল উঠিয়ে দেয়া হলো, অদৃশ্য থেকে আওয়াজ এলো, হে নৌকা ওয়ালারা দাঁড়াও! আল্লাহ নিজ দায়িত্বে কি নিয়েছেন আমি কি তোমাদের বলবোনা! হযরত আবু মুসা বললেন, অবশ্যই বলো, সে বললো আল্লাহ তা’আলা নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন যে প্রচন্ড গরমের দিনে রোযা রেখে নিজেকে আল্লাহর জন্য তৃষ্ণার্ত রাখলো, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাকে পানি পান করাবেন। বর্ণনাকারী বলেন, হযরত সৈয়্যদুনা আবু মুসা (রা.)’র অভ্যাস ছিলো যে তিনি প্রচন্ড গরমের দিনে রোজা রাখতেন। (আততারগীব ওয়াত তারহিব, খন্ড: ২য়, পৃ: ৫১)
হে আল্লাহ আমাদের কে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন, আমাদের নামায, রোযা, দান–সাদকাসহ নেক আমলগুলো কবুল করুন। পবিত্র কুরআনের হেদায়ত ও বরকত নসীব করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দানশীল রাজাধিরাজ, পুণ্যবান, অতি দয়ালু ও পরম করুনাময়। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।