আল্লাহর অলিদের মর্যাদা: আল্লাহর স্মরণ প্রসঙ্গ
পবিত্র কুরআনের আলোকে অলিদের মর্যাদা: অলী শব্দ আরবি, এটি একবচন, বহুবচন আউলিয়া, এর কয়েকটি অর্থ রয়েছে ১. বন্ধু, ২. নৈকট্য ধন্য, ৩.সাহায্যকারী, ৪. অনুগত ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে তাঁদের মর্যাদা ও পরিচয় সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে, মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর অলীদের অতীত ও ভবিষ্যতের কোন চিন্তা নেই। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকাওয়া অবলম্বন করেছে ইহকাল ও পরকালে তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। (আল কুরআন, সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৬২-৬৪)
বর্ণিত আয়াতে অলীদের দুটি বিশেষ গুণ বর্ণিত হয়েছে, প্রথমত: তাঁরা হবেন পূর্ণাঙ্গ মুমিন, তাঁদের জীবনাদর্শ হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মনোনীত শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণের প্রতিচ্ছবি। দ্বিতীয়ত: তাঁরা হবেন তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত। খোদাভীতি অর্জন ও আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সকল প্রকার মন্দ ও শরীয়া বিবর্জিত কর্ম থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখা অলীদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
হাদীস শরীফের আলোকে অলিদের পরিচয় ও ভূমিকা: আল্লাহ ও তদীয় রসূলের অনুগত্য করুন, আল্লাহর অলীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করুন, অসংখ্য হাদীসে তাঁদের মর্যাদা ও পরিচয় আলোকপাত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর অলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে নবীজি এরশাদ করেন, যাঁদের দর্শনে আল্লাহর স্মরণ হয়। (নাসাঈ শরীফ, হাদীস ১১২৩৫)
হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সংবাদ দিব না? তাঁরা বললেন হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীজি এরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ট হলেন তাঁরা যাঁদের দেখলে মহান আল্লাহর স্মরণ হয়। (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং: ৪১১৯, মুসনাদে আহমদ: হাদীস : ২৭৬৪০)
বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বয়ে প্রকৃত আল্লাহর অলীদের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে। হযরত শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দেস দেহলভী (র.)’র বর্ণনা মতে প্রকৃত শায়খ বা মুরশিদগন মুরাকাবা মুশাহাদার মাধ্যমে মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার নূর বা জ্যোতি প্রাপ্ত হন। তাঁদের সান্নিধ্যে এলে আল্লাহর স্মরণ অন্তরে জাগ্রত হয়। আত্না পরিশুদ্ধ হয়। হাদীস শরীফে অলী আল্লাহর পরিচয় প্রসঙ্গে উল্লেখ হয়েছে তাঁরা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনকারী হয়ে থাকেন। আল্লাহর অলী তাঁরাই যাঁদের সুহবতে বসলে যাদের প্রদশির্ত পথে চললে, মানুষ আল্লাহর দ্বীনের পথিক হয়ে যায়। বদকার মানুষ নেককার হয়ে যায়, বেনামাযী নামাযী হয়ে যায়। অসৎ মানুষ সৎ ও আদর্শ মানুষে পরিণত হয়। আউলিয়ায়ে কেরামের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী সহীহ বিশুদ্ধ আক্বিদার অনুসারী তরীক্বতের শায়খ পীর মুর্শিদের প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনাকারী ব্যক্তিবর্গ অন্যায় ও অনৈতিক শরীয়ত পরিপন্থি কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকতে পারেনা। মুসলিম শরীফে অলী আল্লাহর পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে যে, অলীগণ এমন শ্রেণিভূক্ত সম্প্রদায় যাঁদের সুহবত অর্জনকারী তাদের মজলিসে অবস্থানকারী ব্যক্তিগন পাপী থাকেনা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয় না। [(মুসলিম শরীফ, খ.৭, পৃ: ১৯৯ ইফা) আল কাউলুল জামীল কৃত: শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.), পৃ: ৬০]
হুযুর গাউসুল আযম দস্তগীরের মজলিসে হাজার হাজার মানুষ আল্লাহর স্মরণে বিভোর হয়ে যেত: শাহেন শাহে বাগদাদ গাউসুল আযম দস্তগীরের নুরানী তকরীরের প্রভাব এতো ব্যাপক কার্যকর ছিলো: হাজার হাজার গুনাহগার, বদকার, পাপী তাপী, বান্দারা তাঁর নুরানী হাত মুবারকে তাওবা করে দ্বীনদ্বার পরহেজগার নেককার বান্দাতে পরিণত হয়েছে। তকরীরের তাছীর প্রভাব এমন শক্তিশালী ছিলো অসংখ্য মানুষ ঈমানী চেতনা ও জযবায় উজ্জীবিত হয়ে প্রেমসাগরে বিমোহিত হয়ে পড়তো। মাহফিলের রুহানিয়্যাতের অবস্থা এতো উচ্চমার্গের আধ্যাত্নিকতায় উপনীত হতো, মাহফিল শেষে দেখা যেত জযবার হালতে অনেকে বেহুশ হয়ে যেত, অনেকগুলো জানাযা প্রস্তুত হয়ে যেতো। গাউসে পাকের তকরীরে মুসলমান ছাড়াও অসংখ্য ভিন্ন ধর্মাবলম্বী উপস্থিত হতো, অসংখ্য কাফির মুশরিক, ইয়াহুদী খৃষ্টান কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যেতো। (বাহযাতুল আসরার, পৃ: ২৮১, কালায়েদুল জাওয়াহির, পৃ: ২১২)
ফেরেস্তাগণও অলিদের সম্মান করে: হুযুর গাউসে আযম দস্তগীর বর্ণনা করেছেন, দশ বৎসর বয়সে আমি আমার বেলায়ত সম্পর্কে জানতে পেরেছি আমি যখন মক্তবে যাতায়াত করতাম রাস্তায় চলার পথে আমার পিছনে পিছনে ফেরেস্তা দৃষ্টিগোছর হতো, আমি যখন মক্তবে পৌছে যেতাম ফেরেস্তারা বলতে শুনতাম তোমরা আল্লাহর অলীর জন্য বসার জায়গা করে দাও, এ আওয়াজ মক্তবে উপস্থিত সকলে শুনতে পেতেন। (বাহযাতুল আসরার, পৃ: ৪৭, যুবদাতুল আছার, পৃ: ৭৯)
হুযুর গাউসে পাক ইলমে জাহের ইলমে বাতেন অর্জন শেষে গোটা জীবন যিকর ও সাধনাতে অতিবাহিত করেন হুযুর গাউসে পাক (র.) শরীয়ত তরীক্বত হাকীক্বত মারিফত ইলমে জাহের ও ইলমে বাতেন অর্জন শেষে বৎসরের পর বৎসর বিভিন্ন পাহাড়ে পর্বতে চিল্লা মুরাকাবা মোশাহাদা ইবাদত বন্দেগী যিয়ারত তিলাওয়াত যিকর আযকারে বিভোর থাকতেন। কখনো কখনো একাধারে চল্লিশ দিন পানাহার ব্যাতিরেকে নিজেকে আল্লাহর ধ্যানে স্মরনে উৎসর্গ করেন। হযরত আহমদ ইবনে ইয়াহিয়া বর্ণনা করেন। আমি স্বয়ং হুযুর গাউসে পাক কে বলতে শুনেছি যে, আমি একাধারে চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এশার পর থেকে ফজর পর্যন্ত প্রতিদিন বিরতিহীন এক খতম কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতাম। (বাহাযাতুল আসরার পৃ: ২৪৯, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫৪০)
যাঁদের দর্শনে আল্লাহর স্মরণ হয় তাঁদের মর্যাদা ও ক্ষমতা: একদা শাহেন শাহে বাগদাদ হুযুর গাউসে পাক কতিপয় ভক্ত মুরিদ নিয়ে একটি মহল্লা অতিক্রম করছিলেন, পথিমধ্যে দেখলেন একজন মুসলমান ও একজন খৃষ্টান পরস্পর বিবাদ বিতর্কে লিপ্ত। গাউসে পাক ঝগড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন? মুসলমান বললেন এই খৃষ্টান লোকটি দাবী করছে হযরত ঈসা (আ:) আমাদের নবী থেকে শ্রেষ্ঠ। হুযুর গাউসে পাক খৃষ্টানকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কোন কারনে ঈসা (আ:) কে শ্রেষ্ঠ দাবী করছেন? খৃষ্টান লোকটি উত্তর দিলো, হযরত ঈসা (আ:) মৃত ব্যক্তি জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। হুযুর গাউসে পাক উত্তর দিলেন আমি নবী নই বরং নবীর একজন আওলাদ ও উম্মত হই। যদি এই মুহূর্তে আমি কোন মৃতকে জীবিত করি তুমি কি আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিবে? খৃষ্টান লোকটি উত্তর দিলো অবশ্যই স্বীকার করবো, হুযুর গাউসে পাক তাঁকে বললো, তোমার জানাশুনা কোনো পুরাতন কবরের পাশে আমাকে নিয়ে চলো, গাউসে পাককে নিয়ে গেলেন গাউসে পাক বহু প্রাচীন এক কবরের দিকে ইংগিত করলেন এবং বললেন এই কবরে কবরস্থ লোকটি জীবদ্দশায় গানবাজনা করে জীবিকা নির্বাহ করতো, আপনি যদি চান আমি এই মুর্দাকে গায়ক অবস্থায় কবর থেকে তুলে আনতে পারি, খৃষ্টান উত্তর দিলো, এটাতো আরো বিস্ময়কার তা-ই-করুন, হুযুর গাউসে পাক কবরের দিকে দৃষ্টি দিলেন বললেন, আল্লাহর অনুমতিক্রমে দাঁড়াও তৎক্ষণাৎ কবর ফেটে গেল, মুর্দা জীবিত হয়ে গায়ক অবস্থায় বেরিয়ে আসলো, গাউসে পাকের এই কারামত দেখে খৃষ্টান লোকটি তাওবা করলেন এবং মুসলমান হলেন, আউলিয়ায়ে কেরামের ক্ষমতা ও খোদা প্রদত্ত অসাধারণ মর্যাদা প্রমাণ হলো। (তাফরীহুল খাওয়াতির, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫৬৪)
আ’লা হযরতের বর্ণনায় নবীজির কদম মোবারক গাউসে পাকের কাঁধের উপর: আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (র.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজ শরীফ গমনকালে বুরাকের উপর আরোহনের প্রাক্কালে হুযুর গাউসে পাকের রুহ মুবারক হাজির হলো। হুযুর গাউসে পাক কাঁধ মোবারক রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে পেশ করলেন, যেন সরকারে দোআলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর কদম শরীফ রেখে বুরাকের উপর আরোহন করেন, এ মুবারক মুহূতে রাহমাতুল্লীল আলামীন নিজের আওলাদ শাহজাদা হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রা.) কে স্বীয় অনুগ্রহে ধন্য করে স্বীয় কদম মোবারক গাউসে পাকের কাঁধের উপর রাখলেন এবং বুরাকে আরোহন করলেন নবীজি এরশাদ করলেন, আমার কদম তোমার গর্দানের উপর এবং তোমার কদম সমগ্র অলীদের গর্দানের উপর হবে। এ ঘটনা মক্কা মুকাররমার পবিত্র বরকতময় জমিনে সংঘটিত হয়েছে। (সারসংক্ষেপ ফাতওয়ায়ে রিজভিয়্যাহ, খন্ড: ১২, পৃ: ২০, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫৭৭)। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আউলিয়ায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ জাহিদুল করিম
কাটির হাট, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: ঝড় তুফান ও বজ্র পাতের ক্ষয় ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার দুআ সম্পর্কে
জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: প্রতিকূল আবহাওয়ার বিপদজনক পরিস্থিতিতে নিম্ন বর্ণিত দুআ পাঠে উপকারিতা রয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রবল বেগে বাতাস প্রবাহিত হত, প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের আকার ধারণ করত এই দুআ পাঠ করতেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা মিন খাইরাহা ওয়া খাইরা মা ফীহা, ওয়া খাইরা মা উরাসিলাত বিহি।” ( বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং: ১৪৯৬) হে আল্লাহ! এই তুফান এর কল্যাণ এর ভেতরের কল্যাণ যা দ্বারা তা পাঠানো হয়েছে তোমার নিকট তার কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং উহার অকল্যাণ এবং এর মধ্যে নিহিত ক্ষতি যা দিয়ে তা পাঠানো হয়েছে এর ক্ষতি থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
নিম্নের দুআটিও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “ আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা খাইরাহা, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা” (আবু দাউদ, হাদীস: ৪৪৩৩, ইবনে মাযাহ, হাদীস: ৩৭১৭)
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাদীস শরীফে নিম্নের দুআ বর্ণিত হয়েছে, “সুবহানাল্লাজী ইউসাব্বিহুর রা’দু বিহামদিহি ওয়াল মালায়িকাতু মিন খীফাতিহি” আমি সেই সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি যাঁর ভয়ে মেঘের গর্জন ও ফিরিস্তারা তাঁর মহিমা ঘোষণা করে। (মুআত্তা, খন্ড: ২, পৃ: ৯৯২)