জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

নবী রাসূলগণের প্রতি ঈমান
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তাআলাকে ভয় করুন! তাঁর মনোনীত প্রিয় বান্দা সম্মানিত নবী রাসূলগণের প্রতি ঈমান তথা পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করুন। বিভ্রান্ত দিশেহারা মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তা’আলা এ পৃথিবীতে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা ছিলেন পবিত্র সত্তা যাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং মনোনীত করেছেন। খোদা প্রদত্ত ওহী (ঐশী জ্ঞান) ইলম ও হিকমত (প্রজ্ঞা) ও নূরে এলাহী দ্বারা তাঁদের অন্তরাত্মা ছিল আলোকিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “প্রত্যেক জাতির জন্য একজন রাসূল প্রেরিত হয়েছে।” (সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৪৭)
পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের হেদায়তের জন্য নবী রাসূল প্রেরণ করে আল্লাহ মানব জাতির প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, “আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি।” (সূরা: নাহল, আয়াত: ৩৬)
নবী রাসূলগণের পরিচয়: আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে ফেরেস্তার মাধ্যমে অথবা ইলহামের মাধ্যমে বা সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে যাঁর প্রতি বিশেষ ধরনের প্রত্যাদেশ বা ওহী অবতীর্ণ হয় তাঁকে নবী বলা হয়। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে নবুওয়াতের ধারা পরিসমাপ্তি করা হয়েছে। রাসূল আল্লাহর সেই খাস বান্দাকে বলা হয়, যার প্রতি ওহীর মাধ্যমে আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে। যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি আল্লাহর বানী পৌছানোর দায়িত্ব প্রাপ্ত। [কাওয়াইদুল ফিকহ, পৃ: ৫২১ কৃত: সায়্যিদ মুফতী আমীমুল ইহসান (র.)]
নবী রাসূলগণের প্রতি প্রেরিত ওহী: তালখীসূল বুখারী ও নিবরাস সূত্রে জানা যায়, আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য নবী রাসূগণের নিকট ওহী অবতরণ করেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর প্রতি দশবার। হযরত নুহ আলাইহিস সালাম’র প্রতি পঞ্চাশবার। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম’র প্রতি চল্লিশবার। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম’র প্রতি দশবার। ইমামুল আম্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি চব্বিশ হাজার বার ওহী অবতীর্ণ করেন। (মায়ারেবুত্তালাবা, পৃ: ৩৭)
সকল নবী রাসূলের উপর ঈমান আনা ফরজ: আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসূলগণের কারো প্রতি অবিশ্বাস থাকলে মু’মীন হিসেবে গণ্য হবেনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর কেউ আল্লাহ, তাঁর ফিরিস্তাগণ, তাঁর কিতাব সমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং পরকালকে অবিশ্বাস করলে সে ভীষণ ভাবে পথভ্রষ্ট।” (সূরা: নিসা, আয়াত: ১৩৬)
পবিত্র কুরআন ও অকাট্য হাদীসের মাধ্যমে যেসব নবী রাসূলদের সম্বন্ধে যেভাবে জানা গেছে তাঁদের সম্বন্ধে সেভাবে ঈমান রাখা ফরজ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি তো আপনার পূর্বে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি। তাদের কারও কথা আপনার নিকট বিবৃত করেছি এবং কারও কথা আপনার নিকট বিবৃত করিনি।” (সুরা: মু’মিন, আয়াত: ৭৮)
আল্লাহর মনোনীত বান্দারাই রিসালত প্রাপ্ত হন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আল্লাহ তাঁর রিসালাতের (দায়িত্ব) ভার কার ওপর অর্পন করবেন তা তিনিই ভাল জানেন।” (সূরা: আনআম, আয়াত: ১১৪)
নির্বাচন পদ্ধতি, মতামত গ্রহণ বা ইবাদত বন্দেগী ও কঠোর সাধানার দ্বারা নবী রাসূল হওয়া যায়না। আল্লাহ যাঁকে মনোনীত করেন তিনিই নবী রাসূল হন।
নবুয়াত আল্লাহর এক বিশেষ দয়া অনুগ্রহ যাঁকে ইচ্ছে তাঁকে দান করেন: আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, “এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন। আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।” (সুরা: হাদীদ, আয়াত: ২১)
পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত নবী রাসূলগণের বর্ণনা: হযরত আদম (আ.) থেকে আমাদের মহান নবী হুযুর সৈয়্যদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত আল্লাহ অসংখ্য নবী রাসূল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কারও নাম সুস্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করেছেন, কারও নাম উল্লেখ করেননি, সকলের উপর ঈমান আনা ফরজ। যাঁদের নাম কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে তা নিম্নরূপ:
১. হযরত আদম আলাইহিস সালাম। ২. হযরত নুহ আলাইহিস সালাম। ৩. হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। ৪. হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। ৫. হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম। ৬. হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। ৭. হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম। ৮. হযরত মুসা আলাইহিস সালাম। ৯. হযরত হারুন আলাইহিস সালাম। ১০. হযরত শুআইব আলাইহিস সালাম। ১১. হযরত লুত আলাইহিস সালাম। ১২. হযরত হুদ আলাইহিস সালাম। ১৩. হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম। ১৪.হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম। ১৫.হযরত আইউব আলাইহিস সালাম। ১৬. হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম। ১৭. হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। ১৮. হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম। ১৯. হযরত ইলিয়াছ আলাইহিস সালাম। ২০. হযরত আল ইয়াসা আলাইহিস সালাম। ২১. হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম। ২২. হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম। ২৩. হযরত যুল কিফ্‌ল আলাইহিস সালাম। ২৪. হযরত সালিহ আলাইহিস সালাম। ২৫. হযরত উযায়ের আলাইহিস সালাম। ২৬. খাতামুন নবীয়িন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ১ম, পৃ: ৪৮,৪৯)
নবী রাসূলগণ সম্বন্ধে ইসলামী আক্বিদা: নবীদের সংখ্যা নির্ধারণ না করা উত্তম। যেহেতু কুরআন মাজীদে সংখ্যা বর্ণনা করা হয়নি সেহেতু গোপন রাখাই ভাল। (তাকমীলুল ঈমান, পৃ: ১০৩, কৃত: শাখয় আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (র.), বাহারে শরীয়ত, খন্ড ১ম, পৃ: ৫২)
আল্লাহ তা’আলা নবী রাসূলদেরকে যে মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন তা কখনো ছিনিয়ে নেয়া হয় না। নবী রাসূলদের ইন্তিকালের পরও তা স্থায়ী থাকে। নবী রাসূলদের মৃত্যু হয় না। তাঁরা আল্লাহর অনুগ্রহে চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। ইন্তিকালের সময় তাদের দেহ থেকে রুহ বের হওয়ার পরই তা পুনরায় শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হয়। (তাকমীলুল ঈমান)
নবী রাসূলদের মর্যাদা: আল্লাহ তা’আলা আমাদের নবীকে অনন্য শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। এরশাদ হয়েছে, “এ রাসূলগণ তাঁদের কাউকে অন্য কারো উপর আমি শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ২৫৩)
নবীদের মহত্ব শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদাগত তারতম্য রয়েছে: নবী রাসূলগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন তথা সর্বশেষ নবী সর্বকালের সর্বযুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমাদের নবীর পর সকলের চেয়ে বড় মর্যাদাবান হযরত ইবরাহীম (আ.) অত:পর হযরত মুসা (আ.) অত:পর হযরত ঈসা (আ.) তার পর হযরত নুহ আলাইহিস সালাম। যেমনিভাবে হুযুর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল রাসূলদের সরদার এবং সকলের শ্রেষ্ঠ। নবীজির ওসীলায় নবীজির উম্মত সকল নবীদের উম্মতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এরশাদ হয়েছে তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। (আল ইমরান, আয়াত: ১১০, বাহারে শরীয়ত, খন্ড ১ম, পৃ: ৫৪)
আমাদের নবীর শ্রেষ্ঠ মর্যাদা: সকল নবী রাসূলদের মধ্যে আমাদের মহান নবী রাহমাতুল্লীল আলামীন নবীর শ্রেষ্ঠ মর্যাদা প্রসঙ্গে কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি রাসূলগণের উপর নেতৃত্বদানকারী। এতে আমার কোন অহংকার নেই। আমি সর্বশেষ নবী, এতে আমার অহংকার নেই। আমি সর্ব প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশ প্রথমে গৃহীত হবে। এতে আমার কোন অহংকার নেই। (তাবরানী শরীফ, হাদীস নং: ১৭৬)
নবীগণ আপন রওজা শরীফে জীবিত: নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) নিজ নিজ রওজা মুবারকে ইন্তিকালে পরও জীবিত। হযরত আবুদ দারদা (রা.) থেকে হাদীস বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মাটির উপর নবীদের দেহ ভক্ষণ করা হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহর নবীগণ জীবিত ও রিযক প্রাপ্ত। (সুনানে ইবনে মাযাহ, খন্ড:২, পৃ: ২৯১, হাদীস নং: ১৬৩৭)। হযরত আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন নবীগণ তাঁদের কবরে জীবিত, তারা (কবরে) নামায পড়েন । (দায়লামী শরীফ, খন্ড:১, হাদীস নং: ৪০৩, বাহারে শরীয়ত, খন্ড ১ম, পৃ: ৫৮)। হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার মকবুল বান্দাদের আদর্শ দান করুন। নবী রসূল আলাহিমুস সালাম এর প্রতি পূর্ণ ঈমান নসীব করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিলায়তের উজ্জ্বল নক্ষত্র : একটি বিশুদ্ধ হাদিস শরীফ মর্মার্থের সাদৃশ্যতা
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা ও কিছু কথা