জুম্‌’আর খুতবা

শা’বান মাসের তাৎপর্য ও শবে বরাতের ফযিলত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আল কুরআনের আলোকে ইসলামে মাস বারটি:

মূহূর্ত, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, রাত, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস ও বৎসর আল্লাহর সৃষ্টি। মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগী, দিন, মাস, ও বৎসরের সাথে সম্পর্কিত যা কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ভাবধারায় পালিত হয়। দৈনন্দিন পঞ্জেগানা ফরজ নামায তো প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরজ। আল্লাহ তা’আলা পাপী তাপী বান্দাদের গুনাহ মার্জনার জন্য ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি বান্দার জন্য সুন্নাত ও নফল ইবাদত করার সুযোগ রেখেছেন, সৌভাগ্যবান বান্দারাই ফরজ ওয়াজিব সুন্নাত নফল মুস্তাহাব প্রতিটি আমলের মাধ্যমে আল্লাহর দয়া অনুগ্রহ করুণা ও ক্ষমা লাভে সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলার বিধান ও গণনায় মাস বারটি। আসমান সমূহ ও জমীন সৃষ্টির দিন থেকে। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৪)

শা’বান মাসের তাৎপর্য: ইসলামী বর্ষের অষ্টম মাস শা’বান তাৎপর্যমন্ডিত ও বরকতময় মাস। শা’বান আরবি শব্দ। এতে পাঁচটি বর্ণ রয়েছে “শীন” দ্বারা শরাফত অর্থাৎ মর্যাদা, “আইন” দ্বারা উলুব্বুন অর্থাৎ উন্নতি, “বা” দ্বারা বিররুন অর্থাৎ সৎকর্ম “আলিফ” দ্বারা উলফাতুন অর্থাৎ ভালোবাসা, “নূন” দ্বারা নূর অর্থাৎ আলো, এর তাৎপর্য হলো এ মাসের নেক আমল দ্বারা আল্লাহ তা’আলা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি উন্নতি নেকী তথা উত্তম আমল ও সৎ কর্ম করার মাধ্যমে রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, আল্লাহর ভালোবাসা লাভের মাধ্যমে বান্দার অন্তরাত্মা নুরানি ও আলোকিত হয়। (গুণীয়াতুত ত্বালিবীন, খন্ড:১ম, পৃ: ২৪৬)

হাদীস শরীফের আলোকে শা’বানের তাৎপর্য: রহমতের নবী কল্যাণের মূর্ত প্রতীক, উম্মতের মুক্তিকামী প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব, শা’বান ও রমজান মাসের বরকত লাভের প্রত্যাশায় মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতেন, হে আল্লাহ, আমাদের জন্য রজব ও শা’বান মাসকে বরকতময় করুন। আর আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। (নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ) আল্লাহর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে আরো এরশাদ করেছেন, “রজব আল্লাহর মাস, শা’বান আমার মাস, আর রমজান আমার উম্মতের মাস। (মাসাবাতা বিস্‌সুন্নাহ)

শা’বান মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য মাসের চেয়ে শা’বান মাসে বেশি পরিমাণ রোজা রাখতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আপনাকে শা’বান মাসের চেয়ে অন্য কোন মাসে এতো বেশি নফল রোজা রাখতে দেখিনি। এর কারণ কি? রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাসটি সম্পর্কে মানুষ উদাসীন থাকে, এটি এমন একটি মাস যে মাসে বান্দার আমল সমূহ আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। আমি চাই রোজা অবস্থায় আমার আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হোক। (সুনানু নাসায়ী)

ইমামুল আম্বিয়া রাহমাতুল্লীল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে আরো এরশাদ করেছেন, শাবান মাসের ফযীলত অন্যান্য মাসের উপর এমন যেমন আমার শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সকল নবীদের উপর। (গুনীয়াতুত তালিবীন, পৃ: ৩৫)

আল কুরআনের আলোকে শবে বরাতের ফযীলত:

শবে বরতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, বরকতময় রজনী লায়লাতুল বারাতের ইবাদত ও নেক আমলের গুরুত্ব আয়াতে করীমা ও তাফসীরকারদের বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হামীম এর মমার্থ আল্লাহই ভালো জানেন, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রজনীতে এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা: দুখান, )

প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ একদল তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে “লায়লাতুল মুবারাকা” দ্বারা শাবানের পনের তারিখের রাতই উদ্দেশ্য। এ রজনীর ইবাদত ও নেক আমলের ফযীলত অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কোনো ঈমানদার এ রাতের আমল অস্বীকার করতে পারে না। হযরত ইকরামা (রা.)’র বর্ণনা মতে শা’বানের পনের তারিখের রাতে পরবর্তী বছরের ভাগ্য লিপি নির্ধারণ করা হয়। জীবিতদের মধ্যে যারা মৃত বরণ করবে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। যারা হজ্ব করবে তাদের নামও লিপিবদ্ধ করা হয়। এ ভাগ্য লিপি থেকে কোন কিছু কম বেশি করা হবেনা। (তাফসির ইবনে জরীর ১১/২২২)

বরকতময় রজনীতে কুরআন অবতীর্ণ হয়: হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, কুরআন অবতীর্ণ হওয়া প্রসঙ্গে সূরা কদরে সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি এটি শবে কদরে নাযিল করেছি, সূরা দুখানে এরশাদ হয়েছে, আমি বরকতময় রজনীতে কুরআন নাযিল করেছি এর দ্বারা শাবান’র পনের তারিখের রাত বুঝানো হলে দু’রাতেই কুরআন নাযিল হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উভয় আয়াতের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোন বৈপরিত্য নেই। দু’আয়াতের সমন্বয় হলো এভাবে যে, শাবানের পনের তারিখ রজনীতে “লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে কুরআন নাযিল শুরু হয়েছে। আর কুরআন অবতরণ শেষ হয়েছে শবে কদরে। একই ভাবে বান্দার রিযক ও ভাগ্য নির্ধারণ হয় বরাত রজনীতে। আর ভাগ্য লিপি ফিরিস্তাদের কাছে হস্তান্তর ক্ষমা করা শবে কদরে। আয়াত দ্বয় পরস্পর পরিপূরক। হাদীসের আলোকে শবে বরাতের ফযীলত: শবে বরাত হায়াত মওত ও রিযক নির্ধারণের রাত। এ রাতে আল্লাহ অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মহিমান্বিত আল্লাহ মধ্য শাবানের রজনীতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন (তাঁর শান অনুযায়ী)। অতঃপর “কালাব” গোত্রের মেষ পালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিযী, খন্ড:, হাদীস: ৭৭৬)

আল্লাহ তা’আলা মুশরিক ও বিদ্বেষকারীকে ক্ষমা করেন না: শির্ক মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় অনুগ্রহে বান্দার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। শির্ক কখনো ক্ষমা করেন না। এরশাদ হয়েছে, হযরত মুআয ইবনে জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, মুশরিক ও বিদ্বেষকারী ব্যাতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান ২০/১৮৯)

পাঁচ রজনীর দুআ ফেরত হয়না: পাঁচ রাতের দুআ ফেরত হয় না। রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, জু’ম আর রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত। (আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড:২য়)

শবে বরাতে হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয’র ইবাদত: মুজতাহিদ ইমাম ও প্রখ্যাত বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক শবে বরাতে ইবাদত বন্দেগী করা প্রসঙ্গে নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদি রয়েছে। হযরত সৈয়্যদুনা ওমর বিন আবদুল আযীয শা’বানের পনের তারিখ রজনীতে ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন। সিজদা হতে মস্তক উত্তোলন করে একখানা সবুজপত্র পেলেন, যে পত্রের আলো আসমান পর্যন্ত প্রসারিত ছিলো। পত্রে লিখা ছিল, মালিক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে, এটা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিনামা। যা তাঁর বান্দা ওমর বিন আবদুল আযীযকে প্রদান করা হলো। (তাফসীর রুহুল বায়ান, খন্ড: , পৃ: ৪০২)

শবে বরাতে হযরত দাউদ (.) এর দুআ: আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (.) এ পূণ্যময় রজনীতে এ দুআ করেছেন, হে আল্লাহ! ওহে দাউদ আলাইহিস সালাম’র প্রতিপালক! যে ব্যক্তি এ রজনীতে তোমার নিকট দুআ করে অথবা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁকে ক্ষমা করে দাও। (মাসাবাতা বিসসুন্নাহ, পৃ: ৩৫৪)

শবে বরাতের আমলসমূহ: রাত জেগে নফল ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা পালন করা, দরুদ শরীফ পাঠ করা, এ রাতে ফযীলত সংক্রান্ত কুরআন হাদীস ভিত্তিক দালিলিক আলোচনা করা, সালাতুত তাসবীহ আদায় করা, আউলিয়ায়ে কেরাম পিতামাতা ও মুরব্বীদের কবর যিয়ারত করা, গরীব মিসকীন অসহায় মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করা মিলাদ শরীফ পাঠ করা ইত্যাদি এ রাতের পুণ্যময় আমল। উম্মুল মুমোনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এরশাদ করেছেন, আমি এ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জান্নাতুল বাকী কবর স্থানে পেয়েছি, তিনি মু’মিন নরনারী ও শহীদদের ক্ষমা জন্য প্রার্থনা করছেন। (বায়হাকী শরীফ)

বরকময় রাত সমূহ যেমন শবে বরাতে কবর যিয়ারত করা মুস্তাহাব। (ফতোওয়ায়ে আলমগীরি)

শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকুন: ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে এ রাতের প্রতি সম্মান করুন। এ রাতে দলবেঁধে মধ্যরাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরাঘুরি করা, আড্ডাবাজি করা, আতশবাজি করা, ফটকা বাজি করা, অহেতুক মোমবাতি জালিয়ে অর্থের অপচয় করা গুনাহের কাজ। যাবতীয় শরীয়ত বিরোধী অনৈসলামিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন।

হে আল্লাহ! এ বরকতময় রজনীতে আমাদেরকে রহমত বরকত দান করুন। আপনার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

 

মুহাম্মদ আবদুর রহমান

ফয়েজলেক, খুলশী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: শবে বরাতের নামাযের ফযীলত সম্পর্কে সংক্ষেপে জানালে কৃতার্থ হব

উত্তর: বরকতময় রজনী শবে বরাত। এ রােেতর আমল অসংখ্য হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন। তোমরা বরাতের রাত জেগে ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রাখো। (ইবনে মাযাহ, পৃ: ৯৯)

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাগরীবের নামাযের পর ছয় রাকাত নামায আদায় করবে তার জীবনের সবগুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমান হয়। (তাবরানী, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড:, পৃ: ৫২৫)

হযরত মুয়ায ইবনে জবল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি পাঁচ রজনীতে রাত জাগরণ করে ইবাদত করবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তম্মধ্যে একটি রজনী শবে বরাত। (আততারগীব ওয়াত তারহীব, খন্ড:, পৃ: ১০৫)

বড় পীর শাহেন শাহে বাগদাদ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা.) বলেন, শবে বরাতের রজনীতে রুকুকারীদের জন্য সুসংবাদ ও রহমত রয়েছে। এ রজনীতে সিজদাকারীদের জন্য কল্যাণ ও সৌভাগ্য রয়েছে। (গুনীয়াতুত তালেবীন, খন্ড:, পৃ: ১৬৯, আনায়ারুল বায়ান, খন্ড:, পৃ: ৫২৫)

আল্লাহ তা’য়ালা এ মুবারক রজনীতে আমাদের অধিক পরিমাণ নেক আমল করার তাওফিক দান করুন, আমীন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশবে বরাত : তাৎপর্যমণ্ডিত রাত
পরবর্তী নিবন্ধসংশোধনী