জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভী | শুক্রবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

এশার নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

আল কুরআনের আলোকে এশার নামায: আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করো।” (সূরা: ইসরা: ১৭, আয়াত: ৭৮)

বর্ণিত আয়াতে চার ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশ এসেছে, যোহর, আসর, মাগরীব ও এশা, কারণ এ চার ওয়াক্তের নামায সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর থেকে রাতের শেষ ভাগ পর্যন্ত পড়া যায়। (তাফসীর নূরুল ইরফান, পারা-১৫, আয়াত: ৭৮, সংশ্লিষ্ট তাফসীর)

হাদীস শরীফের আলোকে এশার নামাযের ফযীলত: এশার নামাযের ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সকলের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করা হলো। এরশাদ হয়েছে, হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার নামায আদায় করল তার জন্য অর্ধরাত নামায আদায়ের সওয়াব রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এশা ও ফজরের নামায জামাত সহকারে আদায় করবে সমপরিমান সওয়াব রয়েছে। (তিরমিযী, হাদীস:২২১, আবু দাউদ, হাদীস: ৫৫৫)

এশার নামায উম্মতে মোহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত মু’আয ইবনে জবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ওই নামাযকে দেরীতে পড়ো। কেননা তোমাদের কে সেটার কারণে সমস্ত উম্মতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। তোমাদের পূর্বে এ নামায অন্য কোন উম্মত পড়েনি। (আবু দাউদ)

বর্ণিত হাদীস শরীফে এশার নামাযের কথা বুঝানো হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত সকল উম্মতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এ শ্রেষ্ঠত্বের অসংখ্য কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো এশার নামায লাভ করা। উল্লেখ্য যে পূর্ববর্তী কোনো নবীর উম্মতের উপর এশার নামায ফরজ ছিল না। অবশ্য কোন কোনো নবী তা নফল হিসেবে পড়েছেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন হযরত মুসা কলিমুল্লাহ আলাইহিস সালাম সীনা উপত্যাকা থেকে ফিরে এসে আপন স্ত্রী হযরত সফুরা (রা.) কে সুস্থ ও নিরাপদ অবস্থায় পেয়ে শোকরিয়া হিসেবে এশার নামায পড়েছিলেন। (মিরআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৪২)

বিধিবদ্ধ ফরজ হিসেবে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বপ্রথম এশার নামায আদায় করেছেন। (তাহাবী শরীফ)
এশার নামায বিলম্বে আদায় করা মুস্তাহাব: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের জন্য কষ্ঠ সাধ্য না হলে আমি তাদের নির্দেশ প্রদান করতাম তারা যেন এশার সালাত রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বা মধ্যরাত পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়। (তিরমিযী, “ফিকহুস সুনা’নি ওয়াল আছার” কৃত: আল্লামা মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান)

বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুমতিক্রমে শরীয়তের বিধি-বিধানের ব্যাপারে ইখতিয়ার প্রাপ্ত ও ক্ষমতা প্রাপ্ত। এ ছাড়াও বিলম্বে পড়ার হিকমত হলো যেন নামাযের জন্য অপেক্ষার সওয়াব লাভ করতে পারে। যেন এর পরে অধিক কথাবার্তা বলার সময় না থাকে, এবং তাৎক্ষনিকভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। [মিরআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৪১ কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]

এশার নামাযের আগে নিদ্রা যাওয়া ও পরে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা মাকরূহ: হযরত আবু বারযাহ রাদ্বিয়াল্লাহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার আগে নিদ্রা যাওয়া ও এশার পর (অপ্রয়োজনীয়) কথাবার্তা বলা অপচন্দ করতেন। (বুখারী ও মুসলিম)

এশার পর গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলা যাবে। এশার নামাযের পর রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কথাবার্তা বলতেন মর্মে হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায় এরশাদ হয়েছে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর (সিদ্দিক) রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাত জেগে কথাবার্তা বলতেন এবং আমিও তাদের উভয়ের সাথে থাকতাম। (তিরমিযী)
পাঁচ ওয়াক্তের নামায বান্দার গুনাহ সমূহ মিটিয়ে দেন: মানুষ ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সকাল সন্ধ্যা দিবা-রাত্রি আল্লাহর নাফরমানি, অবাধ্যতা, অন্যায়, পাপাচার, মিথ্যাচার, শটতা, কপটতা ও গর্হিত অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ করে চলছে, খোদায়ী বিধান লংগন করছে, নবীজির সুন্নাত পরিত্যাগ করছে, পরের হক ধ্বংশ করছে, অন্যের মাল সম্পদ আত্নসাৎ করছে, ব্যবসা বানিজ্যে ভেজাল ও দূনীতির মাধ্যমে অহরহ গুনাহের কাজ ও অপকর্ম করে যাচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে অশ্লীলতা ও মন্দকার্য থেকে বিরত রাখার জন্য নামাযের মতো উৎকৃষ্ট নিয়ামত দান করেছেন। বান্দা যখন একনিষ্টভাবে আল্লাহর ইবাদত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাবন্দী করবে আল্লাহ তা’আলা বান্দার গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে তোমাদের কারো বাড়ীর সম্মূখে যদি একটি প্রবাহমান নহর থাকে আর তার মধ্যে সে প্রত্যেহ পাঁচবার গোসল করে তাহলে ঐ ব্যক্তি শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি? সাহাবাগণ উত্তর দিলেন তার শরীরে কোন ময়লাই অবশিষ্ট থাকবেনা। অত:পর তিনি বলেন, পাঁচওয়াক্ত নামাযের উদাহরণ ও তদ্রুপ। আল্লাহ তা’আলা এ নামাযের মাধ্যমে বান্দার গুনাহ সমূহ মিটিয়ে দেন। (বুখারী, মুসলিম)

এশার নামাযের ওয়াক্ত: মাগরীবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর থেকে এশার নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। এবং সুবহে সাদিক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এশার নামায রাতের এক তৃতীয়ংশ সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা মুস্তাহাব। (আলমগীরি ১ম খন্ড, ও শামী, ফাতওয়া-ই রিজভীয়্যাহ, ২য় খন্ড, পৃ: ২২৬)

এশার নামাযের রাক’আত সংখ্যা: এশার নামায মোট ১২ রাক’আত। প্রথমে ৪ রাক’আত সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ, ৪ রাক’আত ফরজ, সুন্নাতের মুয়াক্কাদাহ ২ রাক’আত, নফল ২ রাক’আত।

মাসআলা: ফরজের পূর্বে ৪ রাক’আত সুন্নাতের নিয়্যত করা হলো, এমতাবস্থায় জামাআত শুরু হয়ে গেল দু রাকাত সুন্নাত আদায় করে জামাতে শামিল হয়ে যাবে। বাদ পড়া দু রাক’আত সুন্নাত পুনরায় পড়ার দরকার নেই। (ফাতওয়া-ই রিজভীয়্যাহ, খন্ড:৩য়, পৃ: ৬১১)

নফল নামায বসে পড়া জায়েজ, দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। দাঁড়িয়ে নামায পড়ার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নফল নামায বসে পড়া জায়েজ। তবে দাঁড়িয়ে পড়া উত্তম। এশার নামাযের শেষ দু রাক’আত নফল আদায়ে দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে। (ফাতওয়া রিজভীয়্যাহ, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৪৬১)

মাসআলা: এশার নামাযের পূর্বের চার রাক’আত সুন্নাত না পড়ে ফরজের পর পড়ার ইচ্ছা করলে ফরজের পর যে দু রাক’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ রয়েছে তা আদায় করার পর পূর্বের ৪ রাক’আত সুন্নাত পড়ার অনুমতি রয়েছে। (মু’মীন কী নামায, ফাতওয়া-এ রিজভীয়্যাহ, ৩য় খন্ড, পৃ: ৭১৬)

মাসআলা: রমজান মাসে যে ব্যক্তি জামাত সহকারে এশা পড়তে পারেনি সে ব্যক্তি বিতর নামাযও জামাত সহকারে পড়বে না। যে ব্যক্তি একাকী এশার ফরজ নামায পড়েছে সে বিতর নামাযও একাকী আদায় করবে। (ফাতওয়া-এ রিজভীয়্যাহ, খন্ড:৩, পৃ: ৪৮১)

মাসআলা: এশার নামায পড়ার আগে নিদ্রা যাওয়া মাকরূহ। এশার নামাযের পর দুনিয়াবী কথাবার্তা বলা, গল্প গুজব করা বা শ্রবণ করা মাকরূহ। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১)

মাসআলা: হজ্বের সময় মুযদালাফার ময়দানে মাগরীব ও এশা দুই ওয়াক্তের নামায এশার সময়ে পড়তে হবে। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১)

হে আল্লাহ! আমাদের কে তোমারই স্মরণে পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথ ভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ মসউদুল আলম
কমল মুন্সির হাট, পটিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: বর্তমানে দাঁড়িয়ে পানাহার করা ও বাম হাতে পানাহার করাকে অনেকে আধুনিক তা মনে করে এ বিষয়ে ইসলাম কী বলে? জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: ইসলাম পানাহার প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট নীতিমালা দিয়েছে। দাঁড়িয়ে পানাহার করা ইসলাম সমর্থন করেনা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। হযরত কাতাদাহ বলেন, আমরা হযরত আনাস (রা.) কে বললাম, তাঁহলে দাঁড়িয়ে আহার করা? তিনি বললেন সেটি তো আরো মন্দ কিংবা আরো নিকৃষ্ট। (সহীহ মুসলিম সূত্র: রিয়াদুস সালিহীন, পৃ: ৩২২)
অনুরূপ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাম হাতে কোন কিছু আহার করতে নিষেধ করেছেন। নবীজি এরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ কখনো বাম হাতে আহার করবেনা। কিংবা বাম হাতে পান করবেনা। কারণ শয়তান বাম হাতে আহার করে ও বাম হাতে পান করে। (সহীহ মুসলিম সূত্র: রিয়াদুস সালিহীন, পৃ: ৫৮২)
সকল ভালকাজ ডানদিক থেকে শুরু করা রাসূলুল্লাহর নিকট পছন্দনীয় ছিল। (রিয়াদুস সালিহীন, পৃ: ৩১০)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরআন তেলাওয়াতের মর্যাদা; একটি বিশ্লেষণ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে