মাগরিবের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল
আলকুরআনের আলোকে মাগরীব নামাযের গুরুত্ব:
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরা বিভিন্ন আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং নামায কায়েম কর দিবসের দুই প্রান্তে এবং রাতের কিছু অংশে। (সূরা: হুদ, আয়াত: ১১৪)
বর্ণিত আয়াতে করীমায় তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে ফজর, মাগরীব ও এশার নামায ফরজ হওয়ার প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে।
হাদীস শরীফের আলোকে মাগরীবের নামায: “হযরত সালামাহ ইবনে আকওয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরীবের নামায ঐ সময় আদায় করতেন যখন সূর্য অস্তমিত হত, যখন সূর্য তার পর্দাবৃত হত। (মুসলিম শরীফ, হাদীস: ৬৩৬)
সাহাবায়ে কেরাম নাযাম ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক আল উকাইলী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগন নামায ব্যাতীত অন্য কোন আমল ত্যাগ করাকে কুফরী গণ্য করতেন না। (তিরমিযী শরীফ, ২৬২২)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার উম্মত কল্যাণের উপর অথবা বলেছেন ফিতরাতের উপর থাকবে। যতদিন পর্যন্ত মাগরীবকে বিলম্ব করবেনা যতক্ষন না আকাশের তারকাগুলো চমকানোর পূর্ব পর্যন্ত। (আবু দাউদ শরীফ)
হাদীসে “ফিতরাত” শব্দ দ্বারা নবীদের সুন্নাত বুঝানো হয়েছে।
মাগরীবের নামাযের সময়:রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মাগরীবের নামাযের সময় হচ্ছে যতক্ষণ না “শাফাক” বা আভা ডুবে যায়। (মুসলিম শরীফ, ৬১২)
সূর্য ডুবে যাওয়ার পরই মাগরীবের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর শেষ সময় সম্পর্কে ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)’র মতে “শাফাক” বা পশ্চিমাকাশের লালিমা দুরীভূত না হওয়া পর্যন্ত মাগরীবের নামাযের সময়সীমা অবশিষ্ট থাকে।
ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) বলেন, পশ্চিমাকাশে লালিমার পর যে সাদা আভা দেখা যায় তাকে শাফাক বলে। ঐ সময়কে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরীবের শেষ সময় স্থির করেছেন। [মিরআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৪০, কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]
মাগরীবের ফরজের পর দুই রাকাআত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়ার ফযীলত: প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত মাকহুল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাগরীবের ফরজ আদায় করার পর কথাবার্তা বলার পূর্বে দু রাকাআত সালাত আদায় করবে তার নামায ইল্লিায়্যিনে লিপিবদ্ধ হবে। অথবা ইল্লিয়্যিনে পৌছানো হবে। (মিশকাত শরীফ, হাদীস: ১১৮৪)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত আবুল আলিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি হুযায়ফা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা মাগরীবের পর দু’রাকাআত নামায তাড়াতাড়ি পড়ো। তা ফরজের সাথে পেশ করা হবে। (মিশকাত শরীফ, হাদীস: ১১৮৫)
পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কারী মু’মিন বান্দাগন জান্নাতে যাবে:
নামায ঈমানের নিদর্শন, নামায বান্দাকে আল্লাহর নৈকট্য দান করে, নামায বান্দাকে মিথ্যাচার পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত রাখে। নামায বান্দার নৈতিকতাকে পরিশুদ্ধ রাখে। নামায বান্দাকে ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। নামায নিয়মানুবর্তিতা ও সময় সচেতনতা সৃষ্টি করে। নামায বান্দার অন্তরকে আলোকিত করে। চেহারায় উজ্জ্বলতা আনে। নামায কবরে হাশরে পুলসিরাতে বান্দার জন্য নূর ও মূক্তির সনদ হবে। ইসলামের প্রতিটি বিধান যথাযথ প্রতিপালন ও নামাযের সংরক্ষণ বান্দাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত করো, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করো, রমজান মাসে রোজা রাখো, তোমাদের প্রভূর বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্বব্রত পালন করো, তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে তোমাদের ধনসম্পদের যাকাত আদায় করো, তাহলে তোমরা তোমাদের প্রভূর জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বাদ্দায়েউস সানায়ে, খন্ড:১, পৃ: ৮৯)
পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কারীর জন্য পাঁচটি নিয়ামত: পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে যত্নবান বান্দাকে আল্লাহ তা’আলা পাঁচটি নিয়ামত দানে ধন্য করবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথ হিফাজত করে আল্লাহ তাঁকে পাঁচটি নিয়ামত দান করেন। তার মৃত্যু যন্ত্রণা উঠিয়ে নেয়া হবে। কবরের আযাব তুলে নেয়া হবে। তাঁর আমলনামা তাঁর ডানহাতে দেয়া হবে। বিদ্যুৎগতিতে পুলসিরাত অতিক্রম করবে। বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [আল মুনাব্বিহাত, কৃত: আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (র.)]
মাগরীবের সুন্নাতের পর ছয় রাকাআত আওয়াবীন নামাযের ফযীলত: হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরীবের পর ছয় রাকাত নামায পড়তে দেখেছি, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাগরীবের পর ছয় রাকাআত নামায পড়বে, তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। যদিও উহা সমুদ্রের ফেনারাশির সমান হয়। (তাবরানী)
তিরমিযী শরীফের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি মাগরীবের পর ছয় রাকাআত (আওয়াবীন) নামায আদায় করবে, সে একাধারে বার বৎসর দিনে রোজা রেখে রাতে জেগে ইবাদত করার সমপরিমাণ সওয়াব অর্জন করবে। (তিরমিযী)
মাগরীবের তিন রাক’আত ফরজের নিয়্যত: নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা সালা-সা রাক’আতে সালাতিল মাগরীব, ফারদ্বুল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবর।
মাগরীবের নামায সাত রাক্আত: ফরজ তিন রাক’আত, সুন্নাতে মুআক্কাদাহ দুই রাকআত, নফল দুই রাক’আত।
মাসআলা: মাগরীবের নামায সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে পড়া মুস্তাহাব। (আলমগীরি ১ম খন্ড)
মাসআলা: মাগরীবের নামাযে দু’রাকাত নামায পড়ারমত সময় থেকে অধিক দেরী করা মাকরূহ তানযিহী হবে। এবং সফর, অসুস্থতা ইত্যাদির অজুহাত ব্যাতীত তারকা সুস্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত দেরী করা মাকরূহ তাহরীমি। [বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১, ফতোওয়ায়ে রিজভীয়্যাহ, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৫৩, কৃত: আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.)]
মাসআলা: হজ্বের সময় মুযদালিফার ময়দানে মাগরীব এবং এশা নামায এশার সময়ে পড়ে নিবে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড ৩য়, পৃ: ১৩১)
মাসআলা: মাগরীবের সময় কমপক্ষে ১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। আর বেশীর মধ্যে ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। (বাহারে শরীয়ত, ফাতওয়া-এ রযভীয়্যাহ, খন্ড: ২, পৃ: ২২৬, মু’মিন কী নামায, কৃত: আল্লামা আবদুস সাত্তার ছামদানী), মাসআলা: সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে মাগরীবের ফরজ পর্যন্ত সর্ব প্রকার নফল নামায নিষিদ্ধ। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৩৩)।
হে আল্লাহ! আমাদের কে তোমারই স্মরণে পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ সফিউর রহমান বুলবুল
মধ্য-হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: যে মসজিদে ইমাম মুযাজ্জিন নিযুক্ত আছে সেখানে প্রথম জামাত হওয়ার পর সেখানে আজান ইকামত সহকারে দ্বিতীয় জামাত কায়েম করা সম্পর্কে শরয়ী বিধান জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: মহল্লার যে মসজিদে ইমাম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত আছে সেখানে আজান ইকামত সহকারে প্রথম জামাত কায়েম হওয়ার পর পুনরায় আজান ইকামত সহকারে প্রথমবারের ন্যায় জামাত কায়েম করা মাকরূহ। আজান ছাড়া যদি দ্বিতীয় জামাত হয় ক্ষতি নেই। যদি মেহরাব থেকে সরে পড়া হয়। যদি প্রথম জামাত আজান ছাড়া হয়ে থাকে বা আজান ধীরে হয়েছে বা অন্য লোকেরা জামাত কায়েম করেছে তখন পুনরায় জামাত কায়েম করা যাবে। ইমাম মেহরাব থেকে ডানে বামে সরে দাঁড়ানোটা যথেষ্ট। মহাসড়কের মসজিদে যেখানে মানুষ দলে দলে আসে এবং নামায পড়ে চলে যায় অর্থাৎ নির্দিষ্ট নামাযী নেই। এমন মসজিদে যদিও আজান ইকামত সহকারে দ্বিতীয় জামাত কায়েম করা হয় কোন ক্ষতি নেই। বরং এটাই উত্তম যে, যে দল আসবে নতুন ভাবে আজান ইকামত সহকারে জামাত পড়বে। অনুরূপ ষ্টেশন ও সড়ক মসজিদে। (দুররুল মোখাতার, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৩য় খণ্ড, পৃ: ২৩২)