সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন। পবিত্র রমজানুল মুবারকের প্রতিটি মূহুর্তকে মূল্যবান মনে করুন। মাহে রমজানের শেষ জুমআকে জুমাতুল বিদা বলা হয়। জুমবারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তো, ইসলামে কুরআনে ও হাদীসের আলোকে স্বীকৃত ও ফযীলত মন্ডিত, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। রমজানের প্রতিটি জুমআর গুরুত্ব অন্যমাসের তুলনায় অনেক বেশি এটাও স্বীকৃত। উপরন্তু জুম্আতুল বিদা রমজান মাসের আখেরি জুমা হওয়ার কারণে এর গুরুত্ব মাহাত্ম আরো অনেক বেশি। জুমাতুল বিদার খুতবাতে খতীবের কন্ঠে রহমত, মাগাফিরাত ও নাজাতের মাসের বিদায় বার্তা ঘোষিত হয়। অশ্রুসিক্ত নয়নে করুণসূরে ধ্বনিত হয় “আল বিদা আল বিদা ইয়া শাহরা রমাদান”। পবিত্র রমজানের বিদায়লগ্নে প্রতিটি মুসলমানের ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায়ী অভিবাদন জানানো হয় “আস্সালামু আলাইকা ইয়া শাহরার রাহমাতি ওয়া গোফরান”। রহমত, বরকত ও কল্যাণের মাসের প্রতি প্রশান্ত হৃদয়ে সালাম ও অভিবাদন জ্ঞাপন করা হয়। আত্মশুদ্ধির মাস, নুযুলে কুরআনের মাস, সিয়াম সাধনার মাস, তারাবীহ ও কিয়ামুল লায়ল’র মাস, দান সাদকা যাকাত ফিতরার মাস, পবিত্র রমজানকে যারা উত্তমভাবে বরণ করেছে তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় রমজানকে বিদায় জানাতে পেরেছে তাদের জন্যই রয়েছে সফলতা, আল্লাহর দয়া, ক্ষমা ও সন্তুষ্টি।
আল কুরআনের আলোকে জুমআর দিবসের গুরুত্ব: মহান আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাযিল করেন যার নাম সূরা “জুম্’আহ” আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন অর্থ: হে মুমিনগণ! জুম্’আর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়। তখন তোমরা আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও, এবং ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝ। (সূরা: জুম্’ আহ, পারা: ২৮, আয়াত: ০৯)
নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে, জুম্’আর আযান হওয়া মাত্রই ক্রয় বিক্রয় হারাম হয়ে যায়। জুম’আর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
হাদীস শরীফের আলোকে জুমআর ফযীলত: জুম্’আর নামাযের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করা হলো: ১.হযরত আউস বিন আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় তোমাদের দিবসসমূহের মধ্যে থেকে জুম্’আর দিবসই সর্বোত্তম। সেদিন হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেদিন তিনি ওফাত হয়েছেন। সেদিনই সিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। সেদিনই বিকট শব্দ প্রকাশিত হবে। অতএব তোমরা আমার উপর সেদিন অধিকহারে দরুদ শরীফ পাঠ কর। কেননা তোমাদের দরুদ শরীফ আমার উপর পেশ করা হয়। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের দরুদ শরীফ আপনার উপর কিভাবে পেশ করা হবে? ওফাতের পর আপনার দেহ মোবারক কি মাটির সাথে মিশে যাবেনা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহ তা’য়ালা ভূপৃষ্ঠের জন্য সম্মানিত নবীগণের দেহ (শরীর মোবারক ভক্ষণ করা কিংবা কোনরুপ ক্ষতি সাধন করা) কে হারাম করে দিয়েছেন। (আবু দাউদ শরীফ)
জুম্’আর দিন মুসলমানদের সাপ্তাহিক ঈদ: এ দিবসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ দিবসকে নবীজি মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদ ঘোষনা করেছেন। এ দিবসে গোসলের তাকিদ দিয়েছেন। এরশাদ করেছেন “ ওহে মুসলিম সমাবেশ, এটা এমন এক মহান দিন যাকে আল্লাহ তায়ালা ঈদ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ দিবসে গোসল করবে। এ দিবসে সুগন্ধি ব্যবহারে ক্ষতি নেই। তোমরা নিশ্চয় মিসওয়াক করবে (ইবনে মাযাহ শরীফ)
জুম্’আর দিবস ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার চেয়েও শ্রেষ্ঠ : হযরত আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জুম্’আর দিন হলো দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠদিন, আল্লাহ পাকের নিকট মহা সম্মানিত দিন। এমনকি আল্লাহর নিকট ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (ইবনে মাযাহ শরীফ)
জুম্’আর দিবসে দরুদ শরীফ পাঠের ফজিলত: এ দিবসে নবীজির উপর অধিকহারে দরুদ শরীফ পাঠ করা বরকতময় আমল হিসেবে গণ্য হবে। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর এমন কিছু ফেরেস্তা রয়েছে যারা নূরের সৃষ্টি। এরা জুমার দিবস ও রজনী ব্যতীত জমীনে অবতরণ করেন না। তাঁদের হাতে স্বর্ণের কলম রৌপ্যের কালি ও নূরের কাগজ থাকে। এ গুলো দ্বারা কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর পঠিত দরুদ শরীফ লিখা হয়। (সাআদাতুদ দারাইন)
জুম্’আর দিবসের আমল এক বছরের আমলের সমান: এ দিবসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, মুসলমানরা এ দিবসে সুগন্ধি ব্যবহার করবে। পবিত্র পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করবে। সকাল সকাল মসজিদে রওয়ানা হবে, ইমামের আগমন পর্যন্ত নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর–আযকার ও দরুদ শরীফে নিয়োজিত থাকবে। ইমামের নিকটবর্তী হয়ে কাতারে অগ্রবর্তি হবে।
হযরত আউস ইবনে আউস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জুম্’আর দিবসে গোসল করবে। এবং কাপড় চোপড় ধৌত করবে, সকাল সকাল প্রস্তুতি গ্রহণ করত: প্রথম ওয়াক্তে মসজিদে উপস্থিত হবে। কোন বাহনে আরোহন না করে পদব্রজে রওয়ানা হবে। মসজিদে ইমামের সন্নিকটে বসবে মনোযোগে খুতবা শ্রবণ করবে কোন অনর্থক কথা বলবেনা, বা বাজে কাজ করবেনা। তার প্রত্যেক কদমে এক বছরের নফল রোজা ও নফল নামাযের সওয়াব হবে। (তিরমিযী শরীফ)
জুম্’আহ পরিত্যাগের পরিণতি : এক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলল, অমুক ব্যক্তি মারা গেছে, সে জুম্’আ ও জামাতে উপস্থিত হতো না, এখন তার অবস্থা কি হবে? হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, সে দোজখী। এভাবে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)’র অন্য হাদীসে এরশাদ হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বিনা ওজরে যদি কোন ব্যক্তি জুম্’আ পরিত্যাগ করে মুনাফিকরূপে এমন দপ্তরে তার নাম লিপিবদ্ধ হবে যা কখনো রহিত হবে না ও পরিবর্তন হবে না, (ইবনে মাযাহ শরীফ)
জুম্,আর দিবসে কবর যিয়ারতের ফজিলত: কবর যিয়ারত করা সুন্নাত, পুণ্যময় আমল। এতে অন্তরে আল্লাহর ভয় ও মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। জুমাবার দিবসে সম্মানিত নবীগণের রওজা শরীফ যিয়ারত, সাহাবায়ে কেরাম, মুজতাহিদ, ইমাম, আউলিয়ায়ে কেরাম, পিতা–মাতা ও নিকটাত্বীয়–স্বজনের কবর যিয়ারত করা সুন্নাত।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার পিতা–মাতা উভয়ের বা একজনের জুমাবার দিবসে যিয়ারত করবে এবং তাদের কবরের নিকট সূরা ফাতেহা পাঠ করবে তাদের ক্ষমা করা হবে। (ইমাম আদি– আল কামিল, পৃ: ৫/১৫১, হাদীস নং: ১৩৬০)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক জুমাবার তার পিতা–মাতা উভয়ের বা একজনের কবর যিয়ারত করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। তার নাম নেককার রূপে লিপিবদ্ধ করবেন।
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! জুম্’আর দিবসের পবিত্রতা রক্ষা করুন। সকল প্রকার অনৈসলামিক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকুন। এ দিবসের বরকত ও কল্যাণ অর্জন করুন, আল্লাহ আমাদের আপনাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন, পবিত্র কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন, আমি বিতাড়িত শয়তানের অনিষ্টতা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জুমাতুল বিদার ফযিলত নসীব করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ কায়কোবাদ
কলসী দিঘির পাড়, বন্দর, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: পবিত্র শবে কদর রমজানের সাতাশতম রজনীতে হওয়া প্রসঙ্গে আল কুরআন কি ইঙ্গিত রয়েছে? জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ! প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শবে কদর সাতাশতম রজনীতে হওয়ার পক্ষে তিনটি দলীল পেশ করেছেন। ১. সূরা কদরের “লায়লাতুল কদর” শব্দটিতে নয়টি অক্ষর আছে, সূরা কদরে তা তিনবার উল্লেখ হয়েছে যার গুণফল দাঁড়ায় সাতাশ। ২. সূরা কদরে শব্দ সংখ্যা ত্রিশ তন্মধ্যে “হিয়া” শব্দটি সাতাশতম। ৩. উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা লায়লাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রজনী সমূহে তালাশ কর। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ১৯১৩, বিস্তারিত রয়েছে গুণীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ২৮৭,২৮৮)