সফরে কসর নামাযের বিধান
সফর অর্থ: সফর শব্দের আভিধানিক অর্থ উন্মুক্ত হওয়া ও প্রকাশিত হওয়া। যেহেতু সফর দ্বারা মুসাফিরের স্বভাব, প্রকৃতি ও আচরণের প্রকাশ ঘটে। শরীয়তের পরিভাষায় আবাসভূমি থেকে সুনির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করার নিয়তে বের হওয়াকে সফর বলা হয়।
কসর অর্থ: কসর শব্দটি আরবি, এর অর্থ হ্রাস করা, কম করা, সংক্ষেপ করা। শরীয়তের পরিভাষায় সফরের সময় চার রাকাত বিশিষ্ট নামায দু’রাকাত আদায় করাকে কসর হলা হয়। সফর ও কসর শব্দ দু’টি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ হয়েছে।
সফরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা: পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে সফরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিধৃত হয়েছে। চাক্ষুষ জ্ঞান ও বহুমুখী অভিজ্ঞতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হল ভ্রমণ। মানব জাতির জীবনে সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক মানুষ নানাবিধ কারণে ও প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে দূর দূরান্তে সফর করে থাকে। ব্যবসা, বাণিজ্য, পড়া, লেখা, দেশ-বিদেশে চাকরি, উচ্চতর জ্ঞান গবেষণা, ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল কাজে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে গমন, চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজনে ভ্রমণ, দর্শণীয় স্থান পরিদর্শন। ইসলামের প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সভা সেমিনার সিম্পোজিয়াম এ অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে এ ভাবে গ্রীষ্ম বা শীতকালীন অবকাশ যাপন এ ছাড়াও পবিত্র হজ্ব ও ওমরা সম্পাদনের জন্য মক্কা মদীনা গমন, দেশ বিদেশের অলী বুজুর্গদের মাযার যিয়ারত ও বিভিন্ন কারণে সফর করতে হয়। সফর কালীন নামাযের বিধান ও শরয়ী মাসআলা সম্পর্কে অবগতি অর্জন করা অপরিহার্য।
আল কুরআনে সফরের বর্ণনা: সফর তথা ভ্রমণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “(হে হাবীব) আপনি বলুন! তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং গবেষণা কর কিভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অত:পর আল্লাহ পুনরায় সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম। (আল কুরআন: ২৯: ২০)
মহান আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “(হে হাবীব) আপনি বলুন! তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং মিথ্যাবাদীদের কী পরিণতি হয়েছিল তা স্বচক্ষে অবলোকন কর। (আল কুরাআন: ০৬: ১১)
মুসাফির এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ইসলামী পরিভাষায় মুসাফির ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে তিন দিন তিন রাত দূরত্বের সফরে বের হয়ে সেখানে ১৫ দিন বা ততোধিক দিন অবস্থানের নিয়ত না করলে সে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।
সফরের দূরত্ব ও সময় সীমা: সফরের সময় সীমা ও দূরত্ব প্রসঙ্গে ইসলামী আইনজ্ঞ ফকীহগণের বিভিন্ন গবেষণাধর্মী মত পাওয়া যায়। অধিকাংশ হানফী ফকীহগণের মতে ষোল “ফারসাখ” অর্থাৎ আটচল্লিশ মাইল। পরিভাষায় ভূমির নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বকে ফারসখ বলে। এক ফারসখ= তিনমাইল ১৬দ্ধ৩=৪৮ মাইল। ইমাম আযমের এক মতে ১৮ ফারসাখ বা ৫৪ মাইল দূরত্বের কথাও এসেছে। ইমাম আহমদ রেযা (র.)’র বর্ণনা মতে সফরের দূরত্বের সময় সীমা হচ্ছে যে ব্যক্তি সাড়ে সাতান্ন মাইল পথের দূরত্ব পরিমান পথ অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে সে মুসাফির। তার জন্য চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাযে অর্থাৎ যোহর, আসর এবং এশা নামাযে চার রাকাতের স্থলে দু’রাকাত আদায় করাকে কসর বলা হয়। ইমাম আবু হানিফা (র.)’র মতে সফরের নামায কসর পড়া ওয়াজিব। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ০৪, ফাতওয়া এ রজভীয়্যাহ, খন্ড:৩)
পবিত্র কুরআনে কসর পড়ার নির্দেশ: চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাযে দু’রাকাত কসর পড়তে হবে। তিন বা দু রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামায তথা ফজর, ও মাগরীব নামযে এ বিধান প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যখন তোমরা যমীনে সফর করবে তখন তোমাদের জন্য নামায কসর করতে কোন পাপ নেই। (সূরা: নিসা, ৪:১০১)
হাদীস শরীফের আলোকে সফরে কসর নামাযের বর্ণনা:সফরে কসর পড়া প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, নিম্নে কয়েকটি রেওয়ায়েত উপস্থাপন করা হলো:-
১.“হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এরশাদ করেন, সফরের সালাত দু’রাকাত, ঈদুল আযহার সালাত দু’রাকাত, ঈদুল ফিতর’র সালাত দু’রাকাত, জুম্’আর সালাত দু’রাকাত এই সালাতগুলোর দু’রাকাতই পূর্ণরূপ। এতে সংক্ষিপ্তকরণ করা হয়নি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জবানীতে।
২.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, “আল্লাহ তা’আলা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জবানীতে মুকীমাবস্থায় চার রাকাত এবং সফরের মধ্যে দু’রাকাত নামায ফরজ করেছেন। (সহীহ মুসলিম শরীফ: ১/৪৭৯)
৩.হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা থেকে কোথাও বেরিয়ে গেলে এখানে ফিরে না আসা পর্যন্ত দু’রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। (সুনানু ইবনে মাজাহ ১/৩৯৪)
৪. হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মদীনায় ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি দু’রাকাত সালাত আদায় করেছেন (বর্ণনাকারী বলেন) আমি আনাস (রা.) কে বললাম আপনার মক্কায় কত দিন ছিলেন? তিনি বললেন আমরা সেখানে দশদিন ছিলাম। (সহীহ বুখারী, হাদীস:১০৮১)
৫. হযরত ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, তুমি যদি মুসাফির হও এবং ১৫ দিন অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর তাহলে সালাত পূর্ণ করবে আর যদি তুমি না জান যে কতদিন অবস্থান করবে তখন সালাত কসর করবে। (কিতাবুল আসার কৃত: ইমাম মুহাম্মদ, ফিকহুস সুনানী ওয়াল আছার কৃত: মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান)
কসরের বিধান না মানলে গুনাহগার হবে: ইমাম আবু হানিফা (র.)’র মতে মুসাফিরের জন্য কসর পড়া ওয়াজিব। এ বিধান না মানলে গুনাহগার হবে। মুসাফিরের উচিৎ আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করে এ সুযোগ গ্রহণ করা। বাহ্যিকভাবে যদিও দু’রাকাত কম কিন্তু সওয়াবের দিক দিয়ে এ দু’রাকাত চার রাকাতের সমান। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সালাতুল কসরকে আল্লাহ তোমাদের জন্য সাদকা হিসেবে প্রদান করেছেন তোমরা আল্লাহর সাদকা কবুল কর। (মুসলিম শরীফ, দুররে মোখতার, হিদায়া, বাহারে শরীয়ত, ৪ খন্ড, ফতওয়া-এ রজভীয়াহ, খন্ড ৩)
শরয়ী মাসায়েল: প্রসিদ্ধ ফিকহগ্রন্থ মালাবুদ্দামিনহু কৃত কাযী ছানাউল্লাহ পানি পথী (র.)’র বর্ণনা মতে যে ব্যক্তি তিন মনযিল পথ অতিক্রম করার নিয়্যত করে ঘর থেকে বের হয়ে শহর অতিক্রম করে সে মুসাফির প্রতি মঞ্জিলের দূরত্ব ষোল মাইল। প্রতি মাইলের দুরত্ব হচ্ছে চার হাজার কদম। এ হিসেবে তিন মঞ্জিলের দূরত্ব হবে ৪৮ মাইল। তবে আলা হযরত সফরের দূরত্ব বর্ণনায় সাড়ে সাতান্ন মাইল ৯২.৫৪ কি:মি: মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মুসাফির বৈধ কাজে সফর করুক বা অবৈধ কাজের উদ্দেশ্যে সফরে গমন করুক সর্বাবস্থায় চার রাকাত ফরজের স্থলে দু’রাকাত আদায় করবে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪)
সফরে সুন্নত নামায আদায় প্রসঙ্গ: প্রসিদ্ধ ফাতওয়া গ্রন্থ “শামীতে” উল্লেখ আছে, মুসাফির শান্ত পরিবেশ ও নিরাপদে অবস্থানকালীন সময়ে সুন্নাত সমূহ আদায় করবে। শঙ্কিত অবস্থায় বা সময় না থাকলে অথবা অস্বাভাবাবিক পরিস্থিতির কারণে সুন্নাত পরিত্যাগ করা জায়েজ। (দূররে মুখতার ১/১০৬, আলমগীরি)
মুসাফির যদি সুন্নত পড়ে সর্ম্পূটাই পড়বে, সুন্নতে কসর নেই। সফরের ব্যস্থতার সময়ে সুন্নতগুলো ক্ষমা যোগ্য। নিরাপত্তাকালীন ও সময় সাপেক্ষে সুন্নতগুলো পড়বে এবং সম্পূর্ণটাই পড়বে। (মুমীন কী নামায, আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৪)
মুসাফির ইমামের ইকতিদার মাসআলা:
মুসাফির যদি মুকীমের ইকতিদা করে চার রাকাতই আদায় করতে হবে। মুসাফির ইমাম হলে মুক্তাদি মুকীম হলে ইমাম দু’রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে নিবে। মুক্তাদি বাকী নামায পূর্ণ করে নিবে। বিশুদ্ধ মতানুসারে মুক্তাদি বাকী দু’রাকাতে কিরাত পাঠ করবে না। (আলমগীরি ১ম খন্ড)
মুসাফির ইমাম হলে তিনি বলে দিবেন আমি মুসাফির, বাকী দু’রাকাত নিজেরা পূর্ণ করে দিবেন। শেষ দু’রাকাতে কোন কিরাত পড়তে হবেনা। সূরা ফাতিহা পড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। (দুররে মুখতার, বাহরে শরীয়ত, খন্ড:৪, ফাতওয়া-এ রযভীয়্যাহ, খন্ড:০৩, মু’মিন কী নামায)
ওয়াতন তিন প্রকার:
১. ওয়াতানে আসলী: ব্যক্তির জন্ম স্থান যে স্থানে সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং ওখান থেকে অন্য কোথাও স্থায়ীভাবে যায়না।
২. ওয়াত্নে ইকামত: (অস্থায়ী বাসস্থান) এমন আবাসস্থল যেখানে পনের দিন বা ততোধিক দিন থাকার নিয়্যত করে।
৩. ওয়াতানে সুকুনাত: যে স্থানে পনের দিনের কম অবস্থানের নিয়্যত করে। এ ক্ষেত্রে সর্বদা কসর আদায় করতে হবে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪)
কোন ব্যক্তি কোন কাজে সফরে গিয়ে ১৫ দিন অবস্থানের নিয়্যত করেনি কাজ শেষ হলে চলে আসবে এ ভাবে আজ হবে কাল হবে করতে করতে যদি দু’বছরও অতিবাহিত হয় এ ধরনের লোক মুসাফির হিসেবেই গণ্য হবে। সর্বদা কসর নামাযই পড়বে। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪)
মুসাফিরের উপর জুমার নামায ফরজ নয়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪)
সফরে ফজরের সুন্নাত: সফর কালে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত সালাত আদায় করেছেন। (বুখারী শরীফ)
মহিলা মুহরিম ছাড়া হজ্ব ও ওমরাতে সফরে গমন নিষিদ্ধ। মহিলার জন্য স্বামী বা মুহরিম ছাড়া সফরে যাওয়া নিষিদ্ধ। হজ্ব ও ওমরার ক্ষেত্রেও এ বিধান প্রযোজ্য। কোন মহিলা যদি স্বামী বা মুহরিম ছাড়া একদিনের রাস্তার দূরত্বেও সফরে বের হয় গুনাহগার হবে। (ফতওয়া-এ রযভীয়্যাহ, খন্ড: ০১)
কসর নামাযের নিয়ত: কসর নামাযের জন্য নির্দিষ্ট ওয়াক্তের নিয়্যত করতে হবে। যেমন আমি মুসাফির হিসেবে জোহরের ফরজ নামায চার রাকাতের স্থলে দু’রাকাত পড়ার মনস্থ করলাম। আরবিতে “নাওয়াইতু আন আকসূরা লিল্লাহি তা’আলা রাকাতাঈ সালাতিয যোহরি ফারদুল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শরীফাতি আল্লাহু আকবর।” হে আল্লাহ, আমরা সফরকালে তাকওয়া ও সওয়াবের প্রার্থনা করছি সফরকে আমাদের জন্য সহজ করুন।
হে আল্লাহ, আমাদের সফর কালে আপনিই আমাদের ও পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণকারী। আমাদের ইহকাল পরকালে আপনিই সুস্থতা ও নিরাপত্তা দানকারী, আপনিই শ্রেষ্ট দয়ালু।
হে আল্লাহ, নামাযের বিধানাবলী সঠিকভাবে আমল করার তাওফিক দিন, পবিত্র কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা নাজাত দান করুন। নিশ্চয় তিনি দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।