জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে হাদীসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
হাদীস শব্দের ব্যাখ্যা:
হাদীস শব্দটি একবচন, বহুবচনে আহাদীস, এর অভিধানিক অর্থ কথা বলা, সংবাদ বর্ণনা, ঘটনা প্রবাহ, ইত্যাদি। (আল মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন: পৃ: ১০৮)

আল কুরআনে হাদীস শব্দের ব্যবহার:
পবিত্র কুরআনের বহুস্থানে হাদীস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আপনি আপনার প্রভূর নিয়ামতের কথা বর্ণনা করুন। (সূরা: দুহা, আয়াত: ১১)

পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, আপনার নিকট কি মুসা (আ:) এর সংবাদ এসেছে। (সূরা: নাযিয়াত, আয়াত: ১৫)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, আপনার নিকট কি সবকিছু আচ্ছন্নকারী কিয়ামতের সংবাদ এসেছে। (সূরা: গাশিয়াহ, আয়াত: ১)

হাদীসের পারিভাষিক সংজ্ঞা:
বিশ্বের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদগণ হাদীস শাস্ত্রের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় বিভিন্ন সংজ্ঞা উপস্থাপন করেন, প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হযরত শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (র.) মৃত, ১৩৫০/১৯৩১ বর্ণনা করেন, অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কথা কাজ ও মৌন সম্মাতিকে, অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কেরামের কথা কাজ ও মৌন সম্মতি এবং তাবেঈগণের কথা কাজ ও মৌন সম্মতিকে হাদীস নামে অভিহিত করা হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস গ্রন্থের মুকাদ্দিমা, পৃ: ৩)

আল্লামা আবদুর রহমান আস-সাখাভী (র.) (মৃত: ৯০২ হিজরি) এর বর্ণনা মতে হাদীস হলো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পর্কিত কথা কাজ মৌন সম্মতি এবং তাঁর গুণাবলী এমনকি জাগ্রত ও নিদ্রাবস্থায় নবীজির চাল-চলন, উঠা, বসা চলাফেরা সার্বিক গতিবিধি এর অন্তর্ভূক্ত। (ফাতহুল মুগীস, ১ম খন্ড, পৃ: ৮)

আল কুরআনের আলোকে হাদীসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা:
ইসলামী জীবন বিধানের প্রধান উৎস হল আল কুরআন, এতে রয়েছে মানবজাতির ইহলৌকিক পরলৌকিক, জাগতিক আধ্যাত্নিক, ব্যক্তি পরিবার সমাজ রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার নির্দেশনা, ইসলামের প্রতিটি বিধি বিধান যথা ঈমান, আক্বিদা, নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ, বিয়ে শাদী, তালাক, ব্যবসা বাণিজ্য, লেনদেন, অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য চিকিৎসা বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা এর বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত, হাদীস শরীফে। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের ৮২ জায়গায় বলেছেন, নামায কায়েম করো, কিন্তু নামাযের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে রাসূলুল্লাহর ব্যবহারিক জীবনের আমলে, যা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমানিত। এ কারণে কুরআনের উপর আমল করার জন্য হাদীস শরীফের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কুরআনের নির্র্র্র্র্দেশ বাস্তবায়নের জন্য রাসূলুল্লাহর প্রদর্শিত জীবন-কর্মই আমাদের জন্য অনুসরনীয় আদর্শ যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত:
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন, তা তোমরা গ্রহণ কর যা তোমাদের নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাক। (সূরা: হাশর, আয়াত: ৭)

আল কুরআন প্রত্যক্ষ, ওহী আল হাদীস পরোক্ষ ওহী:
ওহী দুই প্রকার। ওহীয়ে মতলু প্রত্যক্ষ ওহী, আল্লাহ তা’আলা জিবরাঈল (আ:) এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর যে ওহী নাযিল করেছেন, তন্মধ্যে এক প্রকার হলো ওহীয়ে মতলু প্রত্যক্ষ ওহী, যা কালামুল্লাহ আল্লাহর কিতাব রূপে আমাদের সামনে বিদ্যমান, যা নামাযে তিলাওয়াত হয়। এর ভাব ও ভাষা উভয়টিই আল্লাহর। নবীজি তা হুবহু প্রকাশ করেছেন, ওহীয়ে গায়রে মাতলু তথা পরোক্ষ ওহী হল সুন্নাহ যা আল হাদীস, এর ভাব আল্লাহর কিন্তু নবীজি তা-নিজের কথায় ভাষায় প্রকাশ করেছেন, যা নামাযে তিলাওয়াত হয় না। প্রথম প্রকার ওহী নবীজির উপর সরাসরি নাযিল হত, যা সাহাবায়ে কেরাম উপলব্ধি করতে পারতেন, দ্বিতীয় প্রকার ওহী প্রচ্ছন্নভাবে নাযিল হতো অন্যরা তা উপলব্ধি করতে পারত না। হাদীস শরীফ ও ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত তা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমানিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর তিনি (নবী) মনগড়া কথাও বলেন না এ তো ওহী যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। (৫৪-সূরা নাজম, ৩-৪)

নবীজির অনুসরণে হাদীসের গুরুত্ব:
একজন মুসলমান নবীজির অনুসরন ও ভালোবাসা ব্যাতিরেকে কখনো পরিপূর্ণ মু’মিন হতে পারে না, হাদীস হলো রাসূলুল্লাহকে অনুসরণের অন্যতম অবলম্বন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে রাসূল! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসেন। এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (৩ সূরা আলে ইমরান:৩১)

হাদীস হলো রাসূলুল্লাহর জীবনাদর্শের বিবরণী:
নবীজির বাল্যকাল যৌবনকাল মক্কী জীবন মদনী জীবন, সততা, ন্যায়পরায়নতা, উদারতা, ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ, কাফির মুশরিকদের প্রতি উদারনীতি ও ক্ষমা প্রদর্শন, ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলীর বিস্তৃত বর্ণনার এক অভ্রন্ত দলীল হলো হাদীস শরীফ। নবীজির সমগ্র জীবনের পূর্নাঙ্গ বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে হাদীস শরীফে। রাসূলুল্লাহর জীবনাদর্শের অনুসরণ পক্ষান্তরে হাদীসের অনুসরণ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীতে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (৩৩ সূরা: আহযাব: ২১)

নবীজির আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের নামান্তর:
আল্লাহর বানী আল কু্‌রআন, নবীজির বানী হাদীসের নিদের্শনা মেনে চলা মূলত: আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা, নবীজির নির্দেশের বিরোধীতা করা অবজ্ঞা করা, অসম্মান করা ও উপেক্ষা করা মূলত: আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার নামান্তর। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রাসূলের হুকুম মান্য করল সে আল্লাহর হুকুম মান্য করল। (৪-সূরা, নিসা:৮০)

হাদীস তথা সুন্নাহ অনুসরণকারী ব্যক্তি কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা:
কুরআন সুন্নাহ তথা আল্লাহর নির্দেশিত রাসূলুল্লাহর প্রদর্শিত সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথই মুসলমানদের মুক্তির পথ। কুরআন সুন্নাহর পথে মতে বিশ্ব মুসলিমের সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি মুক্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত। রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ তোমরা ঐ দুটো আকড়ে ধরবে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাত তথা হাদীস। (মুআত্তা, পৃ: ৩৬৩)

হাদীস অনুসরনের অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে নবীজি এরশাদ করেছেন, তোমাদের উপর আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবলম্বন অপরিহার্য। তা দূঢ়ভাবে আকড়ে ধরো, তা দাঁত দ্বারা মজবুত ভাবে চেপে ধরো। (আবু দাউদ, ২:৬৩৫)

হাদীস সংরক্ষণে খলিফা হযরত ওমর ইবন আবদুল আযীয এর নির্দেশ:
হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষে হযরত ওমর ইবন আবদুল আযীয প্রাদেশিক গভর্ণরদেরকে লিখিতভাবে হাদীস সংরক্ষণের জন্য পত্র যোগে নির্দেশ জারী করেছেন, তিনি বলেন, “তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দাও, এবং তা সংগ্রহ ও সংকলন কর, তিনি মদীনার গভর্ণর আবু বকর ইবন হাযমকে পত্র মারফত নির্দেশ করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস তথা সুন্নাহ অথবা ওমর (রা.)’র হাদীস অথবা অনুরূপ বা পাওয়া যায় তার প্রতি দৃষ্টি দাও। এটা আমার জন্য লিখে নাও, কেননা আমি জ্ঞান নিশ্চিন্থ হওয়া এবং আলিমগনের মারা যাওয়ার আশংকা করছি। (মুকাদ্দামাতু তানবীরুল হাওয়ালীম, পৃ: ৬)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) (মৃত, ২৪১/৮৫৫) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় সুন্নাহ তথা হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী এবং কুরআনের বাণীর ভাষ্যকার। আমাদের জীবন চলার পথে হাদীসের গুরুত্ব অপরিহার্য। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন ও হাদীসের আলোকে জীবন পরিচালিত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান সোহেল
বুড়িশ্চর, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: হাতের ও পায়ের নখ কাটার বিধান সম্পর্কে ইসলামী নিয়ম জানালে কৃতার্থ হব।
প্রশ্নের উত্তর: শুক্রবার জুমার আগে নখ কাটা উত্তম। কমপক্ষে পনের দিনে একবার নখ কাটা উচিত। তবে চল্লিশ দিনের অতিরিক্ত দেরী করা না জায়েজ ও মাকরূহে তাহরীমি। কর্তিত নখ বাথরুমে, টয়লেটে ফেলা মাকরূহ, এতে রোগ সৃষ্টি হয়। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, খন্ড-২২, পৃ: ৫৭৪, ফতোওয়ায়ে হিন্দিয়া, খন্ড:৫, পৃ: ৩৫৭)
হাতের নখ কাটার নিয়ম হলো প্রথমে ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল থেকে শুরু করা ও কনিষ্টা আঙ্গুলে শেষ করা, বাম হাতের কনিষ্টা আঙ্গুল থেকে শুরু করে ধারাবাহিক ভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলের নখ কাটবে। সবশেষে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের নখ কাটবে। (দুররে মুখতার, খন্ড: ০৯, পৃ: ৬৮০)
পায়ের নখ কাটা ডান পায়ের কনিষ্টা আঙ্গুল থেকে শুরু করে বাম পায়ের কনিষ্টা আঙ্গুলে শেষ করবে। (ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, খন্ড: ১ম, পৃ: ১৯৩)
সদরুশ শরীয়্যাহ আল্লামা আমজাদ আলী বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন নখ কাটবে তার গুনাহ দূরীভূত হবে। রহমতের আগমন হবে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ১৬, পৃ: ২২৬)
দাঁত দ্বারা নখ কাটা মাকরূহ। এতে শ্বেত রোগ হওয়ার আশংকা রয়েছে। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরি, খন্ড: ০৫, পৃ: ৩৮৫)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরআন তেলাওয়াতের মর্যাদা ও বিশ্লেষণ (পর্ব-২)
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে