জুম্’আর খুতবা

কুরআন ও হাদীসের আলোকে হজ্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৬ মে, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

হজ্ব শব্দের আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ: হজ্ব শব্দের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, সাক্ষাৎ করা। শরয়ী অর্থ: বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী আল হানাফী (মৃ. ৮৫৫ হি.)’র বর্ণনা মতে বিশেষ কতিপয় কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে সম্মান জ্ঞাপনার্থে পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সংকল্প করাকে হজ্ব বলে। আল্লামা ইবন হাজর আসকালানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, বিশেষ কিছু আমল সম্পাদনসহ পবিত্র কা’বা গৃহের উদ্দেশ্যে গমন করার সংকল্প করাকে হজ্ব বলে।

আল কুরআনের আলোকে পৃথিবীর সর্বপ্রথম গৃহ: ভূপৃষ্টে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ব প্রথম গৃহ কা’বা শরীফ, মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতো বক্কায় (মক্কায়) যা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। (সূরা: আল ইমরান, :৯৬)

বর্ণিত আয়াতে মক্কাকে বক্কা বলা হয়েছে, আরবি বর্ণ “মীম” এর পরিবর্তে “বা” উল্লেখ হয়েছে বক্কা অর্থ পরাভূত করা, পরাক্রমশালী ব্যক্তিও এখানে বসে মাথানত করে থাকে এ কারনে বক্কা বলা হয়, অথবা এখানে জালিম অত্যাচারীদের ঘাড় নত হয়। এখানে কোনো প্রকার উৎপীড়ন করার সুযোগ নেই। উৎপীড়ন হতে পারেনা বলেই একে বক্কা বলা হয়। সৌদি আরবের বিখ্যাত প্রসিদ্ধ পবিত্র বরকতময় নগরী মক্কা শরীফ, এখানে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরীফ নির্মিত। এ শহরেই নূরনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্মস্থান। এখানে থেকেই তিনি সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মের প্রচার সূচনা করেন। এই কাবাঘর পৃথিবীর মুসলমানদের কিবলা। প্রতি বছর বিশ্বের পবিত্র হজ্বব্রত পালন উপলক্ষে বিশ্বের ত্রিশ/চল্লিশ লক্ষ মুসলমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে পবিত্র মক্কায় সমবেত হন। এ পবিত্র ঘর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঈমানী চেতনার বাতিঘর। ঐক্যের ঠিকানা, মানবজাতির নিরাপত্তার ঠিকানা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, সেই সময়কে স্মরণ করুন, যখন কা’বা গৃহকে মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম। (সূরা, বাকারা, :১২৫)

মক্কা নগরীতে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ: পবিত্র মক্কা নগরী মুসলমানদের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ পবিত্র নগরী। কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনার আলোকে এ নগরীর শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব প্রমানিত। এর পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ। এ পবিত্র মক্কা নগরীতে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ। খোদায়ী নির্দেশনা অমান্য করার অধিকার কারো নেই। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগন! মুশরিকরা তো অপবিত্র তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটে না আসে। (সূরা, তাওবা, :২৮)

আদম (.) কর্তৃক সর্বপ্রথম খানায়ে কা’বা নির্মাণ: মহান আল্লাহর নির্দেশে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণের পর আমাদের আদি পিতা হযরত সায়্যিদুনা আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর জন্য জমীনে একটি ঘর নির্মাণের জন্য আল্লাহর দরবারে আবেদন করলেন। আবেদন মনজুর হলো, হযরত জিবরাইল (.) আল্লাহর নির্দেশে যমীনে অবতরণ করে কাবাগৃহের স্থান ও নকশা অংকন করে দেন, হযরত আদম (.) সেই নকশা অনুসারেই পবিত্র ক্বাবা ঘর নির্মানের কাজ সম্পন্ন করেন, এক বর্ণনা মতে সর্বপ্রথম ফিরিস্তাগণ, আসমানের “বাইয়তুল মা’মুর” এর বিপরীত দিকে হুবহু কা’বা শরীফ নির্মাণ করেছেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম’র সৃষ্টির দুই হাজার বছর পূর্ব থেকে ফিরিস্তারা এর হজ্ব করে এসেছেন। তার পর হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে আরম্ভ করে আমাদের মহান নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক সম্মানিত নবী রাসূলগন কা’বা শরীফের হজ্ব করেছেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম হিন্দুস্থানের (সিংহল) থেকে পদব্রজে চল্লিশবার হজ্বে গমন করেছেন। কোনো উম্মতের উপর তখন হজ্ব ফরজ ছিলনা। হিজরি পঞ্চম, ষষ্ঠ অথবা নবম হিজরি সনে মুসলমানদের উপর হজ্ব ফরজ করা হয়েছিল। (হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) মিরআত শরহে মিশকাত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৯৬)

হযরত ইবরাহীম (.) কর্তৃক খানায়ে কা’বা পুনঃনির্মাণ: কালক্রমে খানায়ে কা’বা সংস্কারযোগ্য হলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উপর এ ঘরের পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (.) কে সাথে নিয়ে পুনঃ নির্মাণের কাজ সমাধা করলেন অতঃপর মহান আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব বাসীর নিকট কা’বা কেন্দ্রিক হজ্বের ঘোষনা প্রচার করার জন্য নির্দেশ করলেন। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, এবং মানুষের নিকট হজ্ব সম্পাদনের ঘোষনা শুনিয়ে দাও: তাহলে তারা তোমার নিকট ছুটে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্টের পিঠে করে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা: হজ্ব, ২২:২৭)

আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে হযরত ইবরাহীম (.) আরজ করলেন, ইয়া আল্লাহ! গোটা বিশ্বময় তোমার বান্দারা বিস্তৃত। তোমার এ ঘোষনা আমি পৃথিবীর সব মানুষের নিকট কিভাবে পৌছাবো? মহান আল্লাহ বলেন, তোমার কাজ হল আমার ঘোষনার বাণী উচ্চারণ করা, আর ঘোষষা সকলের কানে পৌছানো হল আমার কাজ। হযরত ইবরাহীম (.) একটি উচুঁস্থানে আরোহন করে ঘোষনা দেন, মহান আল্লাহ জাল্লা শানুহু সেই ঘোষণা আসমান যমীন পাহাড় পর্বত জলস্থল অন্তরীক্ষ মরুবিয়াযান সর্বত্র এ ঘোষণা পৌছিয়ে দেন, তিনি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম দিকে ফিরে ঘোষণা দেন, হে মানব মন্ডলী! বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্ব তোমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে, কাজেই তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দাও। হযরত ইবরাহীম (.)’র আহবানের ধ্বনি সর্বত্র গুঞ্জরিত হলো, এমনকি পিতৃঔরশ ও মাতৃগর্ভের শিশুও সে ধ্বনি শুনতে পেল, সেদিন যে মানুষ এ আহবান শুনে লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছিল তারা বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্বের সৌভাগ্য অর্জন করবে। (তারিখে মক্কা, তাফসীরে রুহুল বয়ান, আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ২৯৩)

সামর্থ্যবানদের উপর জীবনে একবার হজ্ব ফরজ: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্ব করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। (:৯৭)

আল্লামা ইবন কাইয়্যুম (.) এর বর্ণনা মতে বর্ণিত আয়াতে করীমা নাযিলের মাধ্যমে হজ্ব ফরজ করা হয়। হজ্ব কোন সনে ফরজ হয় এ নিয়ে তাফসীরকারদের মতভেদ রয়েছে, কারো মতে ষষ্ঠ হিজরিতে, কারো মতে সপ্তম হিজরিতে কারো মতে অষ্টম হিজরিতে, প্রসিদ্ধ মতে নবম হিজরিতে হজ্ব ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নির্দেশে নবম হিজরিতে হজ্ব পালন করেছেন। দশম হিজরিতে বিদায় হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়। রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করার পূর্বেও দু’বার কিংবা তিনবার হজ্ব পালন করেছিলেন। (তিরমিযী ও ইবনে মাযাহ)

হাদীস শরীফের আলোকে জীবনে একবার হজ্ব ফরজ হওয়ার তাৎপর্য: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, নবীজি এরশাদ করলেন হে মানব মন্ডলী! তোমাদের উপর হজ্ব ফরজ করা হয়েছে, সুতরাং তোমরা হজ্ব করো, তখন এক ব্যক্তি, জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকি প্রত্যেক বছর? নবীজি চুপ রইলেন এ পর্যন্ত যে লোকটি তা তিনবার জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি এরশাদ করলেন, যদি আমি হ্যাঁ বলে দিতাম তাহলে প্রত্যেক বছর হজ্ব পালন করা ওয়াজিব হয়ে যেতো, এবং তোমরা তা পালন করতে পারতেনা। তারপর এরশাদ করলেন যে বিষয়ে আমি কিছু না বলি সেটাকে তোমরা আমাকে সেরূপই রাখতে দাও। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবীগণকে অধিক প্রশ্ন করা ও ঝগড়া করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে সুতরাং যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজ করার নির্দেশ দিই, তখন যতটুকু সম্ভব হয় তা পালন করে যাও, আর যখন কোন বিষয়ে তোমাদেরকে নিষেধ করবো তখন তা ত্যাগ করো (মুসলিম শরীফ)

হাদীসের মমার্থ: বর্ণিত হাদীস শরীফে শরীয়তের বিধানাবলীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র এর ইখতিয়ার বা কর্তৃত্ব প্রমানিত। নবীজি যদি প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলে দিতেন প্রতি বছর হজ্ব করা ফরজ হয়ে যেতো, নবীজি হ্যাঁ বা না বলার মধ্যে প্রভাব ও কার্যকারিতার যে প্রভাব ও তাৎপর্য করেছে তা নির্ভরযোগ্য দলীলের আলোকে প্রমানিত। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং যা কিছু তোমাদেরকে রাসূল দান করেন তা গ্রহণ করো, আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো। (সূরা: হাশর, )

মকবুল হজ্ব মানুষকে নিস্পাপ করে দেয়: হজ্ব করলে মানুষ পাপমুক্ত হয়। মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অন্যায়ের প্রতি ও মন্দ কাজের প্রতি অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। হজ্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব করল এবং স্ত্রী সম্ভোগ ও পাপাচার হতে বিরত রইলো, সে মাতৃগর্ভ হতে সদ্য প্রসূতের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করল। (বুখারী শরীফ)

হে আল্লাহ আমাদেরকে বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্ব ও যিয়ারত নসীব করুন। আমীন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদ রহমান: কিংবদন্তী সংগীত গুরু
পরবর্তী নিবন্ধআইনস্টাইনের দেশে