প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, আল্লাহর নবী রাসূলগন পৃথিবীর দেশে দেশে আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদ প্রচারের লক্ষ্যে তাবলীগে দ্বীনের মাধ্যমে মানবজাতিকে প্রকৃত আদর্শবান ও চরিত্রবান মানুষে রূপান্তর করার যে অবর্ণনীয় ত্যাগ তীতিক্ষা দু:খ কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীর ইতিহাসে নবী রাসূলগনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ঐতিহ্য ও কীর্তিসমূহ অনেক বেশী বিস্ময়কর। অথচ দু:খ জনক হলেও সত্য যে, সর্বাধিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকারী মুসলমানগন আজ নবী রাসূলগনের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে উদাসীন ও নির্বিকার। নবী রাসূলগণের জীবনাদর্শ, ধর্মপ্রচার, দ্বীনি দাওয়াত, কুফর শির্ক বিদআত ও অনৈসলামিক কর্মকান্ড প্রতিরোধ ও মূলোৎপাটনে তাঁদের কর্ম কৌশল হিকমতপূর্ণ দাওয়াতী কার্যক্রমের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গবেষণায় রয়েছে সত্যান্বেষীদের জন্য মুক্তির দিক দর্শন ও অপরিহার্য উপাদান।
হযরত নূহ (আ.) ছিলেন পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরিত প্রথম রাসূল:
আদি পিতা হযরত আদম (আ.)’র পর পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরিত প্রথম রাসূল ও শরীয়ত প্রবর্তক হযরত নূহ আলাইহিস সালাম। তাঁেক “আদমে ছানি” মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা নামে বলা হয়। মানব জাতির হিদায়ত ও সংশোধনের জন্য আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নবুওয়ত ও রিসালাত দান করে নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন। পবিত্র কুরআনের ২৮টি সূরার ৪৩ জায়গায় নূহ (আ.)’র নাম ও আলোচনা এসেছে। পবিত্র কুরআনের একটি সূরা “তাঁর নামে সূরা নূহ” নামকরণ হয়েছে।
হযরত নূহ (আ.)’র জন্ম ও বংশ পরিচয়:
“নূহ” এটি তাঁর উপধি। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুশ শাকুর ও আবদুল গাফফার। “নূহ” অর্থ ক্রন্দন, তিনি তাঁর কওমের গুণাহের কারণে অধিক ক্রন্দন করতেন, এ জন্য নূহ নামে প্রসিদ্ধ। (হায়াতুল হায়ওয়ান, খন্ড:১, পৃ: ১২) অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি তাঁর নফসের উপর ক্রন্দন করতেন। (তাফসীর রুহুল মাআনী) নূহ (আ.)’র জন্মসন খ্রি. পূর্ব ৩৮০০–২৮৫০ এর মধ্যবর্তী সময় বলে অনুমান করা হয়। এক বর্ণনা মতে হযরত আদম (আ.)’র ইন্তিকালের ১৪৬ বছর পর হযরত নূহ (আ.) জন্ম গ্রহণ করেন। অন্য বর্ণনা মতে হযরত আদম (আ.)’র ইন্তিকাল হতে হযরত নূহ (আ.)’র জন্ম পর্যন্ত ব্যবধান ছিল ১০২৬ বছর। তিনি ছিলেন আদম (আ.)’র অষ্টম অথবা দশম অধস্তন পুরুষ।
হযরত নূহ (আ.)’র সন্তান: ইমাম কুরতুবী ও আল্লামা ইবনে কাছীর এর বর্ণনা মতে নূহ (আ.)’র চারজন পুত্র সন্তান ছিল সাম, হাম, ইয়াফিছ ও ইয়াম অথবা কেনআন, প্রথম তিনজন ঈমান গ্রহণ করেন শেষোক্তজন ঈমান আনেননি, মহাপ্লাবনে ডুবে মারা যায়। (তাফসীরে কুরতুবী)
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে আরবের সকল গোত্রই নূহ (আ.)’র পুত্র সামের বংশধর। রোম ও পারস্যবাসীরাও সামের বংশধর। হিন্দুস্থান, সিন্ধু ও হাবশার লোকেরা হামের বংশধর। ইয়াজুজ মাজুজ, তুর্কী ও সালাব জাতি হলো ইয়াফেসের বংশধর। (বুস্তানে আবুল লাইস)
আল্লামা ইবন কাছীর আদ–দিমাশকী (রহ.)’র বর্ণনামতে মহাপ্লাবনের পূর্বে নূহ (আ.)’র ছিল দু’জন স্ত্রী একজন ছিলেন ঈমানদার যিনি নৌকায় আরোহন করে মুক্তি পেয়েছিলেন, অন্যজন ঈমান আনেনি প্লাবনে ডুবে মারা যায়।
হযরত নূহ (আ.) ছিলেন তাঁর জাতিকে সতর্ককারী:
হযরত আদম (আ.)’র ইন্তিকালের পর শত শত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কালক্রমে পৃথিবীতে অসংখ্য আদম সন্তানের আবির্ভাব হলো, একদল আদম সন্তান আল্লাহকে ভুলে গেল, কুফর শির্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়লো, মিথাচার পাপাচার নিজেদের তৈরী প্রতিমা ও মূর্তি পুজা শুরু করলো এ পথভ্রষ্ট বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীকে হিদায়াত ও আলোর পথে দিশা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ (আ.) কে প্রেরণ করলেন, তিনি মানব জাতিকে হিদায়াত ও কল্যাণের পথে দাওয়াত দিলেন, আল্লাহ তা’আলা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করলেন, “আমি তো “নূহ” কে তার জাতির প্রতি প্রেরণ করেছিলাম যে আপনি স্বীয় কওমকে সতর্ক করুন, তাদের প্রতি যন্ত্রদায়ক আযাব আসার পূর্বে তিনি বলেছিলেন, হে আমার কওম! আমি তো তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী। (সূরা নূহ, আয়াত: ১–২)
তিনি স্বীয় জাতিকে সতর্ক বার্তা দিলেন, তোমরা কুফর, শির্ক, মূর্তি পূজা ত্যাগ করো, স্বীয় পাপাচার থেকে মুক্তি ও পরিত্রানের জন্য আল্লাহর দরবারে তাওবা করো, মহান আল্লাহর আনুগত্য করো, আল্লাহর ইবাদত করো, মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত কাজ আদায় করো, আল্লাহ তা’আলা যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরিত, তোমরা আমার আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ কর মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন, উত্তম প্রতিদান দেবেন, হযরত নূহ (আ.) ৯৫০ বছর জীবিত ছিলেন এ সুদীর্ঘ সময়ে অতি অল্প সংখ্যক লোকই তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিলেন। তাঁর কথায় কর্ণপাত করলনা, তাঁকে উপহাস ও ব্যঙ্গবিদ্রুপ করল, অবজ্ঞা করল, তাঁকে পাগল ও মিথ্যাবাদী বলে অবিহিত করল এমনকি এক পুত্র ও এক স্ত্রীও তাঁর প্রতি ঈমান আনেনি। এ অবাধ্য পথভ্রষ্ট জাতির একগুয়েমি আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে শত শত বছর দাওয়াত ও তাবলীগ করার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন এ পাপিষ্ট জাতি পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। নবীদ্রোহী অবাধ্য জাতি পৃথিবীর জন্য কোনো ভাবেই কল্যাণকর নয়। তিনি এ পাপিষ্ট জাতির ধ্বংসের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, আর নূহ আরো বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি কাফেরদের মধ্য থেকে একজন গৃহবাসীকেও জমিনে অবশিষ্ট রাখবেন না। যদি আপনি তাদেরকে জমিনে অবশিষ্ট রাখেন, তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দেবে কেবল পাপাচারী ও কাফের। (সূরা: নূহ, আয়াত: ২৬–২৭)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) তাফসীরে নুরুল ইরফানে বর্ণনা করেন, আল্লাহর নবী হযরত নূহ (আ.) নবুওয়তের নূর দ্বারা ভবিষ্যৎ বংশধরদের দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য সম্পর্কে অবগত হন। যেমন নূহ (আ.) আরজ করেন, এখন তাদের বংশে মু’মিন পয়দা হবেনা, এটাও পাঁচ বিষয়ের জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত যা মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন।
হযরত নূহ (আ.) কর্তৃক পিতা মাতার জন্য দুআ:
হযরত নূহ (আ.) স্বীয় পিতা মাতার জন্য দুআ করেছেন, পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার মাতা–পিতাকে এবং তাকে যে ঈমান সহকারে আমার ঘরে রয়েছে এবং সমস্ত মুসলমান পুরুষ ও সমস্ত মুসলমান নারীকে আর কাফিরদের জন্য শুধু ধ্বংশই বৃদ্ধি করো। (সূরা: নূহ, আয়াত: ২৮)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে নূরুল ইরফানে উল্লেখ হয়েছে, হযরত নূহ (আ.)’র মাতা পিতা মু’মিন ছিলেন। তিনি তাঁদের মাগফিরাতের জন্য দুআ করেছেন। অন্যথায় দুআ করতেন না। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো নবীদের ঘর নিরাপত্তার রাজ্য হয়ে থাকে, যে মু’মিনই নবীর দামনে আশ্রয় গ্রহণ করবে নবীর ওসীলায় সে আল্লাহর নিরাপত্তায় এসে যায়। প্রতীয়মান হলো নিজ অবাধ্য সন্তান কিন’আন প্লাবনে নিমজ্জিত হওয়াও তাঁর দুআর কারণে হয়েছে, অর্থাৎ যারা যালিম ও কাফির হবে তারা আমার ঘরে থাকলেও তাদের ধ্বংস করে দিন। যেমন আমার স্ত্রী ওয়াইলাহ ও পুত্র কিন’আন। (তাফসীরে নুরুল ইরফান, পারা–২৯, পৃ: ১৫৫৪)
নবীর প্রতি অবাধ্য হওয়ার কারণে স্ত্রী পুত্র হয়েও রক্ষা পায়নি।
আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসীদের জন্য নূহ (আ.)’র দুআ:
হযরত নূহ (আ.) তাঁর অনুসারীদেরকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করেন, মহান আল্লাহ তাঁর নবীর দুআ কবুল করেন। আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি বৃহদাকার নৌকা নির্মাণের জন্য আদেশ করেন। তদানুযায়ী নূহ (আ.) নৌযান নির্মানের কাজ আরম্ভ করেন (সূরা: হুদ, ১১:৩৭)
নূহ (আ.) কে নৌযান নির্মাণ করতে দেখে অবিশ্বাসীরা ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগলো, তারা মন্তব্য করলো এখান থেকে শত শত মাইল দূরে সাগরের অবস্থান এতো দূরত্বের ব্যবধানে এতো বিশাল নৌযান নির্মাণের যৌক্তিকতা তারা অনুধাবন করতে পারল না। অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহর নবীর মর্যাদা ও খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা বুঝতে তারা ব্যর্থ হলো। নূহ (আ.) বিদ্রুপকারীদের জানালেন যে অচিরেই একটি বন্যা তাদেরকে গ্রাস করবে এবং তারা আশ্রয় গ্রহণের কোন স্থান পাবেনা। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা শীঘ্রই সত্যে পরিণত হলো। অকস্মাৎ আকাশ কালো বর্ণ ধারন করল বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হল থামছেই না। বন্যায় প্লাবিত হলো সবকিছু, সর্বত্র পানি আর পানি, জীবিত সবকিছু পানিতে ডুবে মারা গেল, ব্যাতিক্রম শুধু তারা যারা নৌযানে আশ্রয় নিয়েছিল। (সূরা: হুদ, ১১: ৪০–৪১)
বন্যার পানিতে সর্বোচ্চ পর্বত পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল বন্যার পর নৌযান বর্তমান ইরাকের মাওসেল এলাকার উত্তর সীমান্তে জুদী পর্বতে অবতরণ করে, এ জাহাজ নির্মাণে নূহ (আ.)’র দু’বছর সময় লেগেছিল। (তাফসীরে সাবী, খন্ড:৩)
এ জাহাজের দৈর্ঘ্য ছিল তিনশ হাত, প্রস্থ ছিল পঞ্চাশ হাত, উচ্চতা ত্রিশ হাত, জাহাজটি তিনতলা বিশিষ্ট ছিল, জাহাজে আরোহী ছিলেন, আশিজন অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক মহিলা। কারো মতে নারী পুরুষ মিলে ৭০ জন ছিল। (তাফসীর সাবী, খন্ড:১)
জাহাজ দীর্ঘ ছয় মাস পর মহররম মাসের দশ তারিখে আশুরা দিবসে ইরাকের মুসেল শহরের সুউচ্চ জুদী পর্বতের গিয়ে থামে। তাফসীরকারদের মতে এক বর্ণনায় প্লাবনের পর তিনি ষাট বছর জীবিত ছিলেন। অন্য বর্ণনা মতে ২৫০ বছর জীবিত ছিলেন। (তাফসীরে সাবী, খন্ড: ২)
ইন্তিকাল:
হযরত নূহ (আ🙂 ৯৫০ বছর হায়াত লাভ করেন। আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “আর আমি তো নূহকে তার কওমের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম তিনি তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর অবস্থান করে ছিলেন। (সূরা: আনকাবুত, ২৯:১৪)
আল্লাহ তা’আলা আমাদের দ্বীনি দাওয়াত প্রচারে নবী রাসূলগনের আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ রিদওয়ানুল হক
চকবাজার, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: জানাযার পর দুআ করা শরীয়ত সম্মত কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।
প্রশ্নের উত্তর: নামাযে জানাযার পর দুআ করা মুস্তাহাব ও উত্তম আমল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তোমরা আমার নিকট দুআ করো, আমি তোমাদের দুআ কবুল করবো। (সূরা: মু’মিন, আয়াত: ৬০)
হাদীস শরীফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যখন তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাযা পড়বে তখন একনিষ্টভাবে তার জন্য দুআ করো। (সুনানে ইবনে মাযাহ, পৃ: ১০৭)
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামাযে জানাযা পড়ার পর মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করতেন। (বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, খন্ড: ৪, পৃ: ৭৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, রাতের শেষ অংশের মধ্যভাগে এবং প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর দুআ কবুল করা হয়। (জামে তিরমিযী, খন্ড: ২, পৃ: ১৮৭)











