জুম্’আর খুতবা

কুরআর ও হাদীসের আলোকে দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৫ জুলাই, ২০২৫ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, বান্দা হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হোন। দায়িত্বের প্রতি অনীহা প্রকাশ ও অবহেলা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকুন, দায়িত্ব পালন কারীর জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতা থাকা বাঞ্চনীয়, সমাজের প্রতিটি পেশার ও শ্রেণির মানুষের দায়িত্ব পালন ও জবাব দিহিতা নিশ্চিত করা হলে সমাজের সমস্যা ও সংকট দূরীভূত হবে, শান্তিপূর্ণ সমাজ, প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার ও আনুগত্য প্রকাশ বান্দার প্রথম কাজ: মহান আল্লাহ বান্দাকে অহেতুক অনর্থক বৃথা সৃষ্টি করেনি, বান্দাকে সৃষ্টির উদ্দ্যেশ্য অনুধাবন, এর লক্ষ্য অর্জনে বান্দা মনোনিবেশ করলে বান্দার ইহকাল ও পরকাল ধন্য। মহান আল্লাহ আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বান্দাকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে জমীনে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এ জন্য যে তারা আমারই ইবাদত করবে। (সূরা: যারিয়াত, ৫১৫৬)

দায়িত্ব হলো আপনার উপর অর্পিত কাজ। নিয়ম অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করা। কর্তব্য হলো একটি নির্দিষ্ট কাজ যা করতেই হবে।

আল্লাহ বান্দাকে দায়িত্ব ছাপিয়ে দেন না: আল্লাহ তা’আলা বান্দার প্রতি দয়াবান ও করুণাময়। কাজের স্তর অনুযায়ী যোগ্যতা ও সামর্থ দান করেছেন। বান্দা সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে যেন সফল হতে পারেন। দায়িত্বের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আল্লাহ তা’আলা কাউকে কষ্ট দেন না। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থের বাইরে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সে যা অর্জন করবে তা তার জন্যই এবং সে যা কামাই করে তা তার উপরই বর্তাবে। হে আমাদের প্রতিপালক? আমরা যদি ভুলে যাই, অথবা ভুল করি, তাহলে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, হে আমাদের রব! আমাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেবেন না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এমন কিছু বহন করাবেন না, যার সামর্থ্য আমাদের নেই। আর আপনি আমাদেরকে মার্জনা করুন এবং আমাদের ক্ষমা করুন আর আমাদের উপর দয়া করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক। অতএব আপনি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন। (সূরা: বাকারা, :২৮৬)

ইসলামে জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতা: দায়িত্ব ও জবাব দিহিতা একটি অপরটির পরিপূরক। পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্তর ভেদে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সবারই দায়িত্ব নিতে হয়। দায়িত্ব পালনে যদি সচেতন ও সজাগ থাকেন সিংহভাগ সমস্যা দূর হয়ে যায়। কারো অভিযোগ করার সুযোগ থাকেনা, দায়িত্ব পালনে যদি জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতা থাকে সেক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত অবহেলা কম হয়। কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা ও পরকালে নিজ কর্মের পরিণাম ভোগ করতে হবে মর্মে আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি হৃদয়ে জাগরুক থাকলে অন্যায় অসত্য অপকর্ম অপরাধ কর্ম থেকে নিজকে বাচিয়ে রাখা সহজ হয়। একটি সুন্দর মহৎ ও আদর্শ জীবন গঠনে মানুষ সক্ষম হয়। ইসলাম প্রতিটি পর্যায়ে দায়িত্বশীল আচরণ করার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। জবাবদিহিতার অর্থ হচ্ছে কৈফিয়ত দান। অপির্ত দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দান ও ব্যাখ্যা দান। একজন চাকরিজীবীর জন্য তার কাজের নির্ধারিত সময়টুকু কাজে নিয়োজিত থাকা, কাজে অবহেলা ও সময় অপচয় না করা, সময় তার জন্য পবিত্র আমানত হিসেবে গণ্য। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকা, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণ চিন্তা ধারণ করে উপরন্তু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনে অটল অবিচল থাকা দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার পরিচায়ক।

হাদীস শরীফের আলোকে প্রত্যেককে দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে: জবাবদিহিতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা সুস্পষ্ট। প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে কাজে কর্মে, কথা বার্তা, আচার আচরণ, লেনদেন, উঠা বসা, বক্তব্য, মন্তব্য, অন্যজনের প্রতি মূল্যায়নসহ সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কারো প্রতি কটুক্তি, কটুবাক্য, অশালীন আচরণ, ধৃষ্টতাপূর্ণ ব্যবহার, অশ্রদ্ধা, অসম্মান, অপমান ও আক্রমণাত্নক শব্দ প্রয়োগ ও ব্যবহার অমার্জনীয় অন্যায় অপরাধের শামিল। যা দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রত্যেক দায়িত্বশীলদের নিকট থেকে কাঙ্ক্ষিত আচরণই ইসলামের কাম্য। সুন্দর মার্জিত শালীন যা কিছু সবই পবিত্র, নন্দিত প্রশংসিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল, সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামী, পরিবার, সন্তান, সন্তুতির ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো ব্যক্তির কর্মচারী স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রেখো! প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৭১৩৮)

অযোগ্য ব্যক্তির উপর দায়িত্ব অর্পিত হলে বিপর্যয় দেখা দেবে:

যে ব্যক্তি যে কাজে যোগ্য, তাঁর উপর সে কাজের দায়িত্ব অর্পিত হলে কাঙ্খিত সুফল আশা করা যায়। অযোগ্য লোকের উপর দায়িত্ব অর্পিত হলে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা অব্যবস্থাপনা শঠতা কপটতা অন্যায় মিথ্যাচার নানাবিধ অনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটবে। বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হবে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। দলাদলি, কোন্দল, ঝগড়া ফাসাদ অশান্তি বিরাজ করবে। অযোগ্য ব্যক্তি নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দেবে। সততা, ন্যায় পরায়নতা, আদর্শিক ও মানবিক গুণাবলীর চর্চা থেকে দূরে সরে থাকবে। অযোগ্য ব্যক্তির অহংকার আমিত্ব ও দাম্ভিকতা পশুসূলভ আচরণ সর্বক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অযোগ্য লোকদের বসানো হলে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন আমানত বিনষ্ট হয়ে যাবে তখন কিয়ামতের (বিপর্যয়ের) অপেক্ষা করবে। জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমানত কিভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? নবীজি বললেন যখন কোন দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হবে তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৯৬)

অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন না করার পরিণতি: অপির্ত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে যথাযথভাবে পালন করলে মানুষ সম্মানিত হয়, প্রশংসিত হয়। মানসিকভাবে প্রশান্তি লাভ করে, সমাজ দেশ ও জাতি এমন লোকদের নিয়ে গর্ব করে। পক্ষান্তরে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরও উচ্ছপদস্থ হওয়ার পরও দায়িত্ব পালনে স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে ন্যায্য ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ না করলে জনমনে ক্ষোভ ও ঘৃণা সৃষ্টি হয়। এ জাতীয় লোকেরা সাময়িকভাবে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করে পরিতৃপ্ত হলেও একটি পর্যায়ে তারা চুডান্তভাবে লাঞ্চিত বঞ্চিত অপদস্ত ও অপমানিত হয়। তাদের ধ্বংস ও পতন অনিবার্য হয়ে উঠে, এটাই ইতিহাসের বাস্তবতা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মাকিল ইবনু ইয়াসারের নিকট তাঁর সেবা শুশ্রুষার জন্য আসলাম, এ সময় উবাইদুল্লাহ প্রবেশ করল তখন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করে শোনাব যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট থেকে শুনেছি, তিনি বলেন, কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্বভার গ্রহণ করল এবং তাঁর মৃত্যু হলো এমতাবস্থায় যে, সে ছিল খিয়ানতকারী। তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৭১৫১)

শরীয়া বিরোধী নয় রাষ্ট্রের এমন আইন মান্য করা ও সৎকাজের আনুগত্য করা নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য: ইসলামী জীবন বিধানের উৎস হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুখ শান্তি নিরাপত্তা ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কুরআন সুন্নাহর আদর্শ ও নবীজির শিক্ষা অনুসরনের বিকল্প নেই। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, হে মু’মিনগন, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা শরয়ী বিষয়ে আদেশ দানকারী (শাসক) তাদের আনুগত্য কর। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৯)

ইসলামী জীবন বিধানে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এর যথার্থ বাস্তাবায়নে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ন্যায় নীতি সামাজিক মূল্যবোধ মানবিকতা ও নিরাপদ জীবন লাভের পথ সুগম হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সত্য ও ন্যায়ের পথে সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন, দুনিয়াতে মানুষের নিকট জবাবদিহির অনুভূতি ও আখিরাতে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার কঠিন মর্তে সফলতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইলস্টোন ট্র্যাজেডি
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস