ইসলামে মযহাব অনুসরণের নির্দেশনা ও ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!
ইসলামী ফিক্হ শাস্ত্রের জনক মুজতাহিদ ইমামগণের শিরোমণি, হযরত সাইয়্যেদুনা ইমাম আয’ম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তা’আলার কুদরতের এক মহানিদর্শন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী জ্ঞান বিজ্ঞানের অতলান্ত বিস্তৃত মহাসমুদ্রের বরকতময় ইসলামের অনন্য আমানতদার ছিলেন হযরত ইমাম আ’যম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। যুগের শ্রেষ্ঠতম মুজতাহিদ ইমামগণ হাদীস বিশারদ তাফসীরকার ওলী গউস কুতুব আবদাল উচুঁ স্তরের আলিমে বাআমল, জ্ঞানের ধারক বাহকরা হযরত আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র আলোচনা ইমাম আ’যম শিরোনাম দিয়ে শুরু করে তাঁর খোদা প্রদত্ত অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও অনন্য প্রতিভা ও তাঁর দ্বীনি খিদমতের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইমাম ইবরাহীম ইবনে মুয়াবিয়া (রহ.) ইমাম আযমের প্রতি মহব্বত প্রদর্শনকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দলভূক্ত হওয়ার নিদর্শন সাব্যস্ত করেছেন। তিনি অসংখ্য জ্যৈষ্ট ও শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীর সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং তাঁদের থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন। ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) তাঁকে “ইমামুল মুহাদ্দিসীন” অভিধায় ভূষিত করেছেন। তিনি কুরআন হাদীস গবেষণা বিচার বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণ করে লক্ষ লক্ষ শরয়ী মাসয়ালার সমাধান বের করেছেন।
আল কুরআনের আলোকে মুজতাহিদ ইমামদের মর্যাদা: মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীমের অসংখ্য আয়াত দ্বারা মাযহাব অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায়। “হে ঈমানদারগণ নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো রসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।” (তরজুমা কুরআন কানযুল ঈমান, সূরা নিসা, আয়াত ৫৯)
উল্লিখিত আয়াতে “উলীল আমরে মিনকুম” দ্বারা শরিয়তের হক্কানী আলেমেদ্বীন মুর্শিদে কামিল, মুজতাহিদ ইমাম, ইসলামী সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান) এবং ইসলামী বিচারকগণ এর আনুগত্য করা ওয়াজিব। এ আয়াত থেকে তাকলিদ তথা মাযহাবের ইমামের অনুসরণ অপরিহার্য। (মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী, তাফসীরে নুরুল ইরফান, সূরা নিসা, আয়াত:৫৯, পৃ: ২২৮) আয়াতে বর্ণিত “সিরাতাল মুস্তাকিম” দ্বারা ইসলাম কুরআন মজীদ, প্রিয়নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শ, আহলে বায়তে রসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তবে তাবেঈ, সালেহীন, আউলিয়ায়ে কামেলীন, মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত পথ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বৃহত্তম জামাআতকে বুঝানো হয়েছে। সোজা পথ বলতে সকল মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকীহ্, গাউস কুতুব, আবদাল ও অলী আল্লাহর অনুসৃত পথকে বুঝানো হয়েছে। তাঁরা সকলেই ছিলেন, মুকাল্লিদ তথা মাযহাবের অনুসারী, মাযহাব মান্য করা এ আয়াতের নির্দেশ মান্য করার নামান্তর। কুরআনুল করীমের নিম্নোক্ত আয়াতেও মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলিদ তথা অনুসরণের ইঙ্গিত রয়েছে। সমস্যা সমাধানে তাঁদের পথ নির্দেশ উম্মতের জন্য দিশারীর ভূমিকা পালন করবে। এরশাদ হয়েছে, “যখন তাঁদের কাছে আসে কোন নিরাপত্তার বিষয় অথবা কোন ভয়ভীতির বিষয় তখন তাঁরা তা প্রচার করে। যদি তাঁরা তা রাসূল ও তাঁদের মধ্যকার নেতৃস্থানীয় আলিম (ওলীল আমর) দের নিকট উপস্থিত করত তবে নিশ্চয় তাঁদের নিকট থেকে সেটার বাস্তবতা জানতে পারতো। (আল কুরআন, সূরা নিসা, আয়াত: ৮৩)
হাদীসের আলোকে মযহাব অনুসরণ: তাকলিদ তথা মাযহাব অনুসরণের সমর্থনে অসংখ্য সহীহ হাদীস রয়েছে। কয়েকটি হাদীস প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করছি। বিশ্বাসীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, অভিশপ্তদের জন্য দলিল প্রমাণের বিশাল স্তূপ কোন কাজে আসবেনা। “হযরত হুজায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি জানিনা আর কতদিন তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকবো, তবে আমার পর তোমরা আবু বকর ও ওমর এর অনুসরণ করে যাবে। (তিরমিযী: আস সুনান, বাবু ফী মানাক্বিবি আবী বকর, ৬:৪৫, হাদিস: ৩৬৬৩)
তাকলিদের বৈধতার সপক্ষে বর্ণিত হাদীস নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য দলিল। “হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর পূরনুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের লক্ষ্য করে এরশাদ করেন, মানুষ তোমাদের অনুগামী হবে। তারা ভূপৃষ্ঠের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তোমাদের নিকট দ্বীনি ফিকহ অর্জন করতে আসবে। যখন তারা তোমাদের কাছে আসবে তোমরা তাঁদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। (ইবনে মাজাহ, আস সুনান, বাবুল ওয়াসাতি বি তলবাতিল ইলমি, ১:৯১, হাদিস: ২৪৯, তাবরানী, হাদিস: ৪০০, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ খতীব তিবরিযী, মিশকাত শরীফ, পৃ: ৩৪)
ইমাম আ’যম’র সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম: ইমাম আযম আবু হানিফা নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যাওতী’র জন্ম সম্পর্কে তাঁর পৌত্র হযরত ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ (ওফাত ২১২হি.) বর্ণণা করেন, আমার দাদা হিজরি ৮০ সনে জন্ম গ্রহণ করেন। (আবু বকর আহমদ ইবনে আলী ইবনে সাবিত আল খতীব বাগদাদী (৩৯২–৪৬৩ হি., তারিখে বাগদাদ, খন্ড:১৩, পৃ:৩২৬)
ইমাম ইবনে হাজর হায়তমী মক্কী (৯৭৩হি.) এর মতে, অধিকাংশ ইমামের (সর্বসম্মত) মতানুসারে, ইমাম আবু হানিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের খেলাফতকালে ৮০ হিজরি কুফায় জন্ম গ্রহণ করেন। (ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইমামুল আইম্মা ফিল হাদীস, পৃ: ৫০)
ইমাম আযামের প্রকৃত নাম নুমান, কুনিয়াত বা উপনাম আবু হানিফা, পিতার নাম সাবিত, দাদার নাম যাওতী, তিনি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী, দাদা অগ্নি উপাসক ছিলেন, ৩৬ হিজরীতে ইসলামে দীক্ষিত হন, দাদা যাওতী স্ত্রীকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হন সেখান থেকে কুফায় পৌঁছে হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র সান্নিধ্য অর্জন করেন। তিনি কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ৪০ হিজরিতে যাওতীর এক পুত্র সন্তান জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হলো সাবিত। দুআ’ ও বরকত নেয়ার জন্য পুত্রকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র দরবারে নেয়া হলে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। সাবিত এর শিশু অবস্থায় পিতা ইন্তেকাল করেন। মায়ের স্নেহে লালিত পালিত হন। তাঁর ৪০ বছর বয়সে পরিবারে এক নূরানী সন্তান জন্ম লাভ করেন। পিতা–মাতা স্নেহ করে নাম রাখেন নোমান। তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ইমাম, হযরত ইমাম আবু হানিফা। যিনি ইমামুল মুহাদ্দিসীন উস্তাযুল আসাতিযা, যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফক্বীহ, মুনাযির মুতাকাল্লিম, সর্বোপরি বিশ্বখ্যাত মুজতাহিদ প্রখ্যাত সাধক ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত। হযরত ইমাম আযম ছিলেন একজন তাবিঈ। মুহাদ্দিসিনে কেরাম তাবেঈ’র সংজ্ঞায় বলেন, “তাবেঈ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় সাহাবীর সাথে যার সাক্ষাৎ হয়েছে। ইমাম আযমকে ইবনে সাদ তাবেঈদের পঞ্চম স্তরের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু (ওফাত ৯৩ হি.) কে দেখেছেন। প্রসঙ্গে ইমাম আযম বলেন, আমি হযরত আনাস ইবনে মালিককে নামায পড়তে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখেছি। (আবু নঈম ইসবাহানী, মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, পৃ: ১৭৬)
ইমাম আযমের উস্তাদদের তালিকায় সাতজন সাহাবী এবং তিরানব্বই জন প্রসিদ্ধ তাবেঈ রয়েছে। তবে ফিক্বহ শাস্ত্রে তাঁর প্রধান ওস্তাদ হলেন হযরত হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান (ওফাত ১২০ হি. ৭৩৭ খ্রি.) (ইসলামী বিশ্বকোষ: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খন্ড: ২য়, পৃ: ৩৫৯)
ওস্তাদ হাম্মাদের মৃত্যুর পর ইমাম আযম ফিক্বহ শাস্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করেন। শাফেয়ী মযহাব অনুসারী ইমাম হাফেজ জালালুদ্দিন সুয়ুতী এ অভিমত ব্যক্ত করেন, নিশ্চয়ই ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সর্বপ্রথম শরিয়তের বিভিন্ন বিধানাবলী (আহকামে শরিয়ত মাসআলা মাসায়েল) সংকলন করেন। বিভিন্ন অধ্যায় ভিত্তিক বিন্যাস করেন। অতঃপর ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু মুয়াত্তার বিন্যাসে ইমাম আযমের অনুসরণ করেন। (ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (র.), তাবয়ীদুস সহীফা, পৃ: ১১৯)
আল্লামা ইবনে কাসীর প্রণীত আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ভাষ্যমতে, ইমাম আযম একাধারে চল্লিশ বছর এশার অযু দিয়ে ফজর নামায পড়েন। তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ্ব ব্রত পালন করেন। তার নিকট তাকওয়া ইবাদত বন্দেগী, তিলাওয়াত, মুরাকাবা–মুশাহাদা, সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যয়পরায়ণতা সত্যের উপর অবিচল দৃঢ়তা, ঈমান আক্বিদার প্রশ্নে আপোষহীন ভূমিকা মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর গভীর গবেষণা, সাধনা ও প্রচেষ্টার বদৌলতে ইসলামী ফিক্বহশাস্ত্র পূর্ণতা লাভ করে। কুরআন–হাদীস, তাফসীর ফিক্বহ আকাঈদ, ফালসাফা ইলমে তাসাউফসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা পান্ডিত্য ধীশক্তি সকল মজতাহিদ ইমামদের মধ্যে শীর্ষে অধিষ্ঠিত করেছে। সুদীর্ঘ ২২ বছর মতান্তরে ৩০ বছর সাধনার পর ১৪৪ হিজরি তথা ৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে এ মহান ইমামের তত্ত্বাবধানে ফিক্বাহ শাস্ত্র রচনা ও সম্পাদনার কাজ সমাপ্ত হয়। যা “কুতুবে আবু হানিফা” নামে পরিচিত হয়। এতে মানব জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ব্যবসা–বাণিজ্য লেনদেন, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আমদানী নীতি, রপ্তানীনীতি, বাণিজ্যনীতি, আইন–বিচার ব্যবস্থা, শাসন–ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংবিধান, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ক ৩৮ হাজার ইবাদত সম্পর্কিত, ৪৫ হাজার মানব জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ও বিভাগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় মাসআলা। পরিবর্ধনের পর যা ছয়লাখে উপনীত হয়।
ইন্তিকাল: প্রসিদ্ধ বর্ণনা মোতাবেক হযরত ইমাম আ’যম আবু হানিফা রহমাতুল্লহি আলাইহি ৭০ বৎসর বয়সে ২ শাবান ১৫০ হিজরিতে ৭৬৭ খ্রি. আব্বাসী শাসক মনসুরের শাসনামলে কারাগারে ইন্তিকাল করেন। বাগদাদের আ’যমিয়া এলাকায় মাজার শরীফে এ মহান ইমাম চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। মহান আল্লাহ এ মহান ইমামের’ আদর্শ ও শিক্ষা আমাদের অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।