জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৭ মে, ২০২২ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব

পবিত্র কুরআনের আলোকে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বৃক্ষরাজির ভূমিকা:
জলভাগে স্থলভাগে ও বায়ুমন্ডলে বিরাজিত সকল সৃষ্টির রিযিক দাতা মহান আল্লাহ। বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজির মাধ্যমে উৎপাদিত ফলমূল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে মানবজাতিসহ অসংখ্য প্রাণীকুল ও জীবকুল জীবন রক্ষা করে পরিপুষ্ট হয়। আকাশ থেকে বর্ষিত ও ভূগর্ভে সংরক্ষিত পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৃক্ষরাজির বনায়ন, সবুজায়ন, সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ আল্লাহর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈচিত্রময় কুদরতের মনোরম নিদর্শন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “ আকাশ থেকে আমি বরকতপূর্ণ পানি বর্ষণ করি এবং তা থেকে সৃষ্টি করি উদ্যানসমূহ এবং সংগ্রহযোগ্য খাদ্যশস্য।” (সূরা: কাফ: ০৯)

হাদীস শরীফের আলোকে বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোন মুসলমান যদি গাছ রোপণ করে অথবা কোন ফসল আবাদ করে এবং তা থেকে কোন পাখি বা মানুষ অথবা চতুস্পদ জন্তু ভক্ষণ করে তবে তা তার জন্য সাদকা স্বরূপ পরিগণিত হয়ে যায়। (বুখারী শরীফ)

মানব জাতি আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বিঘোষিত। অন্যান্য সৃষ্টিরাজির সবকিছু্‌ই মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। আগুন, বাতাস, মাটি, পানি, মৌলিক উপাদানগুলো আমাদের চার পাশের পরিবেশ জীবন ও অস্তিত্বের সাথে জড়িত। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশু-পাখি, জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, সাগর-মহাসাগর, সবকিছুই পরিবেশের অংশ। মানব জীবনের সুখ শান্তি উন্নতি সমৃদ্ধি অগ্রগতি ও সুস্থতা নির্ভর করে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের উপর। ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক দেশ ও জাতির সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সুতরাং পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাস উপযোগী রাখার জন্য মানুষের অস্তিত্বের স্বার্থেই পরিবেশের সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষায় গাছ-পালা ও বনাঞ্চল রক্ষা করা, জমি চাষাবাদ করা, অধিকারে বৃক্ষরাজি রোপণ করা, পরিচর্যা করা ও সঠিকভাবে বৃক্ষরাজির যত্ন নেয়ার ব্যাপারে কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষায় ইসলাম সবধরণের পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য উৎসাহিত করেছে। পক্ষান্তরে পরিবেশের ভারসাম্যতা বিনষ্টকারী সকল প্রকার ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য ইসলাম বারবার সতর্ক ও সাবধান করেছে। দু:খজনক হলেও সত্য যে, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত সমস্যা আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে বর্তমানে ঘর বাড়ী, দালান কোটা নির্মাণের নামে ব্যাপকহরে বৃক্ষনিধন করে বনজঙ্গলকে উজাড় করে দেয়া হচ্ছে, মহান আল্লাহ প্রদত্ত অফুরন্ত অক্সিজেনের উৎস গাছ-পালা ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্যতা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অথচ ইসলামের নবী পৃথিবীর সৌন্দর্য সুরক্ষায় দেড়হাজার বৎসর পূর্বে ঘোষণা করেছেন, “তোমরা ফলবান কোন বৃক্ষ কর্তন করবেনা। এবং কোনো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবেনা, খাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া তোমরা কোনো বকরি ও উট হত্যা করবেনা এবং কোনো খেজুর বৃক্ষ ডুবিয়ে বা জ্বালিয়ে দেবেনা। (মাকাসীদ আশ্‌ শরীয়্যাহ, পৃ: ৩০২)

অপ্রয়োজনে গাছপালা কর্তনে পরকালের শাস্তি: যারা অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করে বনাঞ্চল উজাড় করে দেয়, প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করে খোদা প্রদত্ত সম্পদ ধ্বংস ও ক্ষয় ক্ষতি করে জাগতিক জীবনেও তারা অপরাধ করছে পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে শাস্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে আল্লাহ তার মস্তককে আগুনে নিক্ষেপ করবেন। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৫২৪১)

বৃক্ষরাজি থেকে বান্দার রিযিক: আল্লাহ তা’আলা সমগ্র সৃষ্টিরাজির রিযিকের জিম্মাদার। মাখলুককে সৃষ্টি করে তিনি অসহায় করে ছেড়ে দেন নি। প্রতিটি সৃষ্টির রিযিকের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “আল্লাহই তো মহান রিযিকদাতা, এবং মহাশক্তির অধিকারী তিনি প্রবল পরাক্রান্ত। (সূরা: যারিয়াত: ৫৮)

বৃক্ষরাজি থেকে উৎপাদিত ফলমূল, খাদ্য-শস্য, পত্র-পল্লবে ও শস্যদানায় কেবলমাত্র মানব জাতির রিযিক নয় এতে রয়েছে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, দুম্বা, উট, ঘোড়া, হাতি অসংখ্য প্রাণীকুলের রুজি ও খাদ্যের ব্যবস্থা।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তুমি কি দেখো না? আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্‌গত করি। (সূরা: ফাতির: ২৭)

উদ্ভিদ না থাকলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী একদিনও টিকে থাকা সম্ভব হতোনা। তাই মহান আল্লাহ তা’আলা মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “কাজেই মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক, নিশ্চয় আমি প্রচুর পরিমাণে পানি বর্ষণ করি। তারপর জমিনকে যথাযথভাবে বিদীর্ণ করি। অত:পর তাতে আমি উৎপন্ন করি শস্য আঙ্গুর ও শাক-সবজি, যায়তুন ও খেজুর বন, ঘনবৃক্ষ, শোভিত বাগ বাগিছা আর ফল ও তৃণগুল্ম। তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদজন্তুগুলোর জীবনোপকরণ স্বরূপ। (সূরা: আবাসা: আয়াত: ২৪-৩২)

উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভূমি চাষাবাদের গুরুত্ব: খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ভূমি চাষাবাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কারো কোনো জমি থাকলে সে যেন তা চাষাবাদ করে। আর যদি সে চাষাবাদ করতে না পারে এবং অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে উক্ত জমি নিজ মুসলমান ভাইকে দেওয়া উচিত। (সহীহ মুসলিম, খন্ড:২, পৃ: ১১)

বর্ণিত হাদীসের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ভূমি পরিত্যক্ত না রেখে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতিপূরণ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে ধান, গম, ভূট্টো, চাষ করে প্রচুর পরিমান খাদ্য উৎপাদন করা যায়। এভাবে আম, জাম, লেবু, কমলা, আপেল, পেপে, আনারস, পিয়াজ, রসূন, মুসর, আলু, শাক, সবজি, শশা, কলা ইত্যাদি উৎপন্ন করে প্রচুর অর্থ সম্পদ অর্জন করা যায়।
বৃক্ষের চার পাশ পবিত্র রাখার নির্দেশনা: পবিত্রতা ঈমানের অংঙ্গ, ইসলাম কেবলমাত্র মানুষের শারীরিক ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জনের উপর গুরুত্বারোপ করেনি, বরঞ্চ, দূষণমুক্ত, পরিবেশ নিশ্চিতকরনে লোকালয়, চলাচলের পথ রাস্তাঘাট বাড়ীঘরের আঙ্গিনা এমনকি গাছ-পালার চতুর্দিকের স্থানও ময়লা আবর্জনা ও মল মূত্র ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন।

গাছের ছায়ায় প্রস্রাব পায়খানা করা নিষেধ: স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত যে, চলাচলের রাস্তায়, গাছের নীচে বা জলাশয়ে পায়খানা প্রস্রাব করলে অসংখ্য প্রজাতির রোগ জীবাণু, বাতাসের সাহায্যে দেহে প্রবেশ করে নানা প্রকার রোগ ব্যাধির সৃষ্টি করে পরিবেশকেও দূষিত করে তোলে। বিজ্ঞানীদের গবেষণার হাজার বৎসর পূর্বেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাবিজ্ঞানী ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিশপ্ত তিনটি ক্ষতিকর কাজ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য মানব জাতিকে সতর্ক করেছেন। এরশাদ হয়েছে, হযরত মুয়াজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা তিনটি অভিশাপজনক কাজ থেকে বেঁচে থাক, ১. পানির ঘাটে পেশাব-পায়খানা করা, ২. চলাচলের পথে, ৩. এবং কোনো গাছের নীচে বা ছায়ায় পায়খানা পেশাব করা হতে বিরত থাক। (আবু দাউদ, হাদীস নং: ২৬)। তাই আসুন সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনে পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতন হই। নিজেদের বাড়ী ঘরের আঙ্গিনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খালি জায়গায়, সড়ক মহাসড়কের দু’পাশে অধিক পরিমাণ বৃক্ষ রোপণ করে পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষায় সচেষ্ট হই। নবী মোস্তফার ফরমান অনুযায়ী সাদকায়ে জারীয়ার সওয়াব অর্জন করে ইসলামের সৌন্দর্য বিকশিত করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের কে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন
জোয়ারা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: চট্টগ্রাম কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠা ও মসজিদে স্থাপিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কদম মোবারক সম্পর্কে জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ অনুসন্ধানে জানা যায় যে, চট্টগ্রামের কদম মোবারক শাহী মসজিদটি তৎকালীন মোঘল শাসক নবাব ইয়াসিন মুহাম্মদ খান কর্তৃক ১১৩৬ হিজরি মুতাবিক ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। জানা যায় নবাব ইয়াসিন মুহাম্মদ খান নিজস্ব অর্থায়নে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ মসজিদে জীবদ্দশায় কুতবুল আকতাব অলীয়ে কামেল হযরত শাহ আমানত (রহ.) প্রতি শুক্রবার নামায আদায় করতেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। এ মসজিদের উত্তর দিকের কামরায় পাথরের উপর প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র “কদম মোবারক” এর ছাপ রক্ষিত আছে। কদমদ্বয় মোঘল আমল থেকে সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিহাস সূত্রে জানা যায় মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা নবাব ইয়াসিন মুহাম্মদ খান এ কদম শরীফের ছাপ মদীনা মনোওয়ারা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এ কদম শরীফ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে উপমহাদেশের অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীন, হক্কানী ওলামায়ে কেরাম প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া মির্জাখীল দরবার শরীফের প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল হযরত শেখুল আরেফীন মাওলানা মোখলেসুর রহমান (কুদ্দিসা সিররুহুল আজীজ) ফখরুল আরেফীন হযরত মাওলানা আবদুল হাই জাহাঙ্গীরি (কুদ্দিসা সিররুহুল আজীজ) হযরত হাফেজ কারী সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.), হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) ও ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা (র.) সহ অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম এ কদম শরীফ যিয়ারত করে ফয়েজ ও বরকত অর্জন করেছেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়। বিগত তিনশত বৎসরের অধিককাল ধরে অদ্যাবধি দেশ বিদেশের অসংখ্য যিয়ারতকারীগন প্রতিনিয়ত এ কদম শরীফ যিয়ারত লাভে হৃদয়ের গভীরে প্রশান্তি অনুভব করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হক
পরবর্তী নিবন্ধবৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বজ্রপাতে মৃত্যু