প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
খোলাফায়ে রাশেদার মধ্যমণি মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা, মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপনকারী প্রথম মুসলিম, রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের প্রথম জন খলীফাতু রাসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিআল্লাহ আনহু’র জীবন কর্ম ও ইসলাম প্রচারে তাঁর বহুমাত্রিক অবদান ইসলামের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
নাম ও বংশ পরিচিতি:= হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিআল্লাহু আনহুর নাম “আবদুল্লাহ” উপনাম আবু বকর, উপাধি সিদ্দিক ও আতিক। পিতার নাম আবু কুহাফা উসমান, মাতার নাম উম্মুল খায়র সালমা। তাঁর বংশধারা উর্ধ্বতন ষষ্টপুরুষ মুররা পর্যন্ত গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নসব নামার সাথে মিলে যায়। হযরত আবু বকর (রা.)’র উপাধি আল–আতীক হওয়ার কারণ হলো, আতিক অর্থ মুক্ত, উৎকৃষ্ট, সুন্দর, প্রাচীন, যুবাইর ইবনু বাক্কার (রা.) বলেন, আবু বকর (রা.) জীবনে দোষনীয় কোনো কাজ করেননি এ জন্য তাঁকে আতিক বলা হতো। [তারীখুল খুলাফা, পৃ: ১১, ড. আহমদ আলী, খলীফাতু রাসূলিল্লাহ আবু বকর আছছিদ্দীক (রা.), পৃ: ৩২]
সিদ্দিক অর্থ সত্যবাদী, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বিস্ময়কর ঘটনাবলী বর্ণনার পর কাফিররা অলীক কাহিনী বলে অবিশ্বাস করে। হযরত আবু বকর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে শুনা মাত্রই বিনা দ্বিধায় মিরাজের ঘটনাকে মনে প্রাণে সত্য হিসেবে নেওয়ায় তিনি “সিদ্দিক” উপাধিতে ভূষিত হলেন।
জন্ম: হযরত আবু বকর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বয়সে দু’বছর চার মাস ছোট ছিলেন। তিনি হস্তি সনের ঘটনার দু’বৎসর ছয় মাস পর মক্কাতুল মুকাররমার মিনায় ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। (আনোয়ারুল বায়ান খন্ড:২, পৃ: ১৫১, তারিখুল খুলাফা, পৃ: ২১,
ড.আহমদ আলী ‘খলীফাতু রাসূলিল্লাহ আবু বকর আছ ছিদ্দীক (রা.) পৃ: ৩৯)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবী: ইবনে আসাকীর হযরত মাওলা আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারীখুল খুলাফা, পৃ: ২৩)
হযরত ইমাম আবু হানীফা (র.)’র বর্ণনা মতে পূরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) সর্বপ্রথম, বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আলী (রা.), মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। (তারীখুল খুলাফা, পৃ: ২৬)
তিনিই প্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সঙ্গে নামায আদায় করেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র শ্রেষ্ঠত্ব: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র শ্রেষ্ঠত্ব প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীসের বর্ণনা রয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আমরা যখন সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা নিরুপণ করতাম সর্বাপেক্ষা আবু বকর (রা.) কে মর্যাদা দিতাম, তারপর হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কে তারপর হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) কে। (সহীহ বুখারী, হাদীস, ৩৬৫৫)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মুজতাহিদ ইমামদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁরপর হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাঁর পর উসমান ইবনে আফফান (রা.) চতুর্থ স্থানে হযরত আলি ইবনু আবি তালিব রাদ্বিআল্লাহু আনহু। তারপরের মর্যাদা আশরায়ে মুবাশশারার বাকী সদস্যগণ, তারপর বদর যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী আহলে বদর সাহাবাগন, তারপর আহলে উহুদ, তারপর হুদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারী সাহাবাগণ, এরপর অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম।
আল কুরআনের আলোকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র মর্যাদা: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র শান মান মর্যাদা ও অবদান এর প্রশংসায় পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর সাহাবী হওয়াটা অকাট্যভাবে কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সে [আবু বকর (রা.)] ছিলেন দু’জনের একজন যখন তাঁরা উভয়ই গুহার মধ্যে ছিলেন, যখন আপন সঙ্গীকে ফরমাচ্ছিলেন দুঃখিত হয়োনা নি:সন্দেহে আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৪০)
এ বিষয়ে সকল তাফসীরকার ঐক্যমত পোষন করেছেন যে, বর্ণিত আয়াত হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র শানে অবতীর্ণ হয়েছে, হিজরতের রজনীতে সওর পর্বতের গুহায় নবীজির সাথে একমাত্র হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ই–ছিলেন। শিয়া, রাফেযী সম্প্রদায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সংক্রান্ত সাহাবী হওয়া প্রসঙ্গে আয়াত অস্বীকার করত: তাঁর শানে গালমন্দ করে থাকে, এ কারণে তারা কাফির হিসেবে সাব্যস্ত। হযরত আবু বকর নিজেও সাহাবী তাঁর পিতাও সাহাবী মাতাও মহিলা সাহাবী। তাঁর সন্তান সন্তুতিও সাহাবী, তাঁর পৌত্র পৌত্রীও সাহাবী ছিলেন। (কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান, পৃ: ৩৫৭)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাজীম ও আদব রক্ষার্থে আল্লাহর ঘোষণা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাজিম, আদব ও সম্মান প্রদর্শন করার নাম ঈমান। নবীজির প্রতি অসম্মান অশ্রদ্ধা ধৃষ্ঠতা ও অবমাননা করা সুষ্পষ্ট কুফরি। নবীজির শান মান ও মর্যাদা সুরক্ষার আদব শিক্ষা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগন! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উচ্চস্বরে কথা বলোনা। এতে তোমাদের আমল সমূহ বরবাদ হয়ে যাবে তোমরা তা টেরও পাবেনা। (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ৩)
উপরোক্ত আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত ওমর (রা.) সহ সাহাবায়ে কেরাম নবীজির মহান দরবারে রিসালাতে কথা বলার সময় অত্যন্ত সতর্কতা ও সর্বোচ্চ সম্মান রক্ষা করতেন, নীচু স্বরে কথা বলা নিজেদের জন্য অপরিহার্য করে নিলেন। বর্ণিত আয়াত অবর্তীণ হবার পর হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) নবীজির খিদমতে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সে সত্তার শপথ. যিনি অপনার উপর কুরআন নাযিল করেছেন, এখন থেকে আমি ইন্তিকাল পর্যন্ত আপনার সাথে একান্ত পরামর্শ দাতার মতো চুপিসারে কথা বলবো। (হাকীম, আল মুস্তাদরাক, হাদীস: ৩৬৭৯)
নবীজির সাথে সাক্ষাতের জন্য যখনই কোন প্রতিনিধি দল আসতেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবীজির দরবারে আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের নিকট বিশেষ লোক পাঠাতেন রাসূলের প্রতি সালামের পদ্ধতি তাদেরকে শিক্ষা দিতেন। রাসূলের নিকট প্রশান্তির সম্মান ও ইহতিরাম রক্ষা করার নিয়ম শিক্ষা দিতেন। (তাফসীর, রুহুল মা’আনী, খন্ড:১৩, পৃ: ১৩৫)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র দানশীলতা: আমিরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন সে সময় তাঁর নিকট চল্লিশ হাজার দিনার মজুদ ছিল, নবীজির সান্নিধ্যে এসে ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর সমুদয় সম্পদ আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দিলেন, রাতে দশ হাজার, দিনে দশ হাজার, প্রকাশ্যে দশ হাজার, গোপনে দশ হাজার, অকাতরে আল্লাহর পথে দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করলেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কখনো কারো সম্পদ আমার এতটা উপকার হয়নি যতটা আবু বকরের সম্পদ আমাকে উপকৃত করেছে। হযরত আবু বকর কেঁদে ফেলেন এবং আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি ও আমার সম্পদ শুধু আপনার জন্যই। (সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস: ৯৪)
খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণের পর জন সম্মুখে তাঁর ঐতিহাসিক প্রদত্ত ভাষণ: হে মানবমন্ডলী! আমাকে আপনাদের শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। যদি আমি ভালো কাজ করি তবেই আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন, আর যদি মন্দ কাজ করি আপনারা আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। সত্যবাদিতা একটি পবিত্র আমানত, আর মিথ্যাচার একটি জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা। ইনশাআল্লাহ আপনাদের দূর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল বলে বিবেচিত হবে যে যাবৎ না আমি তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেবো। আর ইনশাআল্লাহ আপনাদের সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বলরূপে বিবেচিত হবে যে যাবৎ না আমি তার নিকট থেকে অপরের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নেব। যে জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ করা ছেড়ে দেয় আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে লাঞ্চিত ও অপমানিত করেন। যে জাতির মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তাদের সকলের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে। আপনারা আমার নির্দেশ মেনে চলবেন। যে যাবৎ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকব। যদি আপনার দেখেন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হচ্ছি তখন আমার নির্দেশ মান্য করা আপনাদের উপর আবশ্যক নয় এখন আপনারা নামাযের জন্য দাঁড়ান, আল্লাহ তা’আলা আপনাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন। (আনোয়ারুল বয়ান, ২য় খন্ড)
ইন্তিকাল: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র খিলাফতকাল ছিল ২ বৎসর ৩ মাস ২৪ দিন, ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বৎসর। দীর্ঘ ১৫ দিন জ্বরাক্রান্ত থাকার পর ১৩ হিজরির ২২ জমাদিউস সানি মঙ্গলবার ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তিকাল করেন।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে খলিফাতু রাসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিআল্লাহু আনহুর আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ শওকাতুল ইসলাম
জাঙ্গাল পাড়া, আতুরার ডিপো, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কা’বা শরীফের ভেতরে নামায পড়া জায়েজ কিনা? ইমাম সাহেব কা’বা শরীফের ভেতরে মুক্তদি বাইরে থাকলে ইকতেদা শুদ্ধ হবে কিনা? জানালে কৃতার্থ হব।
প্রশ্নের উত্তর: মুজতাহিদ ফকীহ গণের বর্ণনা মতে কা’বা শরীফের ভেতরে সব ধরনের নামায জায়েজ। ফরজ হোক, নফল হোক, একাকী হোক, জামাত সহকারে হোক, জায়েজ হবে। ইমাম ক্বাবা শরীফের ভেতরে মুক্তাদি বাহিরে ইকতেদা শুদ্ধ হবে। ইমাম ভেতরে একাকী হোক অথবা তাঁর সাথে কয়েক জন মুক্তাদি হোক, কিন্তু দরজা খোলা রাখতে হবে। যেন মুক্তাদিগণ ইমামের রুকু সিজদার অবস্থান জানতে পারে। আর যদি দরজা বন্ধ থাকে কিন্তু ইমামের আওয়াজ বাইরে আসছে তাহলে ক্ষতি নেই। (দুর্রুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২৩২)
ক্বা’বা শরীফের ছাদের উপর নামায পড়লেও একই হুকুম, তবে কা’বা শরীফের ছাদের উপর নামায পড়া মাকরূহ। (তানভীরুল আবছার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৪র্থ, পৃ: ২৩২)