জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৪ জুলাই, ২০২৫ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

সম্মানিত ইসলামী ভাইয়েরা:

আপনারা আবগত আছেন যে, হাদীসে রসুলের আলোকে নিশ্চয় এই মাস আল্লাহর মাস মহররম, হিজরি সনের প্রথম মাস, এটাকে আল্লাহর মাস নবীদের মাস বলা হয়। এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বহু হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর পুণ্যাত্ম নেক্‌কার বান্দাগন এ মাসকে মর্যাদা দিয়েছেন। সে ব্যক্তি কতই সৌভাগ্যবান যিনি পুণ্যময় আমলের মাধ্যমে বিগত বছরকে অতিবাহিত করেছেন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, হে ঈমানদারগন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তা করা উচিৎ আগামীকালের (পরকালের) জন্য সে কি প্রেরণ করেছে। আমাদের উচিৎ আল্লাহ হিসাব গ্রহণের পূর্বে নিজেরা নিজেদের হিসাব করে নেয়া। জেনে রাখুন সৌভাগ্যবান তিনিই যিনি নিজের হিসাব নিজেই নিয়েছেন। যেমন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, (আল্লাহ কর্তৃক) তোমাদের হিসাব নেয়ার পূর্বেই তোমরা নিজেদের হিসাব করে নাও তোমাদের আমলের ওজন দেয়ার পূর্বেই নিজেরাই ওজন করে নাও। (মুসনাদে আহমদ, খন্ড:৪র্থ, পৃ: ১২৪) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে মূল্যবান মনে করো। ১.বার্ধক্যের পূর্বে যৌবন কালকে, . রোগ ব্যাধির পূর্বে সুস্থতাকে, . দারিদ্র্য আসার পূর্বে তোমার সচ্ছলতাকে, . তোমার কর্মব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে, . তোমার মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে (তিরমিযী শরীফ)

মহররম ও আশুরা দিবসে রোযা পালন:

ইসলামে রমজানের ফরজ রোজা ছাড়াও বরকতময় দিন ও মাস সমূহে রোজা রাখার বর্ণনা সিহাহ সিত্তার হাদীস শরীফ সমূহে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে দশ মুহররম আশুরার রোযা ও তৎসঙ্গে মহররমের একটি রোযা পালন করার প্রমাণ পাওয়া যায়। দুটি রোজা পালন করার বিধান নিম্ন বর্ণিত হাদীস শরীফের দ্বারা প্রমাণিত। ইয়াহুদিরা আশুরায় একটি রোজা রাখত। ধর্ম পালনে তাদের অনুকরণ ও অনুসরণ যেন না হয় বরং ইসলামের স্বকীয়তা আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। এরশাদ হয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস রাদি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা নয় ও দশই মহররম রোজা পালন করে ইয়াহুদিদের বিরোধীতা কর। [তিরমিযী শরীফ] (মাদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:, পৃ: ১২৪)

মহররম ও আশুরার পুণ্যময় আমল:

পবিত্র মহররম তথা আশুরা দিবসে এতিমদের প্রতি সদাচরণ করা, তাদের প্রতি দয়া ও করুণা প্রদর্শন করা কল্যাণ ও সওয়াবের আমল হিসেবে বিবেচিত। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে হাদীস বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে কোন এতিমের মাথার উপর হাত বুলাবে তখন আল্লাহ্‌ তা‘আলা তার জন্য এতিমদের মাথার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে জান্নাতে একটি মর্যাদা দান করবেন। [গুনিয়াতুত্‌ তালেবীন: খ ২, পৃ৫৩]

আশুরা দিবসে এতিমের জন্য পানাহারের ব্যবস্থা করা একটি পুণ্যময় আমল। এতিমের দু’আয় বালা মুসিবত দূরীভূত হয়। রিযক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। দরিদ্র অভাবী লোকদের খাদ্য পানীয় ব্যবস্থা করা, শরবত পান করানো, দান খায়রাত করা, ‘হাফতদানা’ সাতদানার ফাতিহা ব্যবস্থা, নফল নামায আদায় করা ইত্যাদি নেক আমল সমূহ বুজুর্গানে দ্বীন কর্তৃক অনুমোদিত ও স্বীকৃত।

হযরত ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজ পরিবার পরিজনের জন্য আশুরার দিবসে খরচের ক্ষেত্রে উদার হবে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা গোটা বৎসর তার রিযিকে প্রশস্থতা দান করবেন। (খুতবাতে মুহাররম, পৃ: ৪১৬)

ধর্মীয় আচার আচরণে সভ্যতা সংস্কৃতি রীতিনীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণে অমুসলিমদের অনুসরণ ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। অন্য হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করল সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। (সুনানে আবু দাউদ)

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের পৃথিবীতে মুসলমানরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম পবিত্র ইসলামের আদর্শ শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে আকন্ঠ নিমজ্জিত। যে শ্রেষ্ঠতম আদর্শ ও শিক্ষার অনুসরণ করে মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী মর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিলো, সেই গৌরবময় ঐতিহ্য ও সভ্যতার সর্ম্পক ছিন্ন করায় মুসলমানরা আজ ঘরে বাইরে দেশে বিদেশে সর্বত্র নির্যাতিত, নিস্পেষিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত বিশ্বের সর্বত্র তারা আজ উপেক্ষিত ও পদদলিত। নবীজির অনুসৃত পথ বিসর্জন দেয়ার কারনেই মুসলমানদের দুরাবস্থার প্রধান কারণ।

আশুরা দিবসে সংঘটিত ঘটনাবলী:

আশুরা দিবসে মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেন। এ দিবসে আসমান, জমিন, লওহ, কলম সৃষ্টি করেন। আশুরা দিবসে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়। এ দিনে আমাদের মাতা হযরত হাওয়া (🙂 কে সৃষ্টি করা হয়। আশুরা দিবসে আদম ও হাওয়া (🙂 আরাফাতের ময়দানে পরস্পর সাক্ষাত হয়। এ দিনে আদম (:)’র দুআ ও তাওবা আল্লাহ কবুল করেন। আশুরা দিবসে আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে প্রথম রহমত বর্ষণ করেন। এ দিনে ফিরিস্তাদের সর্দার ও অসংখ্য ফিরিস্তারাজিকে সৃষ্টি করা হয়। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম’র যুগে এ দিবসে মহাপ্লাবন সৃষ্টি হয়। এ দিবসে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কিস্তি জুদী পাহাড়ে নোঙ্গর করে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আশুরা দিবসে পৃথিবীতে শুভাগমন করেন। আশুরা দিবসে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নমরূদের জলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। এ দিবসে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেন। এ দিবসে তিনি আসমানী কিতাব তাওরাত শরীফ লাভ করেন। এ দিবসে আল্লাহর কুদরতে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নীল সমুদ্র অতিক্রম করেন এবং কুখ্যাত ফেরাউন পরিবারবর্গসহ নীল সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। এ দিবসে হযরত দাউদ (.)’র দুআ কবুল হয়। আশুরা দিবসে আল্লাহ তা’আলা হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালামকে হারানো রাজত্ব পূনরায় ফিরিয়ে দেন। এ দিবসে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম কুপ থেকে পরিত্রাণ পান। এ দিবসে আল্লাহর নবী হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম আসমানে আরোহন করেন। হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম এ দিবসে মাছের পেট থেকে পরিত্রান লাভ করেন। হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম দীর্ঘ ১৮ বৎসর পর জটিল কঠিন রোগ থেকে শিফা লাভ করেন। এ দিনে আল্লাহর নবী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পিতা ছাড়া জন্ম গ্রহণ করেন, ও আল্লাহর কুদরত প্রমাণ করেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এ দিনে আসমানে আরোহন করেন। এ দিবসে নবীজির প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র তাজেদারে কারবালা জান্নাতের যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বপরিবারে ৬১ হিজরির ১০ মহররম ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে শাহাদাতের সুধা পান করেন। আশুরা দিবসে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হবে পৃথিবী ধ্বংস হবে কিয়ামত সংঘটিত হবে।

(সূত্র: গুনীয়াতুল তালেবীন, পৃ: ৪২৯, কৃত: হযরত আবদুল কাদের জিলানী (.), মা ছাবাতা বিসমুন্নাহ, পৃ: ২২,২২ কৃত হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (.), নুজহাতুল মাজালিস, পৃ: ১৮১ কৃত: হযরত আবদুর রহমান সফুরী (), আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ২৪১ কৃত: হযরত আনোয়ার আহমদ কাদেরী)

সম্মানিত প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা:

হে মুমীনগণ, আপনারা এ বরকতময় মাসে সাধ্যনুযায়ী শরীয়ত সম্মত পুণ্যময় আমল করুন। কুফর, শির্ক, বিদয়াত, মিথ্যাচার, গীবত, চোগলখুরী এবং সকল প্রকার মন্দ অপকর্ম থেকে বিরত থাকুন। রাফেজী ও শিয়া সম্প্রদায়ের মতো নবীজির পরিবার বর্গের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অপমানমূলক কথাবার্তা ও আমল করা থেকে বিরত থাকুন। আল্লাহকে ভালবাসুন। তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করুন। আহলে বায়াত রসুলের প্রতি ভালবাসা অন্তরে ধারণ করুন। কেননা নবীজির পরিবারবর্গের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করা ঈমানের আলামত। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু যর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি পবিত্র কাবা ঘরের দরজা ধরে বলেন, আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তোমাদের মধ্যে আমার আহলে বায়তের দৃষ্টান্ত হচ্ছে হযরত নুহ আলাইহিস সালাম এর কিস্তির ন্যায়, যে এতে আরোহন করেছে সে মুক্তি পেয়েছে, যে এটা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে ধ্বংস হয়েছে। (মিশকাত শরীফ)

আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের অপনাদের সকলকে কুরআনুল করীমের বরকত রহমত হেদায়াত ও নুর দান করুন। আমি বিতাড়িত শয়তানের প্রতারণা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। নিশ্চয় মাসগুলোর সংখ্যা আল্লাহ তা’য়ালার নিকট বার মাস, আল্লাহর কিতাবের মধ্যে যখন থেকে তিনি আসমান ও জমীন সৃষ্টি করেছেন তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই চিরস্থায়ী দ্বীন। সুতরাং এ মাসগুলোতে (পাপাচার দ্বারা) নিজেদের আত্মার উপর অত্যাচার করো না। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৬)

আল্লাহ আমাদের আপনাদেরকে কুরআনুল করীমের কল্যাণ ও জ্ঞানগর্ভ নসীহত দ্বারা উপকৃত করুন। তিনি মহান দানশীল, রাজাধিরাজ, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফজল-এ-খোদা: কবি ও গীতিকার
পরবর্তী নিবন্ধসৈয়দ খালেদুল আনোয়ারের অনবদ্য কিশোর কাব্যগ্রন্থ ‘মনের ছবি’