পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের গুরুত্ব
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহতা’আলাকে ভয় করুন! পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করুন। আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের ভালোবাসা অর্জনের লক্ষ্যে পিতা-মাতাকে ভালোবাসুন, তাদের সেবা করুন, অধিকার আদায় করুন, তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জনে জান্নাতের পথ সুগম করুন। তাঁদের মর্যাদাও সম্মানের প্রতি সচেতন হোন। মহান আল্লাহতা’আলা পবিত্র আল কুরআনে এরশাদ করেছেন-“তোমার পালন কর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো যদি তোমার সামনে তাদের মধ্যে একজন কিংবা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে উহ শব্দটিও বলো না এবং তাদের কে ধমক দিওনা আর তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলবে এবং তাদের জন্য বিনয়ের বাহু বিছিয়ে দাও এবং বলো হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেভাবে তারা উভয়ে আমাকে শৈশবে প্রতি পালন করেছেন।” (সূরা: ১৭ বনী ইসরাঈল, আয়াত:২৩-২৪)
পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, “আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোন বস্তুকে শরীক করোনা এবং পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো।” (৪-সূরা: নিসা: আয়াত: ৩৬)
মহান আল্লাহতা’আলা পবিত্র কুরআনে প্রায় পনের স্থানে আল্লাহর হক বর্ণনা করার সাথে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করা, শিষ্টাচারপূর্ণ উত্তম আচরণ করার নির্দেশ করেছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিকে পিতা-মাতার সেবা ও সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশের পথ সুগম করে দিয়েছেন। পিতা-মাতার প্রতি অবাধ্য সন্তান-সন্তুতির পক্ষে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া ও জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
হাদীস শরীফের আলোকে মাতা-পিতার মর্যাদা: মাতা-পিতার হক ও মর্যাদা প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার হকদার কে? নবীজি বললেন, তোমার মা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তোমার মা। লোকটি পূনরায় প্রশ্ন করল অত:পর কে? নবীজি বললেন তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পিতা।” (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৭১, মুসলিম শরীফ, খন্ড ২, পৃ:৩১২)
মাতার পদতলে সন্তানের জান্নাত: একদা একব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চাই। আপনার পরামর্শের জন্য উপস্থিত হয়েছি, নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মাতা কি জীবিত আছে? লোকটি উত্তর দিলেন হ্যাঁ। নবীজি এরশাদ করেন, “তোমার মাতার সেবায় নিয়োজিত থাকো। যেহেতু জান্নাত মায়ের কদমের নীচে। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ২৪১)
পিতা-মাতা সন্তানের জান্নাতও জাহান্নামও: “হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সন্তানের উপর পিতা-মাতার কি হক আছে? নবীজি বললেন, তারা তোমার বেহেস্ত ও তারা তোমার জাহান্নাম।” (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং: ৩৬৬২, মিশকাত শরীফ, পৃ:৪২১)
পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের প্রতি নবীজির অসন্তুষ্টি: হযরত আবু হুরায়ারা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয় সে অভিশপ্ত। যে ব্যক্তি মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয় সে অভিশপ্ত। যে ব্যক্তি মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয় সে অসন্তুষ্ট। [ফতোওয়ায়ে রযভিয়া, খন্ড: ১০ম, পৃ: ৩৯৪ কৃত: ইমাম আহমদ রেযা (র.)]
পিতা-মাতাকে কষ্ট দানকারী কোন ব্যক্তির ফরজ, নফল ও অন্যকোন প্রকার আমল আল্লাহ তা’আলা কবুল করেন না। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়া, খন্ড: ১০ম, পৃ: ৫৮)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৪১৯)
হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.)’র বর্ণনা: প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (র.) উল্লেখ করেন, সাহাবী হযরত আমর বিন আস (রা.) নবীজির দরবারে স্বীয় পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা.) বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেন যে, আমার সন্তান অধিক পরিমাণ ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকেন, সারারাত বিনিদ্র রজনী যাপন করে ইবাদত করে ও দিনের বেলায় রোজা পালন করে। ইবাদত বিয়াজতের কারণে আমার খিদমত করার সুযোগ কম পায়, তখন নবীজি এরশাদ করেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (আশিয়াতুল লুমআত, খন্ড: ৪, পৃ: ১০৫, আনোয়ারুল বয়ান: খন্ড: ২য়, পৃ: ৬১)
পিতা-মাতার খিদমত করলে রিজক বৃদ্ধি হয়: রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে পছন্দ করে যে, সে দীর্ঘ জীবী হউক, তার রিযিক বৃদ্ধি হউক, সে যেন পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করে ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। [কাশফুল গুম্মাহ, পৃ: ২৬, মিশকাত শরীফ, পৃ: ২২১, হুকুকে ওয়ালেদাঈন, পৃ: ১৭, কৃত- ইমাম আহমদ রেযা (র.)]
তিন শ্রেণির বান্দার দুআ ফেরত হয় না: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তিন শ্রেণির মানুষের দুআ কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এক. মজলুমের দুআ, ২. মুসাফিরের দুআ, ৩. পিতা-মাতার দুআ সন্তানের জন্য। (তিরমিযী শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ১৩)
মাতা-পিতাকে কষ্টদায়কারী দুনিয়াতেই তার শাস্তি: “হযরত আবু বাকরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মাতা-পিতার অবাধ্যতা ছাড়া অন্য যে সকল গুনাহ রয়েছে আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তা থেকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মাতা-পিতার অবাধ্যকে আল্লাহ মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে থাকেন।” (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, মিশকাত শরীফ, পৃ: ৪২১)
অন্যের পিতা-মাতাকে গালমন্দ করা নিজের পিতা-মাতাকে গালি দেওয়ার নামান্তর: “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোন ব্যক্তি পিতা-মাতাকে গালমন্দ করা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন কোনো ব্যক্তি কি তার পিতা-মাতাকে গালমন্দ করে? নবীজি বললেন, একজন অপর জনের পিতা-মাতাকে গালি দেয় তখন সেও ঐ লোকের পিতা-মাতাকে গাল মন্দ করে। (বুখারী শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ৮৮৩)
মাতার উপর স্ত্রীকে প্রাধান্য দেওয়া মারাত্মক গুনাহ: অনেক লোকেরা নিজেদের স্ত্রীর প্ররোচনায় নিজ পিতা-মাতাকে গালমন্দ করে এমন কি শারীরিক নির্যাতন করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয় অথবা তাঁদেরকে একাকী পরিত্যাগ করে স্ত্রী পুত্র নিয়ে অন্যঘরে বসবাস করে এমন সন্তানের জন্য বড়ই পরিতাপ। নবীজি এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজ মাতার উপর স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দেয় তার উপর আল্লাহর লানত ফেরেস্তাদের ও সকল মু’মীনের লানত। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ৬৯)
মাতা-পিতার বন্ধু-বান্ধবীর সাথে সদাচরণ করা: এক আনসায়ী সাহাবী নবীজির খিদমতে আরজ করলেন, পিতা-মাতার ইন্তেকালের পর তাদের প্রতি সদাচরণ করার কোন উপায় আছে কি? নবীজি এরশাদ করেন, হ্যাঁ চারটি উপায় আছে, এক. তাদের জানাযা পড়া, দুই. তাদের মাগফিরাত কামনা করা, তিন. তাদের ওসীয়ত পূর্ণ করা, চার. তাদের বন্ধু বান্ধবদের সম্মান করা ও তাদের প্রতি সদাচরণ করা। [আবু দউদ শরীফ, হুকুকে ওয়ালেদাঈন, কৃত-ইমাম আহমদ রেযা (র.)]
মাতা-পিতার চেহারা মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখার সওয়াব: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, পিতা-মাতার প্রতি বিনয়ী, অনুগত, নিবেদিত, সন্তান-সন্তুতি যদি মহব্বতের দৃষ্টিতে মা-বাবার দিকে মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখলে মকবুল হজ্বের সওয়াব লিপিবদ্ধ হয়।
(মিশকাত শরীফ, পৃ: ৪২১)
মায়ের কদম চুম্বন করার ফজীলত: বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দীন আঈনী হানফী হাদীস বর্ণনা করেছেন, একদা এক ব্যক্তি নবীজির দরবারে আরজ করলেন যে, আমি এ মর্মে মান্নত করেছি যে যদি আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে মক্কা মোকাররমার বিজয় দান করেন আমি কাবা শরীফের চৌকাঠ চুম্বন করব, নবীজি বললেন, তুমি তোমার মায়ের দু কদমে চুম্বন করো, এতে তোমার মান্নত পূর্ণ হয়ে যাবে।
(উমদাতুল ক্বারী, খন্ড:২, পৃ: ৮২)
পিতা-মাতার পক্ষ থেকে নফল নামায পড়া: যখন নিজের জন্য নফল নামায, নফল রোজা রাখেন, কিছু নফল নামায তাদের পক্ষ থেকে পড়ুন, তাদের রূহে সওযাব পৌঁছিয়ে দিন। তারাও সওয়াব পাবেন, আপনার সওয়াবেও সামান্যতম হ্রাস পাবেনা।
(হুকুকে ওয়ালেদাঈন)
মাতা-পিতার কবর যিয়ারত: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে পিতা-মাতা দু’জনের বা একজনের কবরে জুমার দিবসে যিয়ারত করবে, আল্লাহ তা’আলা তার গুনাহ ক্ষমা করবেন। ঐ ব্যক্তি মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণকারী হিসেবে তার নাম লিপিবদ্ধ হবে। (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ, পৃ: ১৫৪)
নবীজি আরো এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি জুমাবারে পিতা-মাতা দুজন বা একজনের কবর যিয়ারত করবে সূরা ইয়াসিন শরীফ তিলাওয়াত করবে এতে যতটি অক্ষর রয়েছে তার গনণার সমপরিমাণ গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়া, খন্ড: ১০ম, পৃ: ১৬৪)
মাতা-পিতা কাফির হলেও তাদের প্রতি সদাচরণ করো: হযরত আসমা বিন আবু বকর(রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমার মা আমার কাছে আসলেন, তিনি বলেন আমার মা আমার কাছে আসলেন, তিনি ছিলেন মুশরিকা এ ঘটনা তখনকার যখন কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা আমার কাছে এসেছেন অথচ তিনি ইসলামের প্রতি অসন্তুষ্ট। সুতরাং আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, তাঁর সাথে উত্তম আচরণ করো। (বুখারী শরীফ, খন্ড:২, পৃ: ৮৮২, আততারগীব ওয়াত তারহীব, খন্ড: ৩য়, পৃ: ২২১)
ইসলামী আদর্শ কত উৎকষ্ট, উত্তম ও মানবিক, মাতা-পিতা অমুসলিম হওয়া সত্বেও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এমন নির্দেশনা পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হে আল্লাহ আমাদেরকে কথায় কর্মে আচরণে ব্যবহারে আপনার ও আপনার প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও সন্তুষ্টি দান করুন। পিতা-মাতার প্রতি সম্মান ও সদাচরণ করার তাওফিক দান করুন। পবিত্র কুরআনের আয়াত ও উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি মহান দানশীল সৃষ্টি জগতের অধিপতি পূণ্যময় অনুগ্রহশীল দয়ালু, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব- কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।