জুম্‌’আর খুতবা

মিরাজ রজনীতে সম্মানিত নবীগণের সাথে রাসূলুল্লাহর সাক্ষাত ও আল্লাহর দিদার লাভ

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র আল কুরআনের আলোকে মিরাজ রজনীতে উর্ধ্বগমন: আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূমন্ডল ত্যাগ করে নভোমন্ডল সৌরমন্ডল, অতিক্রম করে আসমানী জগত পরিভ্রমন, মহান আল্লাহর কুদরতের অসংখ্য নিদর্শনাদি অবলোকন পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমানিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর তিনি উচ্চাকাশের সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন। অত:পর ঐ জ্যোতি নিকটবর্তী হলো অত:পর খুব নেমে আসলো।” (সূরা: নজম, পারা:২৭, আয়াত: )

আল্লাহ তা’আলা সূরা নজমে আরো এরশাদ করেছেন, “চক্ষু না কোন দিকে ফিরেছে না সীমাতিক্রম করেছে, নিশ্চয় আপন প্রতিপালকের বহু বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন।” (সূরা: নজম, পারা:২৭, আয়াত: ১৭১৮)

মিরাজুন্নবী সম্পর্কিত ইসলামী আক্বিদা: মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, যা অস্বীকারকারী কাফির। মসজিদে আকসা থেকে আসমান সমূহের পরিভ্রমণ মশহুর হাদীস দ্বারা প্রামনিত, যা অস্বীকারকারী বিদআতী ও ফাসিক হিসেবে গন্য। মিরাজের অন্যান্য বিস্ময়কর ঘটনাবলীর বর্ণনা হাদীসের দ্বারা প্রমানিত যা অস্বীকারকারী মূখর্তার পরিচায়ক। (মুদারিজুন নবুওয়াত, খন্ড: , পৃ: ২৮৭)

হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া দেহলভী বর্ণনা করেন, মসজিদুল হারাম থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ হলো এসরা, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মক্বামে কা’বা কাউসাঈন’র সর্বোচ্চ মকামে দিদারে এলাহী অর্জন হলো এরাজ। (ফাওয়ায়িদুল ফাওয়ায়েদ, খন্ড: , পৃ: ৩৫৮)

মিরাজ রজনীতে কুদরতী ব্যবস্থাপনা: নবুওয়াতের একাদশ বর্ষে রজব মাসের সাতাশ তারিখ সোমবার রজনীতে মিরাজের দুলহা মুস্তফা জানে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে হানি (.)’র ঘরে বিশ্রাম করছিলেন এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে আদেশ করলেন সত্তর হাজার ফিরিস্তাদের বিশাল বহর প্রস্তুত করে নাও। জান্নাত সমূহ সুসজ্জিত করো, জাহান্নামের প্রহরী মালেক কে নির্দেশ করো, দোজখের সবগুলো দরজা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেহেস্তের হুরদের যেন নবসাজে সুসজ্জিত করা হয়। সকল ফিরিস্তারা যেন মিরাজের দুলহা নবী মুস্তফার প্রতি যথার্থ সম্মান ও অভ্যর্থনা প্রদর্শনে চুড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে, ইসরাফিল ফিরিস্তা সিংগায় ফুক দিবেনা। আজরাঈল ফিরিস্তা আজ রাতে কোন সৃষ্টির প্রাণ কবজ করবেনা। পৃথিবীর সকল কবরে আজকের রাতের আযাব যেন তুলে নেওয়া হয়। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল সম্মানিত নবী রাসূলগণ যেন মিরাজ রজনীর দুলহার সংবর্ধনা ও অভ্যর্থনা জ্ঞাপনে প্রস্তুত হয়ে যায়। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম সত্তর হাজার ফিরিস্তা গণের বিশাল জামাতসহ বোরাক সংগ্রহের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করলেন। জান্নাতে চল্লিশ হাজার বোরাক দেখতে পেলেন। প্রতিটি বোরাকের কপালে “মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” লিপিবদ্ধ ছিল। একটি বোরাক কে মস্তক অবনত করে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরত দেখতে পেলেন, হযরত জিবরীল (.) নিকটবর্তী হলেন, ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন, বোরাক জবাব দিলেন, চল্লিশ হাজার বৎসর পূর্বে শ্রবন করেছি হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীদের সরদার মিরাজ পরিভ্রমণ করবেন। আমার একমাত্র আশা ও প্রার্থনা আমাকে যেন মাহবুবে খোদার বাহন হিসেবে নির্বাচন করা হয়। নবীজির প্রতি ভালোবাসায় আমি ক্রন্দন করছি, নবীজির প্রতি বোরাকের এ ভালোবাসা দেখে আমি নবীজির বাহন হিসেবে এ বোরাক কে পছন্দ করেছি। (মুআরিজুন নবুওয়ত, খন্ড: , পৃ: ১১৪)

বুরাকের বর্ণনা: বোরাকটি ছিল গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চরের চেয়ে ছোট। এটির গতি এমন শক্তিশালী ছিল দৃষ্টি সীমায় নিজের কদম রাখতো, উপরে উঠার সময় বোরাকের হাত ছোট এবং পা লম্বা হয়ে যেতো, আর নীচে অবতরনের সময় হাত লম্বা ও পা ছোট হয়ে যেতো, যার কারনে উভয় ক্ষেত্রে তার পিঠ সমান থাকতো, এতে আরোহীর কষ্ট হতো না। (বুখারী: হাদীস: ৩৮৮৭, তিরমিযী, হাদীস: ৩১৩১)

মসজিদুল আকসায় নবীজির ইমামত: বোরাক যোগে নবীজি বায়তুল মুকাদ্দাস পৌছেন হযরত জিবরীল (.) বোরাক কে মসজিদুল আকসার দরজার সন্নিকট একটি পাথরের ছিদ্রে বোরাক বাঁধলেন, এ দরজা টি “বাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” নামে পরিচিত (মুসলিম, খন্ড: , পৃ: ৯১)

নবীজি মসজিদে আকসায় তাশরীফ নিলেন, এদিকে হযরত আদম (.) থেকে হযরত ঈসা (.) পর্যন্ত সমগ্র আম্বিয়ায়ে কেরাম নবীজির প্রতি সাদর সম্ভাষণ ও অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য অপেক্ষামান। সম্মানিত নবীগন মিরাজের দুলহা নবীজির দর্শন লাভ করে মহান আল্লাহর গুনগান ও প্রশংসা করলেন এবং নবীজির সম্মানে দরুদ সালাম পেশ করলেন, সম্মানিত নবীগন আমাদের মহান নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও অতুলনীয় মর্যাদার স্বীকারোক্তি প্রদান করলেন। (মদারেজুন নবুওয়ত, পৃ: ২৯৫)

মিরাজ রজনীতে নবীজির সাত আসমান পরিদর্শন: আরশের প্রধান মেহমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্‌্যলাম’র আকাশ ভ্রমন শুরু হল প্রথম আসমানে হযরত আদম (:)’র সাক্ষাৎ হলো, হযরত আদম (.) কর্তৃক নবীজিকে সালাম জানানো হলো, আদম (.) মারহাবান মারহাবা জানিয়ে অভিবাদন জ্ঞাপন করলেন নবীজিও হযরত আদম (.)কে সালাম পেশ করলেন। (মুসলিম শরীফ, খন্ড: , পৃ: ৯৩)

অত:পর আরশের মেহমান নবীজি দ্বিতীয় আসমানে তাশরীফ নিলেন এখানে হযরত ইয়াহিয়া (.) ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম’র সাথে সাক্ষাৎ হলো, তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (.)’র সাক্ষাৎ হলো, চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস (.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (.) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম আলাইহি সালাম’র সাথে সাক্ষাৎ হলো, নবীজি হযরত ইবরাহীম খলিল আলাইহিস সালামকে সালাম দিলেন, তিনি সালামের জবাব দিলেন, বললেন, আপনার শুভাগমন বরকতমন্ডিত হোক। (রুহুল বয়ান, খন্ড: , পয়গামে মিরাজ, পৃ: ১৬৫, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:২য়, পৃ: ৪২৯)

সিদরাতুল মুনতাহা গমন: মিরাজের দুলহা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি সিদরাতুল মুনতাহা দেখেছি। সিদরা হচ্ছে একটি কুল বৃক্ষ (বড়ই গাছ) যার শিকড় ষষ্ট আসমানে ডাল পালা সপ্তম আসমানের উপর, এর পাতা হাতির কানের মতো, এবং এর ফল মটকার মতো, (মুসলিম, খন্ড: , পৃ: ৯১)

সিদরাতুল মুনতাহার সন্নিকটে রয়েছে বায়তুল মামুর, নবীজি বায়তুল মামুরে তাশরীফ নিলেন, সেখানে সত্তর হাজার নূরানী ফিরিস্তারা নবীজিকে মুবারকবাদ ও স্বাগতম জানালেন, বায়তুল মুকাদ্দাসে আম্বিয়ায়ে কেরামের ইমাম হলেন, আর বায়তুল মামুরে ফিরিস্তাদের ইমাম হলেন। (রুহুল বয়ান, খন্ড: , পয়গামে মিরাজ, পৃ: ১৬৫)

ফিরিস্তাদের কা’বার নাম বায়তুল মামুর: এটা খানায়ে কা’বার বরাবর আসমানে বায়তুল মামুর অবস্থিত। মানবজাতি যেবাবে কা’বা শরীফের তাওয়াফ করে থাকেন, অনুরূপভাবে ফিরিস্তাগন বায়তুল মামুরে তাওয়াফ করে থাকেন, দৈনিক সত্তর হাজার ফিরিস্তা বায়তুল মামুরের যিয়ারত করেন। (মুদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড: , পৃ: ৩০১)

হযরত ইমাম কুস্তুলানি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কোনো রাসূল সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করতে পারেনি। (মওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড: , পৃ: ২৫)

এটা এমন স্থান যতদূর গিয়ে জিবরীল আলাইহিস সালাম’র যাত্রা থেমে যায় তিনি নবীজির খিদমতে আরজ করেন আমি আর সম্মূখপানে অগ্রসর হতে পারিনা। আমি এ স্থান অতিক্রম করলে ভস্মীভূত হয়ে যাব। (মওয়াহেবে লুদুনীয়া, খন্ড: , পৃ: ২৯)

নবীজির খিদমতে “রফরফ” বিশেষ বাহন: হযরত জিবরীল (.) ও বোরাকের গতি সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল, নবীজির খিদমতে “রফরফ” নামক বিশেষ বাহন উপস্থিত করা হলো, যেটি ছিল সবুজ রং এর তাঁর জ্যোতি সূর্যের আলোর চেয়েও জ্যোতিময়, নবীজি রফরফে আরোহন করে আরশে আজিমে তাশরীফ নিলেন। (মুআরিজুন নবুওয়াত, খন্ড:, পৃ: ১৫২, আনোয়ারে মোহাম্মদীয়া, পৃ: ৩৪৮)

নবীজি কর্তৃক আল্লাহর দর্শন: নবীজি কপালের চোখে আল্লাহকে দেখেছেন। তাফসীরে “সাভীতে” উল্লেখ হয়েছে, নবীজি স্বীয় কপালের চোখে আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন, এটা জমহুর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের অভিমত। (তাফসীরে সাভী, পারা, ২৯, পৃ: ১১৬)

হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় প্রভূকে দেখেছেন। (উমদাতুলকারী, শরহে বোখারী, খন্ড: ১৯, পৃ: ১৯৮, ফাতহুল বারী, খন্ড: , পৃ: ৬০৮)

ইমাম সম্পর্কে ইমাম কুস্তুলানীর অভিমত: জাগ্রতাবস্থায় স্বশরীরে নবীজির মিরাজ হয়েছিল একবার। রুহানীভাবে স্বপ্ন আকারে মিরাজ হয়েছিল ৩৪ বার। (আল মাওয়াহিবুল্লুদুনীয়া, খন্ড: , পৃ: ৩৪১)

আল্লাহ তা’আলা নবীজি কর্তৃক উম্মতের জন্য আনীত মিরাজের উপহার পাঁচ ওয়াক্ত নামায সঠিকভাবে আদায় করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ তাসলীম উদ্দিন

মির্জাখিল, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মিরাজ রজনীতে ইবাদত বন্দেগী করার ব্যাপারে কোন নির্দেশনা জানালে কৃতার্থ হব

উত্তর: বরকতময় রজনী সমূহে নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত, অধিক পরিমান দরুদ শরীফ পাঠ ও দান সাদকা ইত্যাদি নেক আমল করলে অধিক পরিমান সওয়াব রয়েছে। হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রজবের সাতাশ তারিখ রজনীতে ইবাদতকারীর জন্য শত বৎসরের ইবাদত করার সওয়াব রয়েছে, যে ব্যক্তি এ রাতে বার রাকা’আত নামায আদায় করবে প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতেহা পড়ে অন্য সূরা পাঠ করবে প্রতি দ্বিতীয় রাকা’আতে তাশাহুদ পড়ে দরুদ শরীফ পাঠের পর সালাম ফিরাবে। এভাবে বার রাকা’আত নফল নামায পড়ার পর একশত বার “সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর” পড়বে অত:পর একশতবার আসতাগফিরুল্লাহ এবং একশতবার দরুদ শরীফ পাঠ করবে এবং প্রার্থনা করবে দিনের বেলা রোজা রাখবে নি:সন্দেহে আল্লাহ তা’আলাহ তার সর্ব প্রকার দুআ কবুল করবেন। তবে শর্ত হলো কোন প্রকার গুনাহের কাজে লিপ্ত হবেনা। (এয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড: , পৃ: ৩৭১, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ৪৪৯), হযরত আবু উসামা (রা.) বর্ণিত, হাদীসে রজব মাসের প্রথম রাতকে দুআ কবুলের পাঁচ রাতের এক রাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (মুকাশিফাতুল কুলুব(আরবি), পৃ: ১৪৯, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:, পৃ: ৪৫০)

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের আব্বা এডভোকেট বদিউল আলম এর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু স্মৃতি কথা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে