জুম্‌’আর খুতবা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কুরআনের আলোকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের প্রতি ভালবাসা: হে মানব মন্ডলী! আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন, মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা প্রদর্শন করুন, কথায় কাজে কর্মে ইসলামের প্রতিটি বিধান পালনে নবীজির অনুসরণের মাধ্যমে প্রিয় নবীর প্রতি ভালবাসা প্রমাণ করুন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “হে নবী আপনি বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ পাকও তোমাদের কে ভালবাসবেন। এবং তোমাদের গুণাহসমূহ মার্জনা করবেন, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা: আলে ইমরান: আয়াত: ৩১)

নবীজির প্রতি মহব্বত প্রকাশ পাবে মু’মিনের কথায়, কর্মে, জীবন, আচারে ব্যবহারিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে ভালবাসার বহি: প্রকাশ ঘটবে, ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (.) বলেন, ভালবাসা অন্তরাত্মার জীবনী শক্তি, রুহের খাদ্য, নবীজির প্রতি মহব্বত ঈমানের প্রাণ, নবীপ্রেম থেকে আমল যখন শূন্য হয়ে যায় তা প্রাণহীন দেহতুল্য হয়ে যায়। নবীজির প্রতি ভালবাসা দাবীকারীর কর্তব্য হলো, তাঁর জীবনাদর্শ তাঁর দেহ মোবারকের অবয়ব, চলাফেরা, রীতিনীতি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করা। সত্যিকার নবী প্রেমিকের জীবনাচারে তাঁর জীবনাদর্শ প্রতিফলিত হয়। নবীজির প্রদর্শিত পথে চলা তাঁর নিষেধাবলী বর্জন করা, তাঁর সুমহান শানমান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি যথার্থরূপে শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখা ভালবাসার নামান্তর।

হাদীস শরীফের আলোকে নবীজির প্রতি ভালবাসা: সুপ্রিয় ভাইয়েরা! জেনে রাখুন, নবীজির প্রতি মহব্বত ব্যাতীত প্রকৃত মু’মিন হওয়া যায়না। মু’মিনের ঈমান নবী প্রেম ছাড়া পরিশুদ্ধ হবেনা, নবীর সমুন্নত মর্যাদার যথার্থ স্বীকৃতি ও বাস্তবায়নের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হওয়ার নাম হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবীজিকে নিজের প্রাণ, সন্তানসন্তুতি পৃথিবীর সকল মানুষের চেয়ে প্রাণাধিক ভালবাসা প্রদর্শন না করলে ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত মু’মিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তাঁর পিতার তাঁর সন্তান ও সকল মানুষের অপেক্ষা অধিক প্রিয় হই। (বোখারী শরীফ, ১ম খন্ড, পৃ: ১৪)

ভালোবাসার প্রিয় নাম “মুহাম্মদ”: হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ্‌ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,“হে প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার মহানত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের শপথ! আমি ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামে শাস্তি দিবনা, যার নাম আপনার নামানুসারে হবে।” [সীরতে হালভীয়া, খন্ড ১ম, পৃ. ১৩৫, আনোয়ারে মোহাম্মদীয়া, পৃ. ৩১৬]। মক্কাবাসীরা বলেন, “যে ঘরে মুহাম্মদ নামের কেউ থাকবে, সেই ঘরে বরকত ও সমৃদ্ধি হবে, অধিক রিযক্বপ্রাপ্ত হবে। তাঁর প্রতিবেশীও রিযক প্রাপ্ত হবে।” [শিফা শরীফ, ১ম খন্ড, পৃ. ১০৫]

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, যে ঘরে বা যে মজলিসে ‘মুহাম্মদ’ নামের কোন ব্যক্তি থাকবে সেই গৃহ ও মজলিস বরকতপূর্ণ হবে। [কাশফুল গুম্মাহ্‌, খন্ড১ম, পৃ. ২৮৩]

নাম মুবারকের বরকতে ছেলে হবে এবং জীবিত থাকবে।

হযরত আল্লামা ইসমাঈল হক্কী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, “যার স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছে আগত শিশুর নাম মুহাম্মদ রাখার ইচ্ছা পোষণ করলে আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাকে পুত্র সন্তান দান করবেন। যার শিশু জীবিত থাকেনা, সে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আগত সন্তানের নাম ‘মুহাম্মদ’ রাখার ইচ্ছা পোষণ করবে তখন তার শিশু বেঁচে থাকবে।” [রুহুল বয়ান, খন্ড ৭ম, পৃ. ১৮৪]

নবী প্রেমিকদের হাশর প্রিয় রাসূলের সাথে হবে: সুপ্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! জেনে রাখুন! রাসূলুল্লাহ’র প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করা ঈমানের মূল। নবীপ্রেম ছাড়া কখনো পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবেনা। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলো কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে, নবীজি উত্তর দিলেন তুমি কিয়ামতের জন্য কী প্রসু্ততি নিয়েছ? লোকটি বলল, আমার কাছে তো তেমন কিছু নেই, ইমাম আহমদের বর্ণনায় এসেছে লোকটি বললো আমি তো এর জন্য বেশী কিছু প্রস্তুত করিনি, না অধিক নামায পড়েছি না অধিক রোজা রেখেছি, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলকে অধিক ভালবাসি, রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন, তুমি যাকে ভালবাস কিয়ামত দিবসে তাঁর সাথেই থাকবে। হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমরা এ সংবাদে যত বেশী খুশী হয়েছি অন্য কোন সংবাদে এত বেশী খুশী হইনি। রাসূলুল্লাহ’র বাণী তুমি যাকে ভালবাসো তুমি তার সাথে থাকবে। হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসি। হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা.) কে ভালবাসি, আমি আশা রাখি, তাঁদের প্রতি ভালবাসার কারণে আমি তাঁদের সঙ্গী হব। যদিও আমার আমল তাঁদের আমলের ন্যায় নয়। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৩৪৮৫, মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৬৩৯)

রাসূলুল্লাহর আনুগত্য ছাড়া নবীজির প্রতি ভালবাসা গ্রহণীয় নয়: ভালবাসা ও অনুসরণ দু’টি পরিপূরক। আনুগত্য ছাড়া ভালবাসা গ্রহণযোগ্য হবেনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ছাড়া ঈমান ও আমল কবুল হবেনা। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিন বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যারা অস্বীকার করে তারা ব্যতীত আমার সকল উম্মতই বেহেস্তে প্রবেশ করবে। নবীজিকে জিজ্ঞেস করা হলো কে অস্বীকার করেছে? নবীজির এরশাদ করেছেন, যে আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে আমার আনুগত্য করলোনা সেই অস্বীকার করলো। (বুখারী শরীফ)

সাহাবায়ে কেরামের ভালবাসার নমুনা: হযরত উরওয়াহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, হুদায় বিয়ার সন্ধির সময় আমি মক্কার কাফিরদের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে আমি বিমুগ্ধ হই। এরূপ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন তার আগে আমি কখনো দেখিনি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ব্যবহৃত অযুর পানি কার আগে কে নেবে এ নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। এমনকি পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন। যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো কাজের নির্দেশ দিতেন তখন তা দ্রুত পালন করতেন। যখন অযু করতেন তখন লোকেরা তার ব্যবহৃত পানির জন্য প্রতিযোগিতা করতেন। যখন তিনি কথা বলতেন তখন সহাবীরা নিশ্চুপ হয়ে যেতেন, আর তাঁর সম্মানার্থে তাঁর দিকে চোখ তুলে থাকাতেন না। অত:পর উরওয়াহ কুরাইশদের কাছে গিয়ে বলতেন, হে কুরাইশ! আমি পারস্য সম্রাট খসরু (কিসরা) এবং রোম সম্রাট কায়সারের দরবারে গিয়েছি। আবসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর দরবারেও আমি গিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা তাঁকে যেরূপ ভক্তি শ্রদ্ধা ও সম্মান করে কোন বাদশাহের দরবারে তা আমি দেখিনি। আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সংঘবদ্ধ এমন এক জনগোষ্টী দেখেছি যাঁরা কখনো তাঁকে ছেড়ে যাবে না। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ২৫৮১)

হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার ভালবাসা ও আপনার প্রিয় হাবীবের ভালবাসা নসীব করুন। নবীজির প্রতি ভালবাসাকে ইহকাল পরকালের সৌভাগ্য অর্জনের অবলম্বন করুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা পরিত্রাণ নসীব করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পূণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ আবদুল আজিজ

চেচুরিয়া, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: আজান ও ইকামতে নবীজির নাম শুনে বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বন করা নিয়ে অনেকে আপত্তি করেন। এ বিষয়ে শরয়ী সমাধান জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: আজান ও ইকামতে নবীজির নাম মুবারক শ্রবণের পর বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বন করে চক্ষুদ্বয়ে লাগানো শরীয়ত সম্মত মুস্তাহাব আমল। ফিকহ শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ ফাতওয়াএ শামীতে আজান অধ্যায়ে উল্লেখ আছে, প্রথম শাহাদাতের পর “সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ”, দ্বিতীয় বারে “কুররাতু আইনী বিকা ইয়া রাসূলাল্লাহ।” অত:পর “আল্লাহুম্মা মাত্‌তি’নী বিসসামঈ ওয়াল বাসারি” বলে দুই বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ চুম খেয়ে চোখে লাগাবে। এরূপ আমলকারীকে কিয়ামত দিবসে নবীজি সাথে করে জান্নাতে নিয়ে যাবে। [রদ্দুল মুখতার, ১ম খন্ড, আযান অধ্যায়, পৃ.২৯৩]

হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়া আল্লাহু আনহুকে অনুরূপ আমল করতে দেখে নবীজি এরশাদ করেছেন, আমার প্রিয় বন্ধু যেরূপ করেছে অনুরূপ আমল যে করবে তার জন্য আমার শাফায়াত হালাল হয়ে যাবে। [আল মাকাসিদুল হাসান, পৃ: ৩৮৪, হাদীস নং ১০২১, আহকামে শরীয়ত, ১ম খন্ড, পৃ: ৬৬, কৃত : ইমাম আহমদ রেযা (.)। এ বিষয়ে আ’লা হযরত (.) স্বতন্ত্র কিতাব “মুনিরুল আইন ফী হুকমী তাকভীলিল ইবহামাঈন” রচনা করেন। ফাতওয়াএ ফয়জুর রাসূল, ১ম খন্ড, পৃ: ২২৩,২২৪, কৃত: মুফতি জালাল উদ্দিন আমজাদী (.), ওয়াকারুল ফাতাওয়া ১ম খন্ড, পৃ: ১০৬, কৃত: আল্লামা মুফতি ওকার উদ্দিন বেরলভী (.), মু’মীন কী নামায, পৃ: ২৯১, কৃত: আল্লামা আবদুস সাত্তার হামদানী (.)]

পূর্ববর্তী নিবন্ধরুচিবোধ : আমাদের প্রতিবেশ নির্মাণের সহায়ক শক্তি
পরবর্তী নিবন্ধআমির ভাণ্ডারে সালাওয়াতে রাসূল (সা.) মাহফিল